TMC in Parliament

সংসদে দাবি তুলে বাংলার শহর ঘিরতে চাইছে তৃণমূল? বিমা-ওষুধ-মেট্রো সব ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সাংসদেরা

লোকসভা ভোটে তৃণমূলের প্রচারের মূল বিষয় ছিল ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’। যে প্রচারের উদ্দেশ্য ছিলেন মূলত গ্রামীণ মানুষ। কিন্তু সংসদে তেমন কোনও গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই বাংলার শাসকদলের দাবি।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৪ ০৯:০৪
Along with the demands of the rural people, TMC is also raising demands of the urban middle class in the Parliament

গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।

যাদবপুরের সাংসদ সায়নী ঘোষ লোকসভায় প্রথম বক্তৃতা করতে উঠেই দাবি তুলেছিলেন, কবি সুভাষ থেকে বারুইপুর পর্যন্ত মেট্রো সম্প্রসারণের কাজ কেন এখনও এগোল না? শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক কিছুর সঙ্গে দাবি তুলেছেন রিষড়া, শেওড়াফুলি, উত্তরপাড়ায় রেলের লেভেল ক্রসিংয়ে উড়ালপুল নির্মাণ করা হোক। নইলে হাজার হাজার মানুষ প্রতি দিন অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কীর্তি আজাদ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন প্যাকেটে ছাপা দামের থেকেও বেশি টাকায় ওষুধ কিনতে হচ্ছে? সাকেত গোখলে, দোলা সেনেরা প্রশ্ন তুলেছেন, কেন জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামে ১৮ শতাংশ জিএসটি দিতে হবে? চটকল এবং চটকল শ্রমিকদের নিয়ে সরব হয়েছেন সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

চলতি অধিবেশনে সংসদের দুই কক্ষেই তৃণমূলের সাংসদেরা যা যা দাবি তুলছেন, তার মধ্যে ‘নকশাবদল’ দেখছেন অনেকে। তৃণমূলের পুরনো সাংসদেরাও মানছেন, এ বার সবটাই ‘অন্য রকম’।

২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে বাংলায় তৃণমূলের প্রচারের মূল বিষয় ছিল ‘কেন্দ্রের বঞ্চনা’। পাশাপাশিই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়রা এই আখ্যান তৈরি করতে চেয়েছিলেন যে, কেন্দ্র ‘প্রাপ্য’ টাকা না দিলেও রাজ্য তা মিটিয়ে দিচ্ছে এবং দেবে। যে প্রচারের উদ্দেশ্য ছিলেন মূলত গ্রামীণ এবং অর্থনৈতিক ভাবে প্রান্তিক অংশের মানুষ। ভোটের ফলাফলে দেখা গিয়েছে, গ্রামের মানুষের সমর্থন তৃণমূলের ঝুলি ভরিয়ে দিলেও শহরাঞ্চলে তৃণমূলের জনসমর্থন কমেছে। যার রেশ ধরে শহরাঞ্চলের তৃণমূলে সাংগঠনিক এবং প্রশাসনিক রদবদলের জল্পনা জোরালো হয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটেই তৃণমূলের সাংসদেরা গ্রামীণ জনতার দাবিদাওয়া তোলার পাশাপাশি সব অংশের মানুষের সমস্যা তুলে ধরার ‘লাইনে’ যে ভাবে হাঁটছেন, তা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’।

অভিষেক নিজে বাজেটের উপর তাঁর বক্তৃতায় ১০০ দিনের কাজ এবং আবাস যোজনার বকেয়া নিয়ে সরব হয়েছেন। জবাবি বক্তৃতায় নির্মলা সেই প্রসঙ্গ না তোলায় পাল্টা শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি তুলে সংসদের বাইরেও বিরোধী পরিসরকে সরগরম করেছিলেন অভিষেক। মাঝে দু’দিন অভিষেকের সেই বক্তব্যকেই প্রচারের হাতিয়ার করেছিল তৃণমূল। তবে শুধু বকেয়া বা গ্রামীণ জনতার দাবিদাওয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকছেন না তৃণমূলের সাংসদেরা। তার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, শহরাঞ্চলের মানুষের দাবিদাওয়াও। জুন মালিয়া, শর্মিলা সরকার, বাপি হালদারের মতো এ বারই প্রথম জয়ী সাংসদেরাও নানা বিষয় তুলে ধরছেন। তা-ও নজর কাড়ছে অনেকের।

ইতিমধ্যেই জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্যবিমার প্রিমিয়ামে ১৮ শতাংশ জিএস়টি প্রত্যাহারের দাবিতে কেন্দ্রের উপর চাপ বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে তৃণমূল। সংসদে শুধু প্রশ্ন তোলা নয়, স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে চিঠি লিখেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমমন্ত্রী নির্মলাকে। বৃহস্পতিবার এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে পোস্ট করে মমতা হুঁশিয়ারির সুরে বলেছিলেন, জিএসটি প্রত্যাহার না হলে রাস্তায় আন্দোলনে নামবেন। এই বিষয়ে গত ২৮ জুলাই নির্মলাকে চিঠি লিখেছিলেন কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণমন্ত্রী নিতিন গডকড়ী। গত ২৯ তারিখ রাজ্যসভায় বিষয়টি তোলেন তৃণমূল সাংসদ সাকেত। তার পর দোলাও এ নিয়ে সরব হন। তৃণমূলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘‘নিতিন গডকড়ী যখন চিঠি লিখে তাঁরই সতীর্থকে কোনও দাবি জানাচ্ছেন, তখন বুঝতে হবে এর নেপথ্যে অন্য কারণ রয়েছে।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘গডকড়ী সঙ্ঘের কথা ছাড়া চলেন না। অনেকের মনে হচ্ছে, সঙ্ঘের কথাতেই ওই চিঠি লিখেছেন গড়কড়ী। কিন্তু এটা জ্বলন্ত সমস্যা। এই বিষয়টাকে হেলায় ছেড়ে রাখা যায় না।’’

তৃণমূলের অনেক প্রবীণ সাংসদও একান্ত আলোচনায় মেনে নিচ্ছেন, অতীতে কখনও লোকসভার সাংসদেরা আলোচনায় এতগুলি দিক তুলে ধরেননি। নতুন সাংসদদের জড়তা কাটিয়ে লোকসভায় বক্তৃতা দেওয়া প্রসঙ্গে লোকসভায় তৃণমূলের সংসদীয় দলের মুখ্যসচেতক কল্যাণ বলেন, ‘‘দলের লাইনই হল নতুনদের বলার সুযোগ করে দিতে হবে। দলের নির্দেশেই আমি তাঁদের উৎসাহিত করছি। নতুন সাংসদেরা প্রত্যেকেই খুব ভাল বলছেন। নিজের সংসদীয় কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্য এবং দেশের বিষয় তুলে ধরছেন।’’ তৃণমূলের এক প্রাক্তন রাজ্যসভা সাংসদের কথায়, ‘‘অতীতে উচ্চকক্ষে আমরা যাঁরা রাজনীতির লোক, তাঁরা জাতীয় স্তরের সমস্যা তুলে ধরতাম। অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন কয়েক জন লোকসভার সাংসদ জাতীয় এবং রাজ্যের কথা বলতেন। কিন্তু তথাকথিত সেলিব্রিটিরা মুখ খুলতেন না। এ বার সেটা হচ্ছে না।’’ তার কারণ হিসেবে ওই প্রাক্তন সাংসদ বলেন, ‘‘এ বার সংসদের দুই কক্ষেই আমাদের সাংসদদের মধ্যে রাজনৈতিক লোক অনেক বেশি। সেটারই সুফল পাওয়া যাচ্ছে।’’ রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, সংসদে কে কী আলোচনা করছেন, তা নিয়ে শহুরে লোকজনের মধ্যে আলোচনা থাকে। সার্বিক ভাবে মতামত তৈরিতে তাঁদের ভূমিকাও থাকে বলে মত অনেকের। তৃণমূল তাঁদের ছুঁয়ে যাওয়ার কৌশল নিয়ে চলছে বলে ঠারেঠোরে মেনেও নিয়েছেন একাধিক সাংসদ। কারণ, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে শহরের ভোট ফেরত চাই তৃণমূলের।

আরও পড়ুন
Advertisement