কাশ্মীরে পর্যটনের পরিচিত ছবি ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন সকলে। ছবি: সংগৃহীত।
গরমের মরসুমে বাঙালির স্বাভাবিক গন্তব্য পাহাড়। কম টাকা থাকলে দার্জিলিং। আর বাজেট বেশি হলে কাশ্মীর। এ বছরও গরমের ছুটিতে কাশ্মীর বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল বহু কলকাতাবাসীর। কিন্তু মঙ্গলবার কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হানার পরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। আর পর্যটকেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া সে আতঙ্কের আঁচ গিয়ে পড়েছে বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার কর্তাদের উপরেও।
সাধারণত গরমের ছুটির বেড়ানোর পরিকল্পনা হয় অনেক দিন আগে থেকে। মাস দুয়েক আগে কাটতে হয় ট্রেনের টিকিট। সেইমতো আগে থেকে ট্যুর অপারেটরদের কাছে হয়ে যায় বুকিং। এ বার কাশ্মীরের বুকিং ইতিমধ্যে অনেক হয়েছে কলকাতার নানা প্রান্তে। সে সবের এ বার কী হবে? পর্যটকেরা কি যাওয়ার সাহস পাবেন, এমন অবস্থায় তাঁদের নিয়ে কাশ্মীর রওনা হওয়া কি আদৌ যুক্তিসম্মত— সে সব নিয়ে চিন্তায় এখন বহু ভ্রমণ সংস্থার কর্তা।
কলকাতার একাধিক ভ্রমণ সংস্থায় খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, আগামী কয়েক মাসে কাশ্মীর ভ্রমণের প্রচুর বুকিং এসেছে। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের ঘটনায় অনেকেই এখন ভীত। বহু পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করতে শুরু করেছেন বুধবার সকাল থেকে। মধ্য কলকাতার এক অতিপরিচিত ভ্রমণ সংস্থার তরফে সৌমিত্র কুন্ডু জানালেন, বৃহস্পতিবার তাঁদের একটি কাশ্মীর ট্যুর ছিল। সেটি বাতিল করা হয়েছে। মে মাসেও কয়েকটি কাশ্মীর ট্যুরের বুকিং রয়েছে। পরিস্থিতি বিচার করে তা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানালেন তিনি। সৌমিত্রবাবু বলেন, ‘‘মে মাসের ১৫ তারিখের পরে আমরা পরের পরিকল্পনা করব। দেখা যাক, এর মধ্যে পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হয়।’’
মঙ্গলবারের জঙ্গি হামলাস্থল ছিল পহেলগাঁওয়ের কাছের বৈসরন উপত্যকা। পহেলগাঁও শহর থেকে জায়গাটির দূরত্ব প্রায় ৫ কিলোমিটার। শহরের আর একটি ভ্রমণ সংস্থার কর্তার কথায়, ‘‘শহর অঞ্চলে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে বৈসরন যেতে হয়। তাই সাধারণত ওখানে পর্যটকেদের ভিড় একটু কমই থাকে। এটা যদি পহেলগাঁওয়ের বেতাব বা আরু উপত্যকায় ঘটত, তা হলে যে কী হত, ভেবেই শিউরে উঠছি! সে সব জায়গায় আরও ভিড় থাকে।’’
শ্রীনগরের ডাল লেকে শিকারার ভিড়। ছবি: সংগৃহীত।
শ্রীনগরে ডাল লেকের কাছে হোটেল আছে কলকাতার দুই ভাইয়ের। এলাকায় বাঙালি হোটেল বলেই পরিচিত তাঁদের হোটেলটি। প্রায় চার দশক ধরে হোটেলটি চালাচ্ছেন কলকাতার সমর চক্রবর্তী এবং তাঁর ভাই অরুণ চক্রবর্তী। মঙ্গলবারের ঘটনায় তাঁরা মর্মাহত। অরুণ বললেন, ‘‘আজ পর্যন্ত হোটেল চালাতে গিয়ে আমরা কখনও কোনও সমস্যার সম্মুখীন হইনি। সব সময় স্থানীয়দের সমর্থন পেয়েছি।’’ তবে দীর্ঘ দিন পর কাশ্মীর যখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, তখন এই ধরনের ঘটনা পর্যটনশিল্পে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলেই আশঙ্কিত তাঁরা। অরুণ বললেন, ‘‘মানুষ এখন আতঙ্কিত। পরিবার নিয়ে কেউ ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। যতই সুরক্ষার কথা বলা হোক, আগামী কয়েক মাস পর্যটকদের একটা বড় অংশ কাশ্মীরকে এড়িয়েই চলবেন।’’
কাশ্মীরের স্থানীয়েরাও যে এই ঘটনায় মর্মাহত, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। প্রায় ২০ বছর কাশ্মীরে পর্যটকদের জন্য গাড়ি চালাচ্ছেন পুরুষোত্তম সিংহ। জঙ্গি হামলার এক দিন আগেই পহেলগাঁও থেকে বাঙালি পর্যটকদের নিয়ে ফিরেছেন তিনি। কাশ্মীরে বন্ধ ডাকা হয়েছে। সর্বত্র সেনার তৎপরতা। আনন্দবাজার ডট কমকে পুরুষোত্তম বললেন, ‘‘বছরের ৩০০ দিন আমি কাশ্মীরেই কাজ করি। স্বপ্নেও ভাবিনি এ রকম একটা ঘটনা ঘটবে!’’ অতীতেও কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তার পরেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে কাশ্মীর। পুরুষোত্তমের কথায়, ‘‘এই প্রথম দেখলাম স্থানীয়েরাও ঘটনার প্রতিবাদ করছেন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, আমরা পর্যটনের কোনও রকম ক্ষতি চাইছি না।’’ তবে পর্যটন ব্যবসায় ক্ষতি যে হবে এই জঙ্গিহানার পর, সে আশঙ্কা করছেন তিনিও।
আগামী কয়েক মাসে কাশ্মীরে পর্যটনের পরিস্থিতি পুরুষোত্তমকে ভাবাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘‘পর্যটকরা তো নিশ্চিন্তে এখানে ঘুরতে আসেন। কোথাও আপৎকালীন পরিস্থিতি তৈরি হলে মানুষ কি আর সেখানে ঘুরতে যায়?’’ প্রশ্ন ঘুরছে পুরুষোত্তমের মনে।
জঙ্গি হামলার পর কাশ্মীরে সেনা তৎপরতা বেড়েছে। —ফাইল চিত্র।
২০২৩ সালে জম্মু এবং কাশ্মীরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ৩৭০ ধারা বাতিল করার পর থেকে ছন্দে ফিরেছিল স্থানীয় পর্যটনশিল্প। গত দু’বছরে সারা ভারত থেকে কাশ্মীরে পর্যটকের সমাগমের হারও অনেকটাই বেড়েছে। গত বছর জুন মাসেই জম্মুতে অমরনাথ তীর্থযাত্রীদের উপরে জঙ্গি হামলার পরেও কাশ্মীর ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এ বার কী হবে, তা নিয়ে পর্যটনশিল্পের বিভিন্ন মহলে চিন্তা ছড়িয়েছে।
‘ট্রাভেল এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’-র পূর্ব ভারতীয় শাখার চেয়ারম্যান অঞ্জনীকুমার ধানুকা জানালেন, অন্যান্য বছর এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে বাংলা থেকে প্রায় ৫০ হাজার পর্যটক কাশ্মীর ভ্রমণে যান। তিনি বললেন, ‘‘গত দু’দিনে প্রচুর বুকিং বাতিলের অনুরোধ পেয়েছি। আমরা কাউকে জোর করছি না। সেইমতো ক্রেতাদের টাকাও ফেরত দেওয়া হচ্ছে।’’
৩০ এপ্রিল থেকে রাজ্যের একাধিক স্কুলে গরমের ছুটি শুরু হচ্ছে। প্রতি বছর এই সময় বাঙালি পর্যটকদের পছন্দের গন্তব্য কাশ্মীর। পাশাপাশি, জুলাই মাস থেকে অমরনাথ যাত্রা শুরু হওয়ার কথা। এমতাবস্থায় আগামী দু’মাস কাশ্মীর পর্যটনশিল্পে ধ্বস নামতে পারে বলেই মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ।
বাংলাতেও তার প্রভাব পড়বে বলেই মনে করছেন অঞ্জনীকুমার। কিন্তু তিনি মনে করিয়ে দিতে চাইছেন, এই নাশকতায় কাশ্মীরের মানুষের কোনও দোষ নেই। কারণ, পর্যটকেরা ভয় পেলে ভ্রমণ সংস্থা তাঁদের একই খরচে অন্য কোথাও পাঠাতে পারেন। কিন্তু তার ফলে ভুগবেন কাশ্মীরিরা। অঞ্জনীকুমার বললেন, ‘‘ওখানকার মানুষের উপার্জনের মূল মাধ্যম পর্যটন। তাঁরা কিন্তু এই নাশকতাকে সমর্থন করেননি। বরং মিছিলে হেঁটেছেন। আমাদের সংস্থার মাধ্যমে আমি সকলকে ইতিবাচক বার্তা দেওয়ারই চেষ্টা করছি।’’
পহেলগাঁওয়ের কাছে বেতাব উপত্যকা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। ছবি: সংগৃহীত।
কলকাতা শহরের আর একটি পর্যটন সংস্থার কর্ণধার রানা পাল ৭ এপ্রিল কাশ্মীর থেকে শহরে ফিরেছেন। মঙ্গলবারেই তাঁর সংস্থার অধীনে একটি ট্যুর শেষ করে পর্যটকেরা শহরে ফিরেছেন। তিনি বললেন, ‘‘বছরে আমাকে তিন-চার বার পর্যটকদের নিয়ে কাশ্মীর যেতে হয়। এ বার গিয়ে দেখলাম কেন্দ্রীয় সরকার সেনার সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে দিয়েছে। স্পর্শকাতর জায়গায় সেনার অভাবেই কি এ রকম একটা ঘটনা ঘটে গেল?’’ এ বারের জঙ্গিহানায় কলকাতার পর্যটকদেরও প্রাণ গিয়েছে। আগামী দিনে বাঙালি পর্যটকেরা কাশ্মীর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন বলেই আশঙ্কা রানার। একই সঙ্গে তিনি বললেন, ‘‘ওখানে এখন সেনার সংখ্যা বাড়ালে পর্যটকেরাও মনে জোর পাবেন। সরকার এবং প্রশাসনের ইতিবাচক ভূমিকা থাকলে আগামী দিনে আমাদের আর লোকসানের আশঙ্কা থাকবে না।’’ সে সব ব্যবস্থার অপেক্ষায় এখন তিনি।
কাশ্মীরের ঘটনায় ভ্রমণ সংস্থা থেকে শুরু করে পর্যটক, সকলেই এই মুহূর্তে শঙ্কিত। এই মরসুমে পর্যটন ব্যবসায় বড় ধাক্কা আসতে চলেছে ভেবে কপালে ভাঁজ ভ্রমণ সংস্থাগুলির। সমস্যা কাটিয়ে ভূস্বর্গ যেন দ্রুত সুন্দর হয়ে ওঠে, তারই অপেক্ষায় সকলে।