Rumour about Kidnappers

থানায় অভিযোগ নেই, তবে কি সমাজমাধ্যমের গুজবেই অস্থিরতা

দীর্ঘদিন ধরে শিশু ও নারী পাচার নিয়ে উত্তর শহরতলিতে কাজ করছেন রাজ্য প্রশাসনের আধিকারিক অন্বেষা চক্রবর্তী।

Advertisement
বিতান ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০২৪ ০৮:৪৯
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে ‘ছেলেধরা’র খবর। হাওয়া বইছে শহরতলির নানা প্রান্তে। মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে ছেলেধরা গুজবে প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।

Advertisement

বারাসতের কাজীপাড়া, ব্যারাকপুর, বনগাঁ, অশোকনগর, গাইঘাটা, দেগঙ্গা। এক সপ্তাহের মধ্যেই একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে আরেকটি ঘটনা। জনরোষের শিকার হচ্ছেন ভবঘুরে থেকে মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলা, যাঁরা অনেকেই এলাকায় পরিচিত মুখ নন— শুধু এটুকুই কারণ? তবে শুক্রবার ব্যারাকপুর কমিশনারেটের মোহনপুরের ভেড়ির গেটে ইদের মেলায় নিগৃহীত নাজির হোসেন কিন্তু খড়দহের রুইয়ার বাসিন্দা। নেহাতই রাস্তার এপার-ওপার। পরিচিত মুখ। নাজিরের কথায়, ‘‘মাটিতে ফেলে যখন এলোপাথাড়ি মারছে, ওরা স্থানীয় বলেই আমিও এলাকার বাসিন্দা বলতে চেয়েছি বার বার। কেউ শুনল না।’’ মোহনপুরের বাসিন্দা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত, দুঃস্থ, পিছিয়ে পড়া মানুষদের নিয়ে কাজ করেন শেখ আবদুস সালাম। তাঁর কথায়, ‘‘খবরেই জানলাম, মেলায় মহিলার সঙ্গে বচসা ঘিরে নাজিরের সঙ্গে গোলমাল। কিন্তু ছেলেধরা অপবাদ জুটত না, যদি না ওই মহিলার সঙ্গের শিশুটি কান্নাকাটি না করত। এই ভুল বোঝা বা বোঝানো সব ঘটনায় এক।’’

জেলা জুড়ে পর পর এমন ঘটনায় প্রশ্ন উঠছে, পুলিশ প্রশাসনের মাইকিং, লিফলেট বিলি, সচেতনতা শিবিরের পরেও বিভিন্ন জায়গায় স্ফুলিঙ্গের মতো ‘ছেলেধরা’র গুজব ও তাকে ঘিরে মারধরের ঘটনা কেন বাড়ছে? শিশু পাচার নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করা ব্যারাকপুর কমিশনারেটের আধিকারিকেরা মূলত দায়ী করছেন সমাজমাধ্যমকেই। শুক্রবারের ঘটনাতেও প্রশান্ত দাস নামে এক ব্যক্তিকে মারধরের ছবি-সহ এই ঘটনায় উল্লাস প্রকাশ করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করতে দেখা গিয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, গত কয়েক দিনে অন্তত সাতটি নাবালিকার ছবি দিয়ে নিখোঁজের পোস্ট দেখা গিয়েছে সমাজমাধ্যমে। অথচ পুলিশের কাছে সেই বিষয়ে একটিও নিখোঁজের ডায়েরি হয়নি!

দীর্ঘদিন ধরে শিশু ও নারী পাচার নিয়ে উত্তর শহরতলিতে কাজ করছেন রাজ্য প্রশাসনের আধিকারিক অন্বেষা চক্রবর্তী। তাঁর অভিমত, ‘‘ছেলেধরা গুজবে এই যে মারধর করা ও তার পক্ষে প্রচারের গোটাটাই দমকা হাওয়ার মতো ছড়াচ্ছে মূলত সমাজমাধ্যমের দৌলতে। সত্য না জেনেই বহু মানুষ বিভিন্ন রকম পোস্ট করছেন শুধু শুনেই। অসুস্থ, অসহায় মানুষদের অধিকাংশ বিভ্রান্তির শিকার হয়ে নিগৃহীত হচ্ছেন, এলাকা অশান্ত হচ্ছে। সেটা থেকেও নতুন গুজব ছড়াচ্ছে। আসল ‘ছেলেধরা’ যখন শিশু পাচার করবে, তখন কেউ হয়তো জানতেই পারবেন না। মানুষকেই এটা বুঝতে হবে।’’

ব্যারাকপুরের যে এলাকায় শুক্রবার মারধরের ঘটনা ঘটল, সেখানকার বাসিন্দা তাপস দাস বলেন, ‘‘শেষ দিনের মেলায় ভিড় বেশি ছিল না। ঘটনার সময়ে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম। হঠাৎ ছেলেধরা বলে চিৎকার করল কয়েক জন, তার পরেই একটি ছেলেকে হিঁচড়ে মাটিতে ফেলে মারতে শুরু করল কয়েক জন। যারা মারল, তারাও হয়তো জানে না কে, কার বাচ্চাকে চুরি করছিল বা আদৌ করছিল কি না। প্রতিবাদ যে করব, শোনার মতোও কেউ ছিল না।’’

কিছু দিন আগে নিজের সঙ্গেই ঘটা একটি ঘটনা জানালেন পাতুলিয়ার বাসিন্দা রাজীব বিশ্বাস। দীর্ঘদিন নেশামুক্তি কেন্দ্রে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন মে মাসে। টিটাগড়ে ইদের মেলায় গিয়ে একটি তিন বছরের শিশুকে একা ঘুরতে দেখে তার সঙ্গে কথা বলে পরিজনেদের বিষয়ে জানার চেষ্টা করার সময়ই কয়েক জন তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন শুরু করেন। রাজীব বলেন, ‘‘মেলায় দুই দোকানি ও এক সিভিক ভলান্টিয়ার পরিচিত হওয়ায় সে যাত্রায় মারের হাত থেকে বেঁচেছি। আমার নিজেরও দু’বছরের একটি ছেলে আছে। ভয় হওয়া হয়তো অন্যায় নয়। কিন্তু মারার আগে এক বার খতিয়ে দেখা উচিত।’’ অনেকেই বলছেন, ‘ছেলেধরা’ এলাকায় রয়েছে, এটা এখন হাওয়ায় ভাসছে। সমাজমাধ্যমেই পাল্টা জবাব দিতে হবে সকলকে, সন্দেহ হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানোর কথা বলতে হবে।

ব্যারাকপুরের নগরপাল অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘এই সবের পিছনে অন্য কারণ আছে কি না, দেখা হচ্ছে। মানুষকে আমরা বার বার বোঝাচ্ছি, গুজবে কান না দিয়ে সন্দেহ হলে পুলিশকে জানান। সমাজমাধ্যমে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement