চিমনি পাহাড়ে

চার-চারটি নদীর কোলাজ সারা চিমনির আঁচল জুড়ে তোমাকে যে বোল্ড-আউট করবেই করবে এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। এমনিতে চিমনিতে এখনও ট্যুরিজম জাঁকিয়ে বসতে পারেনি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৭ ০৭:৫০

মিতাকে বললাম, প্যাচপ্যাচে গরমে, ঘামে-ঘামাচিতে মুঠোভর্তি মেঘ নেবে? মেঘ-সমুদ্রে ভাসবে? মেঘ ওড়নায় মুখ ঢেকে রুমাল চোর খেলবে? নাকি গরমাগরম কফিমগে চুমুক দিয়ে সাত সকালে মুখ দিয়ে ধোঁয়া বার করবে? এর যে কোনও একটাতে রাজি থাকলে আমি বাজি রেখে বলতে পারি তুমি আমার সাথে চিমনি যাবেই যাবে। নাহ মিতা চিমনি শুনে হেঁচকি তুলো না। কাশ্মীরে নয় শিলং-এও নয়—আন্দামান কী রাঁচিতেও নয়। এ হল হাত বাড়ালেই বন্ধুর মত কার্শিয়াং এর ছাদে উঠে আনমনে উপরে উঁকি ঝুঁকি মারলেই তুমি চিমনির চূড়া দেখতে পাবে। চার-চারটি নদীর কোলাজ সারা চিমনির আঁচল জুড়ে তোমাকে যে বোল্ড-আউট করবেই করবে এ কথা আমি হলফ করে বলতে পারি। এমনিতে চিমনিতে এখনও ট্যুরিজম জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। এত অল্প খরচে, অতি দ্রুত, অতি সুন্দর, ছিমছাম এমন জায়গা কিন্তু সহজে মিলবে না।

কখন যাবেন

Advertisement

পাহাড়ে মেঘ বালিকার তপস্যা ভাঙানোর জন্য বছরভর যাওয়া গেলেও ফ্যামিলি নিয়ে চলুন সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল এর মধ্যে। শীতকালটা রাখলাম অত্যুৎসাহী ট্রেকারদের মনপ্রাণভরে নীলাকাশ দেখা ও রজতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে প্রেমালাপ সেরে নেওয়ার জন্য।

কী ভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে যেন-তেন-প্রকারেণ, হাজারো পদ্ধতিতে -- ট্রেনে-বাসে অথবা প্লেনে শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলেই ধরে নিন অর্ধেক ঝক্কি ঝামেলা শেষ। এবার আপনার আমার সুবিধা মতো একটা চার-চাকা ধরলেই খেল খতম।শিলিগুড়ি থেকে কার্সিয়ং এর রাস্তা মাত্র ৪৮ কিলোমিটারের পথ আর নিউ জলপাইগুড়ি থেকে ৫৩ কিলোমিটারের। পাঙ্খাবাড়ি রোড অপ্রসস্ত ও প্রচণ্ড চড়াই হলেও দু'আড়াই ঘন্টায় ইজি কার্সিয়ং পৌঁছানোর পক্ষে আদর্শ।এখন হিল কার্ট রোড ছেড়ে সুন্দর পাথর বসানো টোল-ট্যাক্স দেওয়া রাস্তায় দেড় ঘন্টায় কার্সিয়ং পৌঁছানো সম্ভব আবার মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে নেমে আসতে পারবেন। শিমুলবাড়ি চা-বাগান ভায়া রোহিণী হয়ে যাওয়া এই সুন্দর পথের দু'ধারে মিলিটারি ক্যাম্প ও চা বাগানের ল্যাণ্ডস্কেপ মুহূর্তে মনকে আনমনা করে দেবে।

কোথায় থাকবেন

চিমনিতে থাকবার জন্য সবচেয়ে আদর্শ হল সুরজ ছেত্রীর হোম-স্টে। সেখানে আধুনিক দৃষ্টিনন্দন একটা তিন তলা বাড়ি আছে। ওপর তলায় ডবল বেড রুমের ৪টি ঘরের দু’টিতে ৩ জন করে শোওয়ার মত আর বাকি দু’টিতে দু’জন করে শোওয়ার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে ডান ও বাঁ পাশে মুখোমুখি দুটো গরম জলের সুবিধা সহ ওয়েস্টার্ন টয়লেটের সুবিধা আছে। খরচ ? মাথাপিছু প্রতিদিন ন’শো টাকা মাত্র। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামলে পাশাপাশি দু’টো ডবল বেডের স্বয়ংসম্পূর্ণ বাড়ি যার পোশাকি নাম ‘ব্যাম্বু কটেজ’। মিলবে কোমড ও গিজার সহ বাথরুম, ফায়ার প্লেস ইত্যাদি অতি উত্তম মন-কাড়া ঘরের মজা। ‘যদি হন সুজন’, তাহলে ৩-৪ জন থাকা যায়। ঠিকানা: সুরজ ছেত্রী, হিমালয়ান হোম স্টে, লোয়ার চিমনি, কার্শিয়াং, ফোন ৯৯৩৩৯৮২৫২৫।

লোয়ার চিমনিতে সুরজ ছেত্রীর বাড়ির সামনে উৎসাহী ট্রেকাররা ৮ - ১০ টি তাঁবু ফেলতে পারবেন অনায়াসে। একটু খোঁজ খবর করলে আশপাশে হোম-স্টে মিলতে পারে।

কী-কী দেখবেন

চার-চারটি নদীর কোলাজি ক্যানভাস দেখবেন? নাকি অন্য কিছু? আসলে চিমনির বিস্তৃত প্রকৃতির মধ্যে কী দেখবো না এটাই সব চেয়ে বড় প্রশ্ন। ডাইনে বাঁয়ে ওপর নীচে যে দিকেই তাকাই সে দিকেই দেখি তিনি তাঁর উজাড় করা সম্পদ আপন স্নেহ ও ভালবাসার মোড়কে মুড়ে নিপুণ হাতে ঠিক যেখানে যতটুকু দরকার ততটাই সাজিয়ে রেখেছেন। কোথাও কম বা বেশির বালাই নেই। গ্রাম আসলে একটাই, কিন্তু নামে দু'টো। উপরেরটা ‘আপার চিমনি’ আর নীচেরটা হ'ল ‘লোয়ার চিমনি’। লোয়ার চিমনি থেকে পদব্রজে বেড়িয়ে পড়ুন পাহাড়কে বাঁ পকেটে পুরে আপার চিমনির উদ্দেশ্যে। কথিত আছে ১৮৩৯ সনে ইংরেজ সাহেবরা গরু অথবা খচ্চর টানা গাড়িতে চড়ে এই পথে প্রথম দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে যাওয়ার সময় বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ও শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে এখানে একটি সুউচ্চ চিমনি নির্মাণ করে। তারপর থেকে এই গ্রামটির নাম হয় চিমনি। চিমনির নীচের অংশ লোয়ার চিমনি আর ওপরের অংশ আপার চিমনি। ভগ্নপ্রায় হেরিটেজ এই চিমনিটিকে সারিয়ে লাল রং করে সুন্দর একটি পার্কের মত করে সিজন-ফ্লাওয়ার দিয়ে সাজিয়ে রাখা আছে। পেছন দিকের পায়ে চলা পথ ধরে একটু এগিয়ে গেলেই দেখবেন নীচে সোনাদা,পশুপতি নগর, মিরিক, ঘুম সহ দার্জিলিং। আকাশ পরিষ্কার থাকলে সান্দাকফু-ফালুটের ফাঁক গলে নয়নাভিরাম কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে। ঝাঁ-চকচকে রাস্তার দু'ধারের দৃশ্যপট নজর কাড়বেই। মাঝে-মাঝে ধুপি গাছগুলোর ফাঁক গলে আর এক বিস্তৃত ল্যাণ্ডস্কেপ সকলের ভালবাসা পাওয়ার আশায় হা-পিত্যেশ করে সটান দাঁড়িয়ে আছে। দেখবেন পাশাপাশি চার-চারটি নদীর এক অদৃশ্যপূর্ব সহাবস্থান। এক্কেবারে বাঁ দিকে তিস্তা, তার পর মহানন্দা, ছোট নদী দুধে, সবার শেষে বালাসন। এই চার নদীর কোলাজ চিমনি গ্রামকে শাড়ির আঁচলের মত আগলে রেখেছে। আপার ও লোয়ার চিমনির ঠারে-ঠারে ধুপি, বার্চ, অর্জুন গাছ। ইতি উতি ঘোরার ফাঁকে সুরজ ছেত্রীর দোতালার বারান্দায় এক মগ কফি হাতে ঝাউ- পাইন-ধুপি-রডোড্রেনড্রন এর ফাঁক গলে একটু নীল আকাশে চোখ রাখুন। আবার রাতের অন্ধকারে হোম-স্টে লাগোয়া ভিউ-পয়েন্টে গিয়ে দাঁড়ালে দেখবেন দূরের টিপটিপ্ করে জোনাকির মত জ্বলছে, হাতের মুঠোয় কার্শিয়াং আর হাত বাড়ালেই বন্ধুর মত মহানন্দার তীরে শিলিগুড়িকে পেয়ে যাবেন।

যদি সত্যি একটু-আধটু ট্রেকিং-এর ইচ্ছা থাকে তো পায়ে-পায়ে হাঁটলেই সরাসরি চকচকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে-দেখতে মহানন্দার উৎসমুখ অব্দি চলে যাবেন এই চিমনি থেকে। আবার অতি উৎসাহীরা চিমনির বিলাস-বহুল হোম-স্টেকে কেন্দ্র করে বাগোড়া, চটোকপুর অথবা ডাউ হিল কিংবা অনায়াসে মংপু ঘুরে আসতে পারবেন। চিমনি গ্রামটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে ধুপি পাইন চির ও বন্য ফার্ণ গাছের ঘন জঙ্গল। তবে বন্ধু সাবধান, জ্যোৎস্না রাতে ভুলেও বনে যাবেন না। হরিণ, চিতা, কলো ভালুক, বাঘ এমনকী সাপও আছে, যা পাহাড়ে সচরাচর পাওয়া দুষ্কর।

সঞ্জীব রাহা, কৃষ্ণনগর, নদিয়া

ছুটি এক্সপ্রেস

বেড়ানোর গল্প লিখুন অনধিক ৫০০ শব্দে আর পাঠিয়ে দিন । জানান যাতায়াত, থাকা-খাওয়ার হালহকিকত। ছবি (নিজেদের ছাড়া) দিন। পাঠান এই ঠিকানায়:

সম্পাদক (‌সেন্ট্রাল বেঙ্গল)

আনন্দবাজার পত্রিকা

৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলিকাতা — ৭০০০০০১

অথবা, করুন ই-মেল: edit.centralbengal@abp.in

(*সম্পাদকের নির্বাচনই চূড়ান্ত। লেখা ও ছবি ফেরতযোগ্য নয়।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement