WB Tab Scam

ট্যাব পেয়ে পড়ায় লাভ কতটা, প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে

বেশিরভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, করোনা পরিস্থিতিতে স্মার্টফোনের যে প্রয়োজন ছিল, স্বাভাভিক স্কুল চালু হওয়ায় তার দরকার পড়ে না।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:৩৫
এক ছাত্রীর হাতে ট্যাব।

এক ছাত্রীর হাতে ট্যাব। নিজস্ব চিত্র।

করোনা পর্বে বোঝা গিয়েছিল অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার গুরুত্ব। সে সময়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু পড়ুয়াই স্মার্টফোনের অভাবে এই ধরনের ক্লাসে যুক্ত হতে পারেনি। প্রযুক্তি ও পড়াশোনাকে এক সুতোয় বাঁধতে সরকারের তরফে ২০২২ সালে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য চালু হয় তরুণের স্বপ্ন প্রকল্প। গত দু’বছর ধরে ছেলেমেয়েরা ট্যাব/ স্মার্টফোন কেনার জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ট্যাবের প্রসঙ্গ ইদানীং ফের নজরে এসেছে পড়ুয়াদের টাকা নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি সামনে আসায়। পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে টাকা না ঢুকে তা চলে গিয়েছে অন্য অনেক অ্যাকাউন্টে। প্রতারণার নতুন নজির সৃষ্টি হয়েছে।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে নতুন করে প্রশ্ন উঠছে, ট্যাবের উপযোগিতা নিয়েও। প্রশ্ন উঠছে, পড়াশোনার মান কি ট্যাব ব্যবহারের ফলে বেড়েছে? বেশিরভাগ স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, করোনা পরিস্থিতিতে স্মার্টফোনের যে প্রয়োজন ছিল, স্বাভাভিক স্কুল চালু হওয়ায় তার দরকার পড়ে না। উল্টে, ট্যাব হাতে পেয়ে আখেরে ক্ষতিই হচ্ছে কিশোর-কিশোরীদের। পড়াশোনার কাজে ফোন ব্যবহার করে খুব কম পড়ুয়ারাই। বরং গেম খেলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে অনেকে।

মৌসুনি বালিয়াড়া কিশোর হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরিন্দম মাইতি বলেন, ‘‘লকডাউনে অনলাইনে ক্লাসে হওয়ায় মোবাইলের দরকার ছিল। বর্তমানে সে প্রয়োজন নেই। এখন ছুটি থাকলে শিক্ষকেরা বিভিন্ন বিষয়ের নোটস গ্রুপে দেন। স্কুলে ছেলেমেয়েদের মোবাইল নিয়ে আসতে দেওয়া হয় না।’’

সাগরে ধবলাট লক্ষ্মণ পরবেশ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক শান্তনু গায়েন বলেন, ‘‘আমাদের স্কুলে পড়ুয়াদের মধ্যে ৫ শতাংশ ছেলেমেয়ে মোবাইলের পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করে। কারণ, ওদের বাড়ির অভিভাবকেরা সচেতন। কিন্তু অধিকাংশ ছেলেমেয়ে মোবাইল হাতে পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, রিল বানিয়েই সময় কাটাচ্ছে। পড়াশোনার মানও কমছে।’’

শ্রীধাম গঙ্গাসাগর স্বামী কপিলানন্দ বিদ্যাভবন হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিনয় মণ্ডল বলেন, ‘‘এখন তো অনলাইনে ক্লাস হয় না। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে একটি গ্রুপ করা হয়েছে। তাতে স্কুলের কিছু তথ্য দেওয়া হয়।’’

মথুরাপুর কৃষ্ণচন্দ্রপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক চন্দন মাইতির অভিজ্ঞতায়, ‘‘ট্যাবের টাকায় ছাত্রছাত্রীদের খুব বেশি উপকার হয় না। বরং ওই টাকায় স্কুলে ভাল কম্পিউটার ল্যাব বা পরিকাঠামোর উন্নয়ন করলে সকলে উপকৃত হত।’’

সন্দেশখালি থানার আতাপুর কেনারাম হাই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক সৌমেন রায় আবার জানাচ্ছেন, লকডাউনের সময়ে ট্যাব বা স্মার্টফোন খুব প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এখন পড়ুয়ারা ফোন নিয়ে অপব্যবহার বেশি করে। স্কুলে ফোন নিয়ে আসা কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। ফলে সমস্যা হচ্ছে।’’

প্রায় একই পরিস্থিতির কথা শোনা গেল হিঙ্গলগঞ্জের যোগেশগঞ্জ হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিখিলচন্দ্র মণ্ডলের কাছে। বললেন, ‘‘গ্রামের রাস্তা ধরে বাড়ি ফেরার পথে দেখি, আমারই অনেক ছাত্র ফোন নিয়ে রাস্তার পাশে বসে গেম খেলতে মত্ত। স্কুলে ফোন আনা নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে শাস্তি ২০০ টাকা জরিমানা বা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে রচনা লিখে আনার কথা বলা হয়।’’ মাস্টারমশাইয়ের আক্ষেপ, ‘‘যারা ধরা পড়ে, তারা সবাই জরিমানা দেয়, রচনা কেউ লেখে না!’’

বেশিরভাগ অভিভাবকেরাও শিক্ষকদের সঙ্গে এ বিষয়ে একমত। অনেক গরিব পরিবার আবার প্রতি মাসে রিচার্জের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এ দিকে, একবার মোবাইল-ট্যাবের অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়ের বায়না শুনে রিচার্জ করতেই হচ্ছে।

কাকদ্বীপ ব্লকের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের বাবা মঙ্গল দাস বলেন, ‘‘হাতে ফোন পেয়ে ছেলে মোবাইলের প্রতি বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে। দিনরাত গেম খেলছে। বকাবকি করলে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। পরীক্ষার রেজ়াল্টও দিন দিন খারাপ হচ্ছে।’’ ওই ব্লকের আর এক ছাত্রের অভিভাবক বলেন, ‘‘প্রতি মাসে রিচার্জের টাকা দিতে খুব সমস্যা হয়। না দিতে পারলেই অশান্তি।’’

পাথরপ্রতিমার দ্বাদশ শ্রেণির এক স্কুল ছাত্রীর বাবা দিবাকর জানা বলেন, ‘‘মেয়ে মোবাইল পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশি সময় দিচ্ছে। পড়াশোনা কী হচ্ছে জানি না। উল্টে, প্রতি মাসে রিচার্জের টাকা দিতে সংসার খরচে টান পড়ছে।’’

বিষয়টি নিয়ে সরব হয়েছে বিরোধীরা রাজনৈতিক শিবির। সন্দেশখালির বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহের ব্যাখ্যা, ‘‘এ সব টাকা দিয়ে ভোট কেনার প্রকল্প। পড়াশোনার মানের উন্নতি কিছুই হচ্ছে না। এর থেকে যদি শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নয়ন হলে শিক্ষার মান বাড়ত।’’ মথুরাপুর সাংগঠনিক জেলার বিজেপি নেতা অরুণাভ দাস বলেন, ‘‘কোভিডের সময়ে মোবাইলের উপকারিতা থাকলেও এখন আর নেই। উল্টে, ছেলেমেয়েরা মোবাইল পেয়ে পড়াশোনা থেকে সরে যাচ্ছে। অনলাইন গেমে বেশি আসক্ত হচ্ছে।’’

পশ্চিম তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির রাজ্যের কার্যকরী সভাপতি শিক্ষক প্রীতমকুমার হালদারের অবশ্য যুক্তি, ‘‘কোভিডের সময়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিশেষ করে গ্রামবাংলার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মানোন্নয়নের জন্য তরুণের স্বপ্ন প্রকল্প চালু করেছিলেন। তাতে লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রী লকডাউনের সময়ে বাড়িতে বসে পড়াশোনা করে উপকৃত হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।’’ বসিরহাট সাংগঠনিক জেলা তৃণমূলের মাধ্যমিক শিক্ষা সেলের সহ সভাপতি সাহারিয়া ইসলাম বলেন, ‘‘এখন প্রযুক্তির যুগ, তাই ট্যাব দেওয়া যুক্তিযুক্ত। মা-বাবারাও তাই ফোন কিনে দিচ্ছেন ছেলেমেয়েদের। তা হলে অভিভাবকেরাও কি ক্ষতি করছেন ফোন কিনে দিয়ে?’’ তাঁর কথায়, ‘‘আসলে মমতা সরকারের ভাল কাজ দেখে হিংসা হচ্ছে বিরোধীদের। তাই এ সব বলছে।!’’

তথ্য সহায়তা: সমরেশ মণ্ডল, নবেন্দু ঘোষ, দিলীপ নস্কর

আরও পড়ুন
Advertisement