অধীর চৌধুরী এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
বাংলায় বিজেপি-বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সম্ভাবনা যে খুব একটা নেই, শুক্রবারই তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আসন সমঝোতার কোনও লক্ষণ না দেখে রাজ্যের ৪২ আসনে প্রস্তুতি শুরু করার নির্দেশও দিয়েছিলেন দলীয় নেতাদের। এ বার কংগ্রেসের তরফে বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীও জানিয়ে দিলেন, বাংলায় তাঁরা একা লড়তে প্রস্তুত। তবে দল একা লড়বে কি না, সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বই নেবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে মমতার শুক্রবার করা ‘ফ্যাক্টর নয়’ মন্তব্যের জবাবও দিয়েছেন অধীর।
শনিবার শিলিগুড়ির হিলকার্ট রোড সংলগ্ন একটি বেসরকারি হোটেলে কংগ্রেসের কর্মী সম্মেলন ছিল। সেখানে গিয়েছিলেন অধীর। এ জন্য রাজ্যে এসেছিলেন কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ কেসি বেনুগোপালও। দলীয় বৈঠক সেরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। বিরোধী জোট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘দেশের প্রত্যেকে এখন পরিবর্তন চাইছে। আমাদের লক্ষ্য, যত বেশি সম্ভব বিজেপির আসন কমানো। বাংলাতেও আমাদের লক্ষ্য বিজেপির যতটা সম্ভব আসন কমানো। আমরা আশাবাদী, ইন্ডিয়া-র প্রতিটি রাজনৈতিক দলের লক্ষ্যও তা-ই। আমাদের একে অপরকে শ্রদ্ধা করা উচিত। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মর্যাদা দিলে তবেই নরেন্দ্র মোদীকে হারানো সম্ভব। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে বোঝা উচিত যে, যখন প্রত্যেকের লক্ষ্য এক, তখন অনেক সময় কাউকে উপরে, কাউকে নীচে আসতে হবে। আপোস করতে হবে। আর এটাই কংগ্রেসের অবস্থান।’’
সর্বভারতীয় স্তরে ‘ইন্ডিয়া’ জোটে থাকলেও রাজ্যে বিজেপি-বিরোধিতায় একক ভাবে তাঁর দলই যে প্রধান শক্তি, একাধিক বার সেই বার্তা দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। তৃণমূল সূত্রে খবর, শুক্রবার কালীঘাটে দলীয় বৈঠকে মমতা কার্যত স্পষ্টই করে দিয়েছেন, বাংলায় আসন নিয়ে নিজেদের দাবি থেকে কংগ্রেস সরে না-এলে জোট সম্ভব নয়। তৃণমূল একক ভাবেই লড়াই করবে। এর পরেই রাজ্য-রাজনীতিতে জল্পনা, বাংলায় কংগ্রেস ও তৃণমূলের আলাদা লড়া কি তা হলে নিশ্চিত? শনিবার এ প্রসঙ্গে অধীর বলেন, ‘‘দিল্লিতে এ সব নিয়ে আলোচনা হতে পারে৷ আমার জানা নেই। আন্দাজে কথা বলতে পারব না। আমি জানি, আমাকে লড়তে হবে।’’
তৃণমূলের সঙ্গে জোট নিয়ে বাংলার অধিকাংশ কংগ্রেস নেতার ‘অ্যালার্জি’র বিষয়টি বার বার প্রকাশ্যে এসেছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর একাধিক বার অভিযোগ করেছেন, তৃণমূলনেত্রীই আসলে বাংলায় জোট চান না। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি কত ‘আন্তরিক’, সেটা দেখানোর জন্যই কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার কথা বলছেন। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বও ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের শরিক হিসাবে বার্তা বিনিময় করছেন। তার পরেও কংগ্রেস নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের মুখে তেমন ‘কড়া কথা’ শোনা যাচ্ছিল না। শাসকদলের একাংশের বক্তব্য, ‘ইন্ডিয়া’র কথা মাথায় রেখে শীর্ষ নেতৃত্ব খানিক নমনীয় মনোভাব নিয়েই চলছিলেন। কিন্তু বঙ্গের কংগ্রেস নেতারা যে ভাবে নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছেন, তাতে জোটের সম্ভাবনা নেই। কালীঘাটের বৈঠকে মমতাও তা কার্যত স্পষ্ট করে দিয়েছেন।
তৃণমূল সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদ জেলার দলীয় নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের বৈঠকে মমতার মত ছিল, রাজ্যে কংগ্রেসের ‘একগুঁয়ে’ মনোভাবই জোটের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় সূত্রে খবর, বৈঠকে মমতা জানিয়েছেন, গত ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের ফলের ভিত্তিতে দেখলে কংগ্রেসকে দু’টি লোকসভা আসনও দেওয়া যায় না। তবু তিনি কংগ্রেসের হাতে থাকা দু’টি লোকসভা আসন ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস ১২টি আসন চাইছে। তাদের ওই দাবি যে মানা হবে না, দলীয় বৈঠকেই তা মমতা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তৃণমূল সূত্রে খবর, বৈঠকে মমতা যুক্তি দিয়েছেন, বিধানসভায় রাজ্যে একটি আসনও জিততে পারেনি কংগ্রেস। এক জনও বিধায়ক নেই! সেই কারণে তাদের দাবি ‘অযৌক্তিক’। তার পরেই বৈঠকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তৃণমূল ‘একক ভাবে’ই লড়াই করবে। দলীয় নেতাদের সে ভাবেই সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। কিন্তু তৃণমূলের মতো কি কংগ্রেস একা লড়তে প্রস্তুত? এই প্রশ্নের জবাবে অধীর বলেন, ‘‘সব কিছুতেই প্রস্তুত। কংগ্রেস সব পারে।’’
শাসকদল সূত্রের দাবি, কালীঘাটের বৈঠকে অধীর-প্রসঙ্গও উঠেছিল। দলের এক বিধায়ক বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদের নাম করলে মমতা বলে দেন, ‘‘ও সব ভাবার দরকার নেই।’’ সূত্রের খবর, অধীরের নাম করে বৈঠকে তাঁর আরও মন্তব্য, ‘‘কোনও ফ্যাক্টর নয়! বিজেপির সমর্থনে বার বার জিতেছে। একমাত্র ওখানেই বিজেপির জামানত বাজেয়াপ্ত হয়, আর কোথাও হয় না।’’ এর প্রেক্ষিতে অধীর বলেন, ‘‘আমি লড়ে জিতেছি। আমি হারিয়ে বড় হয়েছি। আমার কাছে লড়াইটা শেষ কথা। আমি কাউকে পরোয়া করি না। কাউকে পরোয়া করে রাজনীতি করি না। এক বার না, হাজার বার বলেছি। আবার বললাম। যা করার কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছি।’’