অটো-রাজের শিকার বৃদ্ধ, প্রতিবাদে স্তব্ধ পরিষেবা

বেপরোয়া অটোর ধাক্কায় প্রাণ গেল এক বৃদ্ধের। বুধবার, গড়িয়ার রামগড়ে। এবং অটোর লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে এ বার পথে নামলেন সাধারণ মানুষ। অফিসের ব্যস্ত সময়ে তিন ঘণ্টা বন্ধ করে দিলেন অটো চলাচল।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৪ ২১:৪২

বেপরোয়া অটোর ধাক্কায় প্রাণ গেল এক বৃদ্ধের। বুধবার, গড়িয়ার রামগড়ে। এবং অটোর লাগামছাড়া দৌরাত্ম্য সত্ত্বেও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে এ বার পথে নামলেন সাধারণ মানুষ। অফিসের ব্যস্ত সময়ে তিন ঘণ্টা বন্ধ করে দিলেন অটো চলাচল।

পুলিশ জানিয়েছে, মঙ্গলবার রাতে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলেন পাটুলি থানার রামগড় এলাকার বাসিন্দা ৬৯ বছরের অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার আশুতোষ সেনগুপ্ত। আচমকা পিছন থেকে একটি অটো এসে তাঁকে ধাক্কা মারে। মুখ থুবড়ে পড়ে যান বৃদ্ধ। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এ দিন সকালে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশের দাবি, মত্ত অবস্থায় অটো চালাচ্ছিল অঞ্জন রায় ওরফে নাঙ্কি নামে বছর ছাব্বিশের এক যুবক। তাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

Advertisement

আশুতোষবাবুর মৃত্যুর খবর পৌঁছতেই প্রশাসনের উপর ভরসা না রেখে সকাল সাড়ে ন’টা থেকে এস সি মল্লিক রোডে গড়িয়া-গোলপার্ক রুটের অটো চলাচল বন্ধ করে দেন এলাকার মানুষ। বাসিন্দাদের অভিযোগ, নিত্যদিন অটোচালকদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পথের দখল নিয়ে যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে অটোচালকেরা। এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, “গড়িয়াহাট পর্যন্ত যাওয়ার কথা থাকলেও কখনও যাত্রীকে যাদবপুরে নামিয়ে দিচ্ছে। ভাড়া দেওয়ার সময়ে খুচরো না পেলে অশ্লীল কথা বলতে দ্বিধা করছে না। কখনও রক্তচক্ষু দেখিয়ে যাত্রীকে গাড়ি থেকে নামিয়েও দিচ্ছে। খুশিমতো আইন ভাঙছে তারা। একটা করে দিন যাচ্ছে আর অটোওয়ালাদের দাপট বেড়েই চলেছে। পুলিশ সব জানে। তবু না দেখার ভান করে থাকছে! এই অসহায় পরিস্থিতিতে রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।”

ব্যস্ত রাস্তায় টানা তিন ঘণ্টা অবরোধ চলায় অফিস টাইমের নিত্যযাত্রী ও স্কুল-কলেজ পড়ুয়ারা রীতিমতো অসুবিধায় পড়ে যান। অনেকে হাঁটা শুরু করেন। ট্যাক্সি অথবা প্রাইভেট গাড়ি ধরে অনেকে বেরিয়ে যান। শেষে পুলিশ ও তৃণমূল ইউনিয়নের হস্তক্ষেপে অবরোধ ওঠে। ওই রুটে তৃণমূলের আইএনটিটিইউসি অটো ইউনিয়নের নেতা দেবরাজ ঘোষ জানান, এলাকার বাসিন্দাদের দাবি মেনে ওই চালককে তাঁদের ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাকে তুলে দেওয়া হয়েছে পুলিশের হাতে। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি গড়িয়া থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত মোট দশটি ওয়ার্ডের মানুষদের নিয়ে এক কনভেনশন হবে। সেখানে অটো-সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।

অটোর সর্বগ্রাসী দাপটের কাছে কার্যত নতিস্বীকার করলেও মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে যাত্রী নিগ্রহ থেকে মৃত্যুর ঘটনা চিন্তায় ফেলে দিয়েছে প্রশাসনকেও। গত বুধবার তারাতলায় খুচরো দিতে না পারায় এক মহিলা যাত্রীর উপর চড়াও হয় অটোচালক। পল্লবী চট্টোপাধ্যায় নামে ওই মহিলার গালে ও নাকে ঘুষি পড়ে। পরের ঘটনা মঙ্গলবারের। বেকবাগানে অল্প দূরত্বের জন্য অনেক বেশি ভাড়া চাওয়ার প্রতিবাদ করেছিলেন এক তরুণী ও তাঁর সঙ্গী। এ জন্য তরুণীকে রড মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয় অটোচালক। তাঁর সঙ্গীকেও মারধর করা হয়। তার রেশ না মেলাতেই রামগড়ে এই ঘটনা।

এ দিনের ঘটনার পরেও ওই এলাকার তৃণমূল নেতা বিভু নন্দী দাবি করেন, “এ সবই সরকারকে কালিমালিপ্ত করার জন্য সিপিএমের চক্রান্ত।” কিন্তু ধাক্কা দেওয়া অটোর মালিক তো তৃণমূল ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত। এই রুটের ইউনিয়নও চালায় তৃণমূল। তা হলে সিপিএম কোথা থেকে এল? উত্তরে নীরব থেকেছেন বিভুবাবু। তবে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র রাজ্য সভানেত্রী দোলা সেনের সাফাই, “তিন দিনের ঘটনাতেই অভিযুক্ত অটোচালকদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তিনটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট অটোচালকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু যে ভাবে পরপর ঘটনাগুলি ঘটেছে, তাতে এর মধ্যে অন্তর্ঘাতের গন্ধ পাচ্ছি। বিস্তারিত তদন্ত হলেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে।”

পুলিশ তৎপর বলে দোলাদেবী দাবি করলেও অটোকে শিক্ষা দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার গত দেড় বছরে একের পর এক কমিটি গড়েছে। অটোর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। মঙ্গলবার অটোচালকদের হুমকি দিয়ে পরিবহণমন্ত্রী বলেছিলেন, “২৬ জানুয়ারির মধ্যে নিজেদের শুধরে নিন। না হলে ধরপাকড় শুরু করব।” এ দিন মন্ত্রী বলেন, “যা অবস্থা, তাতে ২৬ তারিখ অবধি আর সময় দেওয়া যাবে না। অটোচালকেরা শোধরাবে না। ২৫ তারিখ আমি লালবাজারে যাব। পুলিশকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে কী ভাবে অটোকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, তার রূপরেখা ঠিক করব।”

কিন্তু এ সবে অটো মালিকদের ভ্রুক্ষেপ নেই! যাত্রীর মতো ইউনিয়নের নেতাদের ফতোয়াও তারা মানছে না। গ্যাসের ভাড়া বৃদ্ধি সত্ত্বেও কোনও রুটে অটোর ভাড়া বাড়বে না বলে জানিয়েছিলেন ইউনিয়নের শীর্ষনেতারা। তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিভিন্ন রুটে ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়ে নিয়েছে অটো। সাদা কাগজে বর্ধিত ভাড়ার চার্টও ছাপিয়ে বিলি করছেন তৃণমূল ইউনিয়নের অটোচালক সদস্যরা। যেমন, গড়িয়া-গোলপার্ক রুটের ভাড়া ১৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৫ টাকা করা হয়েছে। ভাড়া বেড়েছে গোলপার্ক-গড়িয়া স্টেশন রুটেরও। দোলা সেনের অবশ্য দাবি, “ভাড়ার চার্ট-এর সঙ্গে আইএনটিটিইউসি-র কোনও যোগাযোগ নেই। এ রকম কোনও নির্দেশ আমাদের নেই। সিটু করলেও করতে পারে।” দেবরাজবাবুরও বক্তব্য, “আমরা ভাড়া বাড়াইনি। কারা বাড়িয়েছে, আমরা তা খোঁজ করছি।” অভিযোগ উড়িয়ে সিটুর অটো ইউনিয়নের নেতা বাবুন ঘোষের দাবি, “ওরা তো সব কিছুতেই চক্রান্তের গন্ধ পান।” ভাড়া বাড়ানো নিয়ে বাবুনবাবুর দাবি, “ওই ইউনিয়ন আইএনটিটিইউসি-র দখলে। ওরা না বাড়ালে বেশি ভাড়া নিচ্ছে কেন?”

Advertisement
আরও পড়ুন