হাড়োয়ার একটি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ভোটারদের লাইন - রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কড়া নজরদারিতে চলছে ভোট
বড়সড় অশান্তি ছাড়াই মিটল হাড়োয়া উপনির্বাচন। যদিও ‘নীরব সন্ত্রাসের’ অভিযোগ তুলছেন বিরোধীরা। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি অনেক বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি। স্থানীয় বাসিন্দাদেরও অনেকেও একই অভিযোগ তুলছেন শাসক দলের বিরদ্ধে। সে কথা মানেনি তৃণমূল। তাদের বক্তব্য এলাকায় সংগঠন না থাকায় অনেক জায়গায় এজেন্ট দিতে পারেনি বিরোধীরা।
হাড়োয়া থানা এলাকায় বুথের সংখ্যা ৮৭টি। অভিযোগ, অনেক বুথে বিরোধী এজেন্ট ছিল না। এ দিন সকালে হাসনাবাদ-শিয়ালদহ লোকালে করে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন হাড়োয়ার বেশ কিছু মানুষ। ভোট দেবেন না? তাঁরা জানালেন, মঙ্গলবার বাড়িতে গিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে, কেউ যেন ভোট দিতে না যান। ‘ভোট হয়ে যাবে’ বলা হয়। এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘এই পরিস্থিতিতে আর বুথমুখো হইনি। বরং কাজে গেলে দিনের রোজগারটুকু হবে।’’
বুধবার হাড়োয়া থানা এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, সর্বত্র তৃণমূলের পতাকা লাগানো। সেই তুলনায় বিরোধীদের পতাকা খুবই কম চোখে পড়ল। ভোটগ্রহণ কেন্দ্রগুলির বাইরে রাজনৈতিক দলগুলির শিবির থাকে। বেশিরভাগ জায়গায় বিরোধীদের শিবির ছিল না। সেখানেও তৃণমূলের একচেটিয়া আধিপত্য। অভিযোগ, পর্যাপ্ত কেন্দ্রীয় বাহিনী এবং রাজ্য পুলিশ বুথে থাকলেও তারা সদর্থক ভূমিকা নেয়নি।
দীর্ঘ দিন ধরে হাড়োয়া তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি। গত লোকসভা ভোটে ১ লক্ষের বেশি ভোটে এগিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী। গোপালপুর, খাসবালান্দা, হাড়োয়া সহ বিভিন্ন এলাকায় সকালের দিকে বুথে বিরোধীদের এজেন্ট ছিল। বেলা যত গড়িয়েছে, বুথ থেকে বিরোধী এজেন্টরা বেরিয়ে গিয়েছেন। অভিযোগ, তাঁদের ভয় দেখিয়ে বুথ-ছাড়া করা হয়েছে। এক এজেন্টের কথায়, ‘‘জোর করে বুথে থাকলে আমার মেছো ভেড়িতে হয় তো বিষ দিয়ে দেওয়া হবে!’’
গোপালপুর পপুলার অ্যাকাডেমি স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, কেন্দ্রীয় বাহিনীর সামনেই এক দল যুবক লোকজনকে ভোট দিতে বার বার সঙ্গে করে বুথে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কেউ বাধা দিচ্ছে না।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি (গ্রামীণ) অমিত মজুমদার বলেন, ‘‘হাড়োয়া থানা এলাকায় আমরা ৮০ জন এজেন্ট দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত বুথে থাকতে পেরেছেন ২২ জন। মঙ্গলবার রাত থেকে তৃণমূলের পক্ষ থেকে তাঁদের ভয় দেখানো হয়েছে। এখানে নীরব সন্ত্রাস চালানো হয়েছে শাসক দলের পক্ষে।’’ বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্য তাপস মিত্রের কথায়, ‘‘শাসক দলের নীরব সন্ত্রাসের ফলে ২৭৯টি বুথ এজেন্টের মধ্যে বিকেল পর্যন্ত ৫১ জন এজেন্ট বুথে থাকতে পেরেছেন।’’ আইএসএফের জেলা সভাপতি তাপস বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, ২৭৯টি বুথের মধ্যে তাঁরা এজেন্ট দিয়েছিলেন ২০৫টি বুথে। তৃণমূল মেরেধরে, ভয় দেখিয়ে বের করে দিয়েছে অনেককে। বিকেল পর্যন্ত এজেন্ট ছিলেন ১১০ জন। পুলিশ সহযোগিতা করেনি বলে তাঁর অভিযোগ। ৩৭টি ফের ভোটগ্রহণের আবেদন করেছে আইএসএফ।
বিরোধীদের অভিযোগ উড়িয়ে তৃণমূল প্রার্থী শেখ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘‘এখানে আইএসএফ, বিজেপি, কংগ্রেস বলে কিছু নেই। ওরা এজেন্ট খুঁজে পায়নি, তাই মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে তৃণমূলের নামে।’’
এ দিন সকালে বিজেপির পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, স্থানীয় সদরপুর হাইস্কুলের বুথে ঘরের মধ্যে ইভিএম দরজার কাছে এমন ভাবে রাখা হয়েছে, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে মানুষ কাকে ভোট দিচ্ছেন। এমনকী, কে কাকে ভোট দিচ্ছেন, তার ভিডিয়ো করা হচ্ছিল। বিজেপি প্রার্থী বিমল দাস বুথে গিয়ে প্রতিবাদ করলে তৃণমূলের লোকজনের সঙ্গে তাঁর বচসা বাধে। উত্তেজনা ছড়ায়। বিমল বলেন, ‘‘যে কোনও ভোটেই ওই বুথে ইভিএম এমন জায়গায় রাখা হয় যে বাইরে থেকে দেখা যায়। তৃণমূলের লোকজন ভিডিয়ো তুলে রেখে ভোটারদের পরবর্তী সময়ে ভয়ভীতি দেখায়। ঘাসফুল ছাড়া অন্য কাউকে ভোট দিলে বাড়িঘর ভাঙচুর করে। এ দিনও একই ঘটনা ঘটায় আমি প্রতিবাদ করতে গেলে ওরা তেড়ে আসে। কেন্দ্রীয় বাহিনীর কাছে অভিযোগ করি। পরে ইভিএম কিছুটা সরানো হয়েছিল।’’ যদিও প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, নিয়ম মেনেই ইভিএম বসানো হয়েছিল। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, নিশ্চিত পরাজয় বুঝে বিজেপি মিথ্যা অভিযোগ করছে।
হাড়োয়ায় তাদের এক পোলিং এজেন্টকে ভোটের আগের রাতে অপহরণ করা হয়েছে বলে দাবি করে রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন আইএসএফ প্রার্থী পিয়ারুল ইসলাম। তাঁর দাবি, উত্তর ফলতি মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের ৪৭ নম্বর বুথের জন্য তাদের পোলিং এজেন্ট ঠিক করা হয়েছিল জাকির হোসেন সাহাজিকে। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে ৫০-৬০ জনের দল এসে তাঁর উত্তরপাড়ার বাড়ি থেকে তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। জাকিরকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয় বলেও অভিযোগ। তৃণমূলের স্থানীয় নেতা নজরুল সাহাজি, কায়ুম সর্দার, বাবু, জুলফিকার মোল্লারাই অপহরণ ও নিগ্রহ করে বলে অভিযোগ তাঁর। তাদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। ভোটের দিন ১৭৯ নম্বর বুথের আইএসএফের পোলিং এজেন্টকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল। তৃণমূলের তরফে কমিশনে চিঠি দিয়ে হাড়োয়া বিধানসভা এলাকায় শান্তিপূর্ণ ভোট প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে বামফ্রন্ট সমর্থিত আইএসএফ প্রার্থীর বিরুদ্ধে। কমিশনের কাছে তৃণমূলের অভিযোগ, আইএসএফ প্রার্থী ‘গুণ্ডা’ নিয়ে বেআইনি ভাবে বুথে বুথে ঘুরছেন।
মানিকপুর এলাকার কাঁকড়া-মির্জানগর রেলগেট সংলগ্ন এলাকায় আইএসএফের এক পোলিং এজেন্ট বুথের বাইরে এসেছিলেন চা খেতে। অভিযোগ, বুথে ঢুকতে গেলে তৃণমূলের লোকজন তাঁকে মারধর করে। প্রতিবেশী কিছু লোক ছুটে এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। তৃণমূল মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
এ দিন হাড়োয়া থানা এলাকায় ভোটের দায়িত্বে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বসিরহাট জ়োনাল) দুর্বার বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলিশ জানিয়েছে, ৩০টি কুইক রেসপন্স টিম ছিল। ৬ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে রাজ্য পুলিশ ছিল। বহিরাগতদের ঠেকাতে চেকপোস্ট করে নাকা তল্লাশি চলেছে। কোনও অশান্তির খবর নেই।