(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেন এবং বাবুল সুপ্রিয়। ছবি: সংগৃহীত।
গত কয়েক মাসে কোনও প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে যে ছবি দেখা যায়নি, মঙ্গলবার তা-ই দেখা গেল বিশ্ববাংলা বাণিজ্য সম্মেলনের মঞ্চে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যেয়র সঙ্গে এক ফ্রেমে দুই গায়ক তথা মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন এবং বাবুল সুপ্রিয়। মধ্যমণি মমতা। তাঁর পাশে বাবুল আর ইন্দ্রনীল। গলা মিলিয়ে গাইলেন রাজ্য সঙ্গীত, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল...’।
বাবুলের সঙ্গে ইন্দ্রনীলের সম্পর্ক কতটা ‘মধুর’ তা মোটামুটি শাসকদল ও সরকারের মধ্যে সর্বজনবিদিত। দু’জনে গায়ক হলেও তাল ঠোকাঠুকি লেগেই ছিল। বাবুল মন্ত্রিসভায় জায়গা পাওয়ার পরে ইন্দ্রনীলের হাতে থাকা পর্যটন দফতর তাঁকে দিয়েছিলেন মমতা। তার পর সময় এগোয়, দু’জনের খিটিমিট বাড়তে থাকে। গত মে-জুন মাস থেকেই শাসকদল ও সরকারের অনেকে ঘরোয়া আলোচনায় বলাবলি শুরু করেছিলেন, পর্যটন দফতরে বাবুলের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন মমতা। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একদা নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার সদস্য বাবুলের নম্বর কমছিল বলেও শোনা যাচ্ছিল নবান্নের নানা মহলে। তার পর জুলাই মাসে একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেন মমতা। তাতে রাজ্যের পর্যটন উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান পদ থেকে আমলা নন্দিনী চক্রবর্তীকে সরিয়ে দেন তিনি। নন্দিনীর স্থলাভিষিক্ত করা হয় মন্ত্রী ইন্দ্রনীলকে। ওই সিদ্ধান্তের পর শাসকদলের এক প্রথম সারির নেতা ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, ‘‘দিদি আসলে বাবুলের ঘাড়ে এক জন ‘মার্কার’ লাগিয়ে দিলেন।’’
দুই গায়ক মন্ত্রীর যে অবনিবনা ছিল অদৃশ্য, গত ২৮ অগস্ট সেটাই প্রকাশ্যে এসে পড়ে। বিধানসভা ভবনে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের পরে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরের সামনে প্রকাশ্য বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন বাবুল-ইন্দ্রনীল। ইন্দ্রনীলের উদ্দেশে বাবুলকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘তুমি আমার দফতরের কাজ আটকাচ্ছ কেন? তুমি এ ভাবে সরকারি কাজ আটকে রাখতে পারো না! তুমি ফাইল পাঠানো বন্ধ করে দিলে কাজ হবে কী করে!’’ যা শুনে ইন্দ্রনীল বাবুলকে বলেন, ‘‘তোর যা বলার তুই সেটা দিদিকে গিয়ে বল!’’ পাল্টা বাবুল বলেন, ‘‘সে আমি তো বলেইছি। যদি দরকার মনে করি আবার বলব। কিন্তু তুমি এ ভাবে আমার দফতরের কাজ আটকাতে পারো না।’’ তত ক্ষণে বিধানসভার অলিন্দ এবং দেওয়াল যা শোনার শুনে ফেলেছে। কিন্তু বিতণ্ডা আর বাড়তে না দিয়ে ‘মার্কার’ ইন্দ্রনীল বলেছিলেন, ‘‘এখানে এ ভাবে কথা বলিস না তুই। তোর দফতরের কাজ কেন আটকাতে যাব আমি! বললাম তো, তোর কিছু বলার থাকলে দিদিকে গিয়ে বল।’’
বাবুল-ইন্দ্রনীলের ওই প্রকাশ্যে বিতণ্ডা নিয়ে শাসকদলে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। বাবুলের কেন্দ্র বালিগঞ্জের লাগোয়া এলাকার এক বিধায়ক ঘরোয়া আলোচনায় বলেছিলেন, ‘‘দিদির প্রথম মন্ত্রিসভায় এই রকম ঝগড়া করতে দেখা যেত কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী আর সাবিত্রী মিত্রকে। ওই দু’জন ছিলেন আমের দেশের (মালদহ)। আর এঁরা গানের দেশের!’’
তবে প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ইন্দ্রনীলের সঙ্গে ওই প্রকাশ্য বিতন্ডার পরে বাবুল নিজেই মুখ্যমন্ত্রী মমতার কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন, যাতে তাঁকে পর্যটনের দায়িত্ব থেকে ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়। কারণ, তিনি আর কোনও ‘সংঘাতে’ আগ্রহী নন। সেই মর্মে তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠিও লিখেছিলেন। যদিও তা শেষপর্যন্ত তিনি দিয়ে উঠতে পারেননি মুখ্যমন্ত্রী সেই সময়ে কলকাতায় না-থাকায়।
তবে ইন্দ্রনীল-বাবুল প্রকাশ্য বিতন্ডার পরে গত ১১ সেপ্টেম্বর বড় পদক্ষেপ করেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। মন্ত্রিসভায় দফতর রদবদলে বাবুলের হাত থেকে পর্যটন নিয়ে তা আবার ইন্দ্রনীলকে দিয়ে দেন তিনি। বাবুলকে দেওয়া হয় অপেক্ষাকৃত ‘কম গুরুত্বপূর্ণ’ বলে পরিচিত অচিরাচরিত শক্তি উৎস দফতর। তবে তথ্যপ্রযুক্তি দফতরটি বাবুলের হাতেই রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু পর্যটন থেকে বাবুলকে সরিয়ে দেওয়া ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়। বাবুলের হিতৈষিরা যদিও দাবি করেন, পর্যটন থেকে সরালেও বাবুলকে এমনই দফতর দেওয়া হয়, যা বাবুল কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকার সময়ে পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন দফতরে থাকাকালীন করতেন।
তবে পর্যটন থেকে বাবুলকে সরানোর পরে ইন্দ্রনীল-বাবুলের সম্পর্কের উন্নতি ঘটেছে, এমন কিছু শোনা বা দেখা যায়নি। মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্র ভবানীপুরের বিজয়া সম্মিলনীতে ইন্দ্রনীল-সহ এক ঝাঁক গায়ক-গায়িকা ছিলেন। সেখানেও রাজ্য সঙ্গীত গাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা যায়নি বাবুলকে। অতঃপর মঙ্গলবার বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রীর দু’পাশে দেখা গেল দু’জনকে। মেলালেন তিনি মেলালেন?