ক্লাস শুরুর আগে প্রার্থনা। নিজস্ব চিত্র ।
বরাদ্দ ও পরিকাঠামোর অভাবে মিড-ডে মিল নিয়ে নানা অভিযোগ শোনা যায় বহু স্কুলে। সেখানে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম প্রত্যন্ত সুন্দরবনের চুনাখালি হাটখোলা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। বহু স্কুলে যখন মিড-ডে মিলের খাবার ও পড়ুয়াদের পুষ্টি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, তখন নিজেদের চেষ্টায় প্রায় প্রতি দিনই নানা ধরনের পুষ্টিকর খাবার পড়ুয়াদের পাতে তুলে দিচ্ছেন এই স্কুল কর্তৃপক্ষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, বাসন্তী দক্ষিণ চক্রের ওই প্রাথমিক বিদ্যালয় শুধু সরকারি প্রাথমিক স্কুলকে নয়, আধুনিকতা ও পঠনপাঠনে আর পাঁচটা বেসরকারি স্কুলের সঙ্গেও পাল্লা দিতে পারে। প্রতি দিন পড়ুয়াদের পুষ্টির জন্য ফল, ছোলা যেমন দেওয়া হয়, তেমনই মিড-ডে মিলে সয়াবিন, ডিম, মাছ, মাংসও তুলে দেওয়া হয় তাদের পাতে। সপ্তাহে একদিন ঘি-ভাত খাওয়ানোর ব্যবস্থাও স্কুলের তরফ থেকে করা হয়েছে।
অভিভাবকেরা জানাচ্ছেন, এ সবই সম্ভব হয়েছে স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিমাই মালির চেষ্টা, সহ শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের সহযোগিতার ফলে। সেই কারণে ২০১৬ সালে রাজ্যের মধ্যে সেরা স্কুলের খেতাবও জিতে নেয় এই স্কুল। প্রধান শিক্ষক জানালেন, গোসাবার প্রয়াত বিধায়ক জয়ন্ত নস্করের উদ্যোগে বছর পাঁচেক আগে স্কুলে ঘি-ভাতের প্রচলন হয়েছিল। সেই ধারা আজও চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে।
গোটা স্কুলটিকেই সাজিয়ে তোলা হয়েছে নানা চিত্রের মাধ্যমে। বছরের বিশেষ বিশেষ দিনগুলি ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে স্কুলের দেওয়ালে। নানা মনীষীদের জন্ম ও মৃত্যু দিন, বিশেষ বিশেষ আবিষ্কার ও আবিষ্কারকদের নাম সহ আরও অনেক কিছু আঁকা হয়েছে দেওয়ালে। শিক্ষকেরা জানান, যাতে খুব সহজেই এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে খুদে পড়ুয়ারা— সেই লক্ষ্যেই এই উদ্যোগ।
রাজ্যে একাধিক সরকারি প্রাথমিক স্কুল, জুনিয়র হাইস্কুল পড়ুয়ার অভাবে ধুঁকছে। সেখানে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার এই স্কুল গমগম করছে পড়ুয়াদের নিয়ে। প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই স্কুলে শিক্ষকতা করছি। স্কুলই আমার কাছে সব। এ সব সম্ভব হয়েছে স্কুলের প্রাক্তন পড়ুয়া, শুভানুধ্যায়ী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অভিভাবকদের সহযোগিতার ফলে।’’
স্কুলে রয়েছে ডিজ়িটাল উপস্থিতি যন্ত্র, রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ঘণ্টা, ডিজ়িটাল ক্লাস রুম, কম্পিউটার রুম, সিসি ক্যামেরা সহ আধুনিক ব্যবস্থাপনা। এ ছাড়াও, স্কুলের উদ্যোগে তৈরি করা হয়েছে ‘আমার দোকান।’ সেই দোকানে থাকা সামগ্রী পড়ুয়ারা নিজেরাই নেবে এবং জিনিসের যা দাম সেই নির্দিষ্ট টাকা নির্দিষ্ট বাক্সে রাখবে। শিক্ষকেরা জানান, এই পদ্ধতিতে পড়ুয়াদের ছোট থেকেই সৎ মানসিকতা তৈরির চেষ্টা হচ্ছে।
প্রতি মাসে যে যে পড়ুয়া ও শিক্ষকদের জন্মদিন, তা উদ্যাপিত হয় মাসের নির্দিষ্ট একটি দিনে। কেক কেটে, পায়েস খাইয়ে চলে জন্মদিন পালন। এ ছাড়াও, পড়ুয়াদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য যোগব্যায়াম, ব্রতচারী সহ নানা পদক্ষেপ করা হয়েছে।
প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার ছেলেমেয়েরা যাতে কোনও অংশে শিক্ষায় পিছিয়ে না যায়, সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।’’ স্কুলের শিক্ষক অভিজিৎ দাস, শিক্ষিকা তাপসী মাহাতোদের কথায়, ‘‘এমন একটা স্কুলের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেরাই গর্বিত।’’