কামাখ্যা, কাজিরাঙ্গা, শিলং ও চেরাপুঞ্জি

ঘুরে এলাম গন্ডার আর মেঘের দেশে

পুজো শেষ করার ধৈর্য আর রাখতে পারলাম কই? বেরিয়ে পড়লাম মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেই। সবাই যখন নতুন পোশাকে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনে ব্যস্ত, আমরা তিনটি পরিবার— সঙ্গে কুক আর ট্যুর ম্যানেজার নিয়ে ১২ জনের দল উঠে পড়লাম কামরূপ এক্সপ্রেসে।

Advertisement
আশান্বিতা ঘোষ রায়
স্বর্ণময়ী রোড, বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫৩
চেরাপুঞ্জি

চেরাপুঞ্জি

পুজো শেষ করার ধৈর্য আর রাখতে পারলাম কই? বেরিয়ে পড়লাম মহাষষ্ঠীর সন্ধ্যাতেই।

সবাই যখন নতুন পোশাকে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনে ব্যস্ত, আমরা তিনটি পরিবার— সঙ্গে কুক আর ট্যুর ম্যানেজার নিয়ে ১২ জনের দল উঠে পড়লাম কামরূপ এক্সপ্রেসে। রাত ১০টা নাগাদ বহরমপুর-খাগড়াঘাট রোড স্টেশনে হুইসল বাজল।

Advertisement

ছুটে চলল ট্রেন।

নবমীর বেলা যখন ঢলছে, চাকার নীচে বিশাল জলরাশি। সরাইঘাট সেতু দিয়ে ব্রহ্মপুত্র পেরোচ্ছে ট্রেন। সামনেই গুয়াহাটি স্টেশন। প্রায় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যখন পৌঁছলাম, ঘড়িতে বিকেল পৌনে ৪টে। রাতে হোটেলে কাটিয়ে দশমীর কাকভোরে ছুটলাম সাত কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি রাস্তার শেষে কামাখ্যা দর্শনে। একান্ন পীঠের এক পীঠ এই মন্দিরে দেবীর মূর্তি নেই। রয়েছে ‘যোনি’র প্রতিকৃতি। তাকেই দেবী-রূপে আরাধনা করা হয়। মহিষ বলির প্রথা আছে আজও। কামাখ্যা মন্দিরের একটু উপরেই বগলা মায়ের মন্দির, তন্ত্রমন্ত্র সাধনার জন্য খুব পরিচিত। লোকে বলে, মন্দির লাগোয়া জঙ্গলে রাতে বাঘ আসে (খুব জোর চিতাবাঘ আসতে পারে কালেভদ্রে, তার বেশি কিছু সম্ভব নয়)।

পরের দিন, একাদশীর দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ সেরে ১টা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম কাজিরাঙ্গা ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামল। ঘন অন্ধকারে ঝিপঝিপ করে বৃষ্টি পড়ছে আর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ২৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। জানালা দিয়ে ঢুকছে হিমেল বাতাস। কাজিরাঙ্গার গাঢ় নিস্তব্ধতার মধ্যে আমাদের গাড়ি যখন রিসর্টে পৌঁছল, তখন সন্ধ্যা ৭টা।

দ্বাদশীর ভোরে ঘুম ভেঙে জানালার পর্দা সরাতেই বাগড়ি রেঞ্জের অপূর্ব সৌন্দর্য যেন গত তিন দিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দিল! ভোরের শান্ত পরিবেশে ২৭ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে চলা ছাগলের দল দেখে মনে হচ্ছিল— যানবাহন নয়, এই রাস্তা বুঝি ন্যাশনাল পার্কের প্রাণীদের জন্যই তৈরি হয়েছে। সকাল ৬টায় ট্যুর ম্যানেজার ডাকতেই আমরা সকলে হাতি সাফারির জন্য বাগড়ি রেঞ্জে চলে গেলাম। ভারতের প্রথম ন্যাশনাল পার্ক কাজিরাঙ্গা মূলত একশৃঙ্গ গন্ডারের চারণভূমি। তবে দেদার দেখা যায় হাতি, চিতাবাঘ, সম্বর, চিতল আর বাঘও। সোয়াম্প ডিয়ার (বারোশিঙা) আর ইন্ডিয়ান ওয়াটার বাফেলোর (বুনো মোষ) দেখা মেলে এক মাত্র এখানেই।

বড়াপানি

আমরা ছ’জনের একটি দল উঠে পড়লাম ‘ফুলমালি’ নামে একটা হাতির পিঠে। মাহুত আমাদের অন্য সব টিমের থেকে একটু আলাদা দিকে নিয়ে গেলেন। ফুলমালি জলকাদা ভেঙে গভীর জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলল। অত কাছ থেকে গন্ডার দেখে আমরা তো ভীষণ উত্তেজিত! মাহুত আমাদের সতর্ক করে দিলেন। ক্রমশ প্রচুর গণ্ডার আর তাদের ছানাপোনা চোখে পড়তে লাগল। ক্যামেরায় ছবি উঠতে লাগল খচাখচ। ডঙ্গা নদীর কাছে এসে জানলাম, তা নাকি চিতল মাছে ভরপুর।

সাফারি শেষে রেঞ্জ অফিসে ফিরে ফের অবাক হওয়ার পালা। দেখি, সওয়ারিরা ফুলমালিকে কলা দেওয়া মাত্রই সেগুলো সে খেয়ে ফেলছে। কিন্তু এক ভদ্রলোক ওকে বখশিস হিসাবে টাকা দিতেই তা শুঁড়ে নিয়ে মাহুতকে দিয়ে দিল। কত বুঝদার!

কাজিরাঙ্গার মায়াবী সৌন্দর্য উপভোগ শেষে আমরা রওনা দিলাম শিলংয়ের পথে। কাজিরাঙ্গা থেকে গুয়াহাটির দিকে ফেরার পথে ২৭ নং জাতীয় সড়ক ছেড়ে ৬ নং জাতীয় সড়ক ধরে আবার পাহাড়ে চড়া। পাহাড়ি রাস্তায় চার লেনের রাস্তা সমতলকেও অবাক করে দেয়। উপরে উঠতে শুরু করতেই ঠান্ডা বাড়তে শুরু করল। ২৭২ কিমি পথ পেরিয়ে ‘ছিলং’ পৌঁছতে ঠান্ডা একেবারে জাঁকিয়ে ধরল। কখনও ভাবিইনি, দ্বাদশীর রাতে কম্বল গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে হবে।

পরের দিন সকালে গরম পোশাক চাপিয়েই রওনা দিলাম চেরাপুঞ্জির দিকে। চলে এলাম বইয়ের পাতায় পড়া মেঘবৃষ্টির দেশ চেরাপুঞ্জিতে। আকাশের সেই দূরাগত মেঘের সঙ্গে আজ যেন বিজয়ার আলিঙ্গনেই মেতে ওঠা! ‘সেভেন সিস্টার্স ওয়াটারফল’-এর কাছে এসে প্রথমে খুবই নিরাশ। সবই মেঘে ঢাকা। একটু অপেক্ষা করতেই অবশ্য মেঘ সরে বেরিয়ে এল ‘ওয়াটারফল’-এর সেই অপরূপ সৌন্দর্য।

এই মেঘ, পাহাড়, পাহাড়ি নদী আর ঝরনার অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের হাতছানি ছেড়ে নেমে আসার সময়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। গুয়াহাটি ফেরার পথে দুপুরের খাওয়া সারতে বড়াপানির কাছে গাড়ি দাঁড়াতেই সবাই নেমে পড়লাম। একটা ছোট্ট কাঠের ঘরের সামনে একটা ঝরনা, আমাদের বেশ পছন্দ হল। পাহাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই কানে এল ঘণ্টি পোকার আওয়াজ। পাহাড় যে প্রতিনিয়তই মানুষকে আনন্দ দেয়, তা যেন নতুন করে অনুভব করলাম ওই ঘণ্টি পোকার আওয়াজে।

ঠিক যেন মনে হল, চতুর্দশীর দুপুরেও কোথাও দেবীর আরাধনা চলছে!

কী করে যাবেন?

বিমানে গুয়াহাটি গিয়ে গাড়ি নিতে পারেন। ট্রেনে গেলে হাওড়া থেকে কামরূপ বা সরাইঘাট এক্সপ্রেস পৌঁছে দেবে দেড় দিনে।

কখন যাবেন?

জুন-সেপ্টেম্বর, বছরের এই তিনটে বর্ষা-মাস ছাড়া বছরের যে কোনও সময় কামাখ্যা-চেরাপুঞ্জি যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন?

অসমের রাজধানী শহর গুয়াহাটি বা মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ে থাকার জায়গার কোনও অভাব নেই। রয়েছে নানা দামের হোটেল। কাজিরাঙ্গাতেও জঙ্গল ঘেঁষা অজস্র লজ ও কটেজ রয়েছে। অসম ট্যুরিজমের নিজস্ব পর্যটন আবাসও আছে। চেরাপুঞ্জিতে হোটেল ছাড়াও আছে হোম স্টে-র ব্যবস্থা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement