Howrah-Mumbai CSMT Train Accident

‘বিকট শব্দ, প্রবল ঝাঁকুনি, হেলে গেল কামরা! শুরু হল হুড়োহুড়ি, কান্নাকাটি, কী ভাবে বাঁচলাম, জানি না’

এই ট্রেনে বড় সংখ্যায় ক্যানসার আক্রান্ত রোগী এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনেরা যাতায়াত করেন। আমিও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মুম্বই যাচ্ছিলাম... লিখলেন দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রী শ্যামাপ্রসাদ হালদার।

Advertisement
শ্যামাপ্রসাদ হালদার
চক্রধরপুর শেষ আপডেট: ৩০ জুলাই ২০২৪ ১০:৫৪
A resident of Hooghly who was affected by the train accident spoke about his experience

দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের কামরা। — নিজস্ব চিত্র।

ভোর তখন ৩টে ৩৫। প্রায় সকলেই ঘুমে আচ্ছন্ন। আমিও ঘুমোচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী শৌচালয়ে গিয়েছিল। তখন বিকট শব্দ এবং প্রবল ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ছুটে গেল। বুঝতে পারলাম দুর্ঘটনার কবলে পড়েছি। আমাদের কোচ হেলে পড়ল পাশের লাইনের উপর!

Advertisement

দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেনের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। কান্নাকাটি শুরু করেন অনেক যাত্রী। বাচ্চা-মহিলাদের নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন অনেকেই। সকলেই প্রাণ বাঁচাতে ট্রেন থেকে নামতে শুরু করেন। পরিজনদের বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সাময়িক ঝটকা কাটিয়ে আমিও স্ত্রী অঞ্জনার খোঁজ শুরু করলাম। দেখি কামরার এক কোনায় ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। তাকে সঙ্গে করে নেমে পড়লাম লাইনের উপর। চোখের সামনে এই প্রথম কোনও বড় রেল দুর্ঘটনা দেখলাম। এই প্রথম কোনও দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী থাকলাম। সকলের চোখেমুখেই আতঙ্ক। শুধুই কান্না, চিৎকার, আর্তনাদের শব্দ চারপাশে।

সস্ত্রীক শ্যামাপ্রসাদ হালদার।

সস্ত্রীক শ্যামাপ্রসাদ হালদার। — নিজস্ব চিত্র।

হুড়মুড়িয়ে ট্রেন থেকে নামার সময় দেখলাম এক যাত্রীর পা কামরার দরজার পাল্লায় আটকে গিয়েছে। চিৎকার করে কাঁদছেন তিনি। রেলকর্মীরা ছুটে এসে তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করলেন। অনেক চেষ্টার পর তাঁকে বাইরে বার করে আনা হল। দেখলাম তাঁর পা দিয়ে গলগল করে রক্ত বার হচ্ছে। ওই যাত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন স্থানীয়েরাই।

বাইরে তখনও ভোরের আলো তেমন ফোটেনি। চাপা অন্ধকারে কাউকে দেখে চেনা মুশকিল। আমরা সকলেই বলাবলি শুরু করেছি কী ঘটেছে। তখনও বুঝতে পারছিলাম না কী ঘটেছে। সকলের মনে অনেক প্রশ্নই ঘুরছে। কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল? এর পর কী হবে? এই সব প্রশ্নের উত্তর হাতড়াচ্ছিলাম আমরা। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটল। পুরো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠল। দেখি চারপাশে সকলে হাহাকার করছেন। ছুটোছুটি করছেন। থিকথিক করছে পুলিশ, রেলকর্মীদের ভিড়। উদ্ধারকারী দলও এসেছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে উদ্ধারকাজ চলছে। উল্টে পড়া কামরাগুলি থেকে যাত্রীদের বার করে আনা হচ্ছে। আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন রেলকর্মীরা। স্থানীয়েরাও হাত লাগিয়েছেন উদ্ধারকাজে। কানে আসছে অ্যাম্বুল্যান্সের হুটারের শব্দ।

পাশে দেখি আমার স্ত্রী অঝোরে কেঁদেই চলেছে। ফোনে যেন কার সঙ্গে কথা বলছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আমার দাদা রামপ্রসাদ হালদারকে ফোন করেছে। আমি ফোনে জানালাম দুর্ঘটনার কথা। আমরা বি-২ কামরাতে ছিলাম। অল্পের জন্য বড়সড় বিপদ থেকে বেঁচে গিয়েছি। পর পর রেল দুর্ঘটনার ঘটনায় ট্রেনে সফর করাই এখন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ট্রেনে অনেকেই ক্যানসার আক্রান্ত রোগী এবং তাঁদের পরিবার- পরিজন। এ ছাড়া পরিযায়ী শ্রমিকেরাও যাত্রা করেন এই ট্রেনে। আমিও স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য মুম্বই যাচ্ছিলাম।

দুর্ঘটনার অনেক ক্ষণ পর আমাদের স্পেশ্যাল ট্রেনে চাপিয়ে চক্রধরপুর পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়া হল। তার পর সেখান থেকে কী বিকল্প পথ নেওয়া হবে, তা এখনও জানা নেই। কী ভাবে দুর্ঘটনা ঘটল, এখনও স্পষ্ট নয়। তবে যা শুনলাম তা হল, আমাদের এক্সপ্রেস যে লাইনে যাচ্ছিল তার পাশের লাইনেই একটা মালগাড়ি ছিল। আমাদের ট্রেন ১০০-১১০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিতে ছুটছিল। সে সময় পাশের ওই মালগাড়ি থেকে একটা বড় প্লাস্টিক উড়ে এসে আমাদের ট্রেনের ইঞ্জিনের সামনে আটকে যায়। আমাদের ট্রেনের চালক সামনের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। তাতেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে পুরো ঘটনা তদন্তের পরই বোঝা যাবে।

আমরা এখনও জানি না কী ভাবে বাড়ি ফিরব। হুগলির খামারগাছিতে বাড়ির লোক চিন্তা করছেন। বার বার ফোন করে খবর নিচ্ছেন। যে দিকে আমাদের কামরা হেলে ছিল, সে দিকে নতুন লাইনের কাজ চলছিল। আর তার পাশেই ছিল ৩০-৪০ ফুটের গভীর খাদ। যদি লাইনের কাজ না হত আমরা সকলে গিয়ে পড়তাম সেই খাদে। চোখ বন্ধ করলে এখনও আমার চোখের সামনে ভাসছে দুর্ঘটনার ছবি। কানের কাছে শুনতে পাচ্ছি আর্তনাদ।

আরও পড়ুন
Advertisement