সন্দেশখালির ‘বিভীষিকা’য় হতচকিত ইডি আধিকারিক! —ফাইল চিত্র।
কর্মজীবনে অনেক তল্লাশি অভিযানে গিয়েছেন। তদন্তের কাজে যেতে হয়েছে রাজ্যের নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িতেও। সেখানে বহু বার ‘ক্রুদ্ধ’ জনতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু সন্দেশখালিতে যে ‘বিভীষিকা’র সামনে পড়তে হল, তাতে রীতি মতো হতচকিত ইডি আধিকারিক রাজেশ দুবে (নাম পরিবর্তিত)! ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বার বার একটি কথাতেই আটকে যাচ্ছিলেন ওই কর্তা— ‘‘আর এক মিনিট দেরি হলে যে কী হয়ে যেত!’’
শুক্রবার সকালে উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখের বাড়িতে তল্লাশি অভিযানে যায় পাঁচ ইডি আধিকারিকের একটি দল। সেই দলেই ছিলেন রাজেশ। তাঁদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনীও ছিল। রাজেশ জানান, সকাল ৭টা নাগাদ তাঁরা সরবেড়িয়া গ্রামে শাহজাহানের বাড়ির সামনে পৌঁছে গিয়েছিলেন। হঠাৎ করে এলাকায় এত জওয়ান দেখে কৌতূহলী গ্রামবাসীরা জড়ো হতে শুরু করেন। তখনও পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। বেশ কয়েক বার তৃণমূল নেতার বাড়ির দরজার কড়া নাড়ানো হয়। কিন্তু ভিতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ভাবে কিছু ক্ষণ কাটতেই বাড়ির দরজা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তত ক্ষণে শ’য়ে শ’য়ে গ্রামবাসী হাজির হয়েছিলেন শাহজাহানের বাড়ির উঠোন চত্বরে। হঠাৎই শুরু হয় তুমুল চিৎকার-চেঁচামেচি!
ইডিকর্তা বলতে থাকেন, ‘‘শুরুতে প্রত্যেকের মুখে চাপা উত্তেজনা ছিল। সেটা ওঁদের চোখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। এই দৃশ্য আমাদের অচেনা নয়। এ সব দেখতে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু কখন যে সব বদলে গেল, বুঝতেই পারলাম না! আগুনে ঘি পড়লে যে ভাবে দপ করে জ্বলে ওঠে, গোটা এলাকায় যেন ওই ভাবে জ্বলে উঠল। আচমকাই বীভৎস চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হল। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই দেখলাম, কয়েক জন এগিয়ে আসতে শুরু করলেন আমাদের দিকে।’’ রাজেশ জানান, তল্লাশি অভিযানে গিয়ে একাধিক বার উত্তেজিত জনতার মুখে পড়তে হয়েছে। যে ভাবে প্রতি বার তাঁরা ওই পরিস্থিতির মোকাবিলা করেন, এ বারও সেই ভাবেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সব ‘টোটকা’ ব্যর্থ হল সন্দেশখালিতে! তাঁর কথায়, ‘‘ভেবেছিলাম, আমরা কী জন্য এসেছি, সেটা গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে বলব। জানাব যে, আমরা নির্দিষ্ট কাজে এসেছি। কাজ মিটলেই চলে যাব। সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনীও আছে। তারাও নিজেদের মতো নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করবে। কিন্তু পরিস্থিতি যে এ ভাবে হাতের বাইরে বেরিয়ে যাবে, কে জানত!’’
ইডির কলকাতার দফতরেই কর্মরত রাজেশ। রাজ্যের মন্ত্রী-বিধায়কদের বাড়িতে হওয়া তল্লাশি অভিযানের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। সেই সব অভিযানে গ্রেফতারও হয়েছেন শাসকদলের নেতারা। কিন্তু সন্দেশখালির অভিযানে গিয়ে এই প্রথম মারমুখী জনতার ‘রূপ’ প্রত্যক্ষ করলেন রাজেশ! গোটা ঘটনায় এখনও আতঙ্কগ্রস্ত ইডিকর্তা বলেন, ‘‘এত কম সময়ের মধ্যে গোটা ঘটনাটা ঘটে গিয়েছিল যে, এখনও কিছু বুঝে উঠতে পারছি না! মনে হচ্ছে যেন, আর এক মিনিট দেরি হলে আমাদের সঙ্গে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারত। আচমকাই তেড়ে এসে আমাদের মারধর করতে থাকে গ্রামবাসীরা। ওই পরিস্থিতিতে ওখান থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না! ওই সময় আর কিছুই ভাবিনি, প্রাণপণে ছুটেছি আমরা। তার পর কে যে কোন দিকে গেল, কিছুই জানতে পারিনি।’’
রাজেশ জানান, তাঁরা যখন ছুটছিলেন, পিছুও নিয়েছিলেন কয়েক জন। এ কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল ওই ইডি আধিকারিকের! ধরা গলায় রাজেশ বলেন, ‘‘ওই এলাকায় তো কোনও দিন যাইনি এর আগে। গ্রামের রাস্তাঘাটও চিনি না। কোন দিকে যাব, কী করব, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। যে দিকেই যাচ্ছি, দেখি রাস্তা শেষ! কোনও মতে গ্রাম থেকে বেরোতে পেরেছি আমরা। আমার সঙ্গে গরমজামা ছিল। মোবাইল ছিল। ওঁরা সব কেড়ে নিয়ে আমার কাছ থেকে।’’
তবে গ্রাম থেকে বেরোনোর পর স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসনের সহায়তা মিলেছে বলেই জানিয়েছেন রাজেশ। তিনি জানান, সরবেড়িয়া থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন তাঁরা। পরে স্থানীয় থানার পুলিশ এসে তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যান। ওই ইডিকর্তার কথায়, ‘‘মনে হচ্ছে যেন, কোনও মতে প্রাণে বেঁচেছি! ঠিক সময়ে পুলিশ না এলে হয়তো আবার বিপদে পড়তে হত। পরে তো জানতে পারলাম, আমাদের কারও মাথা ফেটেছে! হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু ওই সময় কে কোন দিকে গিয়েছিল, জানতে পারিনি। কেউ টোটোয় করে এলাকা ছেড়েছে, কাউকে আবার লঞ্চে তুলে দিয়েছে পুলিশ। এ এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। জীবনে ভুলব না!’’