Air Travel

সকলেই ‘উড়ছেন’ খুব ভাল কথা, কিন্তু... ব্যবহার পাল্টাবে?

৩০,০০০ ফিট ওপরে, সামাজিক আলোড়নের সম্মুখীন হওয়ার পর, সন্দীপ ভুতোরিয়ার প্রশ্ন: পরিবর্তনশীল বিমান পরিষেবার সঙ্গে আমরা কী ভাবে নিজেদের মানিয়ে নেব?

Advertisement
সন্দীপ ভুটোরিয়া
শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৪ ১৪:০৭
Challenges of travelling with the common man on a flight

ছবি: সংগৃহীত।

যত ঘন ঘনই আপনি যাওয়া-আসা করুন না কেন, প্রতিটি যাত্রা শুরুর আগে, আপনার মধ্যে মিশ্র অনুভূতি হবে। সামনে কী আছে, যাত্রার ফল কী হবে ও যাত্রার অভিজ্ঞতা কেমন হবে, এই সব নিয়ে মনে একটা আশঙ্কা থাকবেই। সম্প্রতি, কলকাতা থেকে দেহরাদূন যাওয়ার সময়, আমি যখন বিমানে আমার নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলাম, তখন আমার মনেও ওই ধরনের আশঙ্কা কাজ করছিল। তখন অবশ্য আমি ভাবতে পারিনি যে, আমি এমনই এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হব, যা আমায় ভারতীয় সমাজের চরিত্র সম্পর্কে ভাবাবে।

Advertisement

ফ্লাইটে উঠে দেখি, সিট নং ১৮ ও ১সি-তে দু’জন মহিলা বসে আছেন। এবং সিট ১এ-তে তাঁরা কিছু জিনিস রেখেছেন। ঘটনাচক্রে সেটা ছিল আমার সিট। এই ক্ষেত্রে আর পাঁচজন যা করবেন, আমিও তাই-ই করলাম। আমি খুব ভদ্র ভাবে তাঁদের বললাম যে সিটটি আমার। আশা করেছিলাম যে, এটা জেনে তাঁরা তাঁদের জিনিসগুলি সরিয়ে নিয়ে, সিটটি আমার বসার জন্য খালি করে দেবেন। কিন্তু তাঁরা যে আচরণ করলেন আমি তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাঁদের প্রতিক্রিয়াটি এমনই ছিল যে, কয়েক মুহূর্তের জন্য আমি তার মর্মই বুঝে উঠতে পারিনি।

সহজে মেটে না

আমি ভেবেছিলাম, তাঁরা বোধহয় প্রথম বার বিমানে যাচ্ছেন। তাই বিষয়টি যাতে জটিল না হয়ে ওঠে, তার জন্য আমি বিমানকর্মীদের ডেকে ব্যাপারটা তাঁদের বুঝিয়ে বলার অনুরোধ করি। তাঁরা তাই করেন। বা বলা ভাল, তাঁরা সেটাই করেন কিন্তু কেবল আংশিক ভাবে সফল হন। বিমানকর্মীদের অনেক অনুরোধ-উপরোধের ফলে, ওই মহিলারা বেশ অসন্তোষের সঙ্গে সিটটি থেকে তাঁদের জিনিসগুলি তুলে নেন। এবং আমি আমার আসনটি পেয়ে যাই। তবে যুদ্ধটি তখনকার মতো জিতলেও, ছোটখাটো সংঘর্ষ লেগেই ছিল। রঙিন সনাতনী পোশাক পরা ওই পরাজিত মহিলারা তাঁদের মহামূল্যবান ব্যাগগুলি ওপরের জিনিস রাখার জায়গায় তুলে রাখতে অস্বীকার করেন। তাঁরা ঠিক করেন যে, গোটা যাত্রাপথ তাঁরা সেগুলিকে নিজেদের কোলে নিয়েই যাবেন। তাঁদের ওই সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটিও তাঁরা জানিয়ে দেন। এক জন বলেন, ওই ব্যাগে অনেক টাকা আছে, ৩৩,০০০ টাকা— তাই ব্যাগটি তিনি তাঁর নজরের বাইরে রাখতে পারবেন না। এবং এই তথ্যটি জনসমক্ষে ঘোষণা করার পর, বিমানকর্মীদের কথা মেনে, ব্যাগটি লাগেজ কক্ষে তুলে রাখার আর কোনও সম্ভাবনাই থাকে না।

Challenges of travelling with the common man on a flight

ছবি: সংগৃহীত।

মনে হতে পারে ব্যাপারটা এখানেই মিটে গেল। কিন্তু তা নয়। আরও অনেক ঘটনা বাকি থাকে। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট তাঁদের ব্যাগটি সিটের নীচে রাখার অনুরোধ করেন। এ বার আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বর চড়িয়ে, দুই মহিলা বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাঁরা বলেন, এক জন শিক্ষিত ব্যক্তি এই রকম একটি প্রস্তাব দিতে পারেন, তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন না। ব্যাগের গায়ে লেখা ছিল ‘গঙ্গাজল’। কেদারনাথের মন্দিরে তীর্থ করতে যাওয়ার জন্য তা একান্তই অপরিহার্য, বলেন তাঁরা। সাধারণ মানুষের সামগ্রীর সঙ্গে ওই পবিত্র জলের স্পর্শ হওয়া তো তাঁদের মতে ধর্মীয় ভ্রষ্টাচারের সমতুল্য। এই ধরনের ধর্মীয় জটিলতার সম্মুখীন হয়ে বিমান কর্মীরা শেষ পর্যন্ত পিছু হটেন। বিষয়টি নিয়ে আর ঘাঁটালেন না তাঁরা। বিমান আকাশে উঠল। এবং যাত্রাকালের কোনও এক সময় জানতে পারলাম যে, আমার সহযাত্রীরা জামশেদপুরের বাসিন্দা এবং তীর্থ করতে কেদারনাথ যাচ্ছেন। যাত্রাশেষে বিমান অবতরণ করার পর এরোব্রিজ না এসে পৌঁছলে ওই মহিলাদের বিড়ম্বনা আরও বেড়ে যায়। যেন এক চৌমাথায় পৌঁছে, কী করতে হবে তা তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না। এ বার তাঁরা তাঁদের সাম্প্রতিক প্রতিপক্ষের কাছে তাঁদের কী করণীয়, তা জানতে চান। আমি তাঁদের বলি, ডাইনে-বাঁয়ে না গিয়ে সোজা পবিত্রস্থান লবিতে গিয়ে পৌঁছলেই তাঁদের মোক্ষলাভ হবে।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমানযাত্রার বাজার

এখানেই ওই ঘটনাবহুল যাত্রার অবসান ঘটে। কিন্তু বিমান ওড়াকালীন যে ‘টারবুলেন্স’ বা আলোড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা আমাকে বেশ অনেক ক্ষণ বিচলিত করে রাখে। যে ভাবে গ্রামীণ ভারতীয় সমাজের গভীরে অতীত দৃঢ়মূল হয়ে আছে, তার নিরিখে ওই মহিলাদের অভিব্যক্তি, সংশয়, শিক্ষা ও আচরণ বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমাদের দেশের বর্তমান জটিলতা আরও প্রকট হয়ে ওঠে। এটাই হল আমাদের আজকের রক্ত-মাংসের ভারত। ২০২৪ এই ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ বিমান পরিষেবার বাজার হয়ে উঠতে চলেছে। এই ব্যাপারে আমাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ইংরেজদেরও এই বছরের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাব আমরা।

Challenges of travelling with the common man on a flight

ছবি: সংগৃহীত।

ডিজিসিএ-র রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ, ভারতের অভ্যন্তরীণ বিমান যাত্রীসংখ্যা ১.২০ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। তার পর থেকে অনেক দিন আর ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত উদ্যোগ, “হাওয়াই চটি-পরা সাধারণ নাগরিকও হাওয়াই জাহাজে যাত্রা করতে পারবেন”— এই বাস্তবকে আরও স্পষ্ট করে তুলছে। তাঁর ইউডিএএন (উড়েগা দেশকা আম নাগরিক) প্রকল্পের লক্ষ্য হল বিমান পরিষেবাকে ক্রমশ নিম্ন মধ্যবিত্তের আওতার মধ্যে নিয়ে আসা। এবং সেটা এখন ক্রমশ ফলপ্রসূ হতে শুরু করেছে।

কিন্তু এখনও দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ বিমানযাত্রা থেকে দূরে থাকেন। তাঁরা সড়কপথ বা রেলপথে যাতায়াত করেন। বিমানযাত্রার খরচই তাঁদের আকাশপথে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। সেই সঙ্গে আমাদের দেশ, প্রথা, ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান, সবই অনন্য রয়ে গিয়েছে। যদিও জেট বিমানের গতিতে দেশ এগোচ্ছে। অনেকে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন বা চলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এই দেশের মানুষ হিসেবে আমরা কী ভাবে এই নতুন ঝোড়ো গতির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেব, যার দুরন্ত গতি আমাদের সামনের দিকে ঠেলে এগিয়ে দিচ্ছে, সেটাই হবে দেখার বিষয়।

আরও পড়ুন
Advertisement