চাদালাভাদা আনন্ধা সুন্ধারারামান ভবানী দেবী। তবে সারা বিশ্বের কাছে যিনি শুধুই ভবানী দেবী। সম্প্রতি অলিম্পিক্সে ভারতে প্রথম ফেন্সার হিসাবে অংশগ্রহণ করে এবং ম্যাচ জিতে ইতিহাস রচনা করেছেন।
ফেন্সিং শব্দটার সঙ্গে সে ভাবে পরিচিতি ছিল না দেশের মানুষের। ভবানী দেবীর হাত ধরেই যেন ফেন্সিংকে চিনল ভারত।
২৭ বছরের ভবানী নিজেও কখনও ভাবেননি তিনি অলিম্পিক্সে যেতে পারবেন। কখনও ভাবতে পারেননি মা-বাবাকে এতটা গর্বিত করতে পারবেন।
অভাবের সংসারে জন্ম ভবানীর। তামিলনাড়ুর চেন্নাইয়ের মেয়ে। ভবানীর বয়স তখন ১১ বছর। স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি পড়ুয়াদের নিজের পছন্দমতো খেলা বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল।
ফুটবল, ক্রিকেট-এর সঙ্গে আরও অনেক খেলা ছিল। কিন্তু সে সমস্ত পরিচিত খেলার পিছনে ছোটেননি ভবানী। সব সময়ই আলাদা কিছু করার ইচ্ছা তাঁকে ফেন্সিং-এ নিয়ে আসে।
স্কুলের খেলার তালিকার একটি ছিল এই ফেন্সিং। সেটা যে ঠিক কী খেলা তা জানতেনই না ভবানী। স্কুলে ফেন্সিং-এ ভবানীর মতো হাতেগোনা কয়েক জনই নাম লিখিয়েছিল।
ফেন্সিং নিয়ে তাঁর মা-বাবারও কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছায় সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল তাঁদের।
ফেন্সিংয়ের অনুশীলন শুরুর পর পরই ভবানী বুঝেছিলেন তাঁর মতো দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য এই খেলা নয়। এই খেলার খরচ অনেক।
কিন্তু মা-বাবা তাঁকে হাল ছাড়তে দেননি। ভবানীর প্রথম ফেন্সিং কিট কেনার জন্য নিজের গয়না বিক্রি করে দিয়েছিলেন তাঁর মা।
মায়ের গয়না বিক্রির ছয় হাজার টাকায় ফেন্সিং কিট কিনেছিলেন ভবানী। তার পরও মেয়ের অনুশীলনের খরচ জোগাতে স্পনসরের জন্য দরজার দরজার ঘুরে বেড়াতে হযেছে তাঁদের।
মা-বাবা তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য যত পরিশ্রম করছিলেন, তত দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছিলেন ভবানী। তিনি জানতেন, তাঁকে জিততেই হবে। তা না হলে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা মা-বাবার স্বপ্ন ভেঙে যাবে।
কিন্তু ঠিকঠাক প্রশিক্ষক ছাড়া কি আর ফেন্সিং-এ সফল হওয়া যায়! ভবানীও পারছিলেন না। তাই বার বার ব্যর্থতা আসছিল তাঁর সামনে।
এক বার টুর্নামেন্টে এক প্রশিক্ষকের নজরে পড়ে যান তিনি। ভবানীর মধ্যে সম্ভাবনা দেখেছিলেন তিনি। ভবানীকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজিও হয়ে যান।
ওই প্রশিক্ষকের সাহায্যেই প্রথম সোনা আসে ঘরে। অনুর্ধ্ব ১৭-এর জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনার মেয়ে হলেন ভবানী।
অভাবের সংসারে বারবারই প্রতিবন্ধকতা এসেছে তাঁর সামনে। বারবারই মনে হয়েছে আর এগনো সম্ভব নয়। ২০১৩ সালে তো টাকার অভাবে ফেন্সিং ছেড়ে দেওয়ার মনস্থিরও করে ফেলেছিলেন।
মা-বাবার মাথার উপরে তখন ১০ লাখ টাকার দেনা। মেয়ের খেলার জন্য ঋণ নিয়েছিলেন তাঁরা। সেই টাকা কী ভাবে শোধ দেবেন তাই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এমনকি কোনও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার টাকাও ছিল না তাঁর কাছে।
এই পরিস্থিতিতেও মেয়েকে হাল ছাড়তে দেননি মা-বাবা। যত দিন গিয়েছে ভবানীও আরও কঠোর পরিশ্রম করে নিজেকে প্রস্তুত করে তুলেছে।
বিদেশে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার খরচ জোগাতে তাঁরা তামিলনাড়ুর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে চিঠিও লিখেছিলেন। জয়ললিতা বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিলেন ভবানীকে। তাঁকে অর্থ সাহায্যও করেছিলেন।
২০১৪ সালে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে রূপো জেতেন ভবানী। ভারতের প্রথম ফেন্সার হিসাবে আন্তর্জাতিক স্তরে ইতিহাস রচনা করেন।
ভবানীর হাত ধরে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাঁর পরিবারও। ১০ লাখ টাকার দেনাও শোধ করে দিয়েছেন ভবানী।
এ বছর জীবনের সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত কাটিয়েছেন ভবানী। সবচেয়ে ভাল খবর পেয়েছেন। জানতে পারলেন, টোকিয়ো অলিম্পিক্সে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চলেছেন তিনি। চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি।
অলিম্পিক্সে প্রথম ম্যাচে তিউনিসিয়ার প্রতিযোগীকে ১৫-৩ ব্যবধানে হারিয়ে দিয়েছিলেন ভবানী। প্রথম ভারতীয় হিসেবে অলিম্পিক্সে ফেন্সিংয়ে কোনও ম্যাচ জেতার নজির গড়ে তোলেন তিনি।
পরের ম্যাচেই মুখোমুখি হন বিশ্বের তিন নম্বর ফেন্সারের। ফ্রান্সের মেনন ব্রুনেটের বিরুদ্ধে লড়াই যে সহজ হবে না তা জানাই ছিল। তবুও অঘটনের আশায় ছিল ভারত।
ব্রুনেটের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই পিছিয়ে যান ভবানী। শেষের দিকে কিছুটা লড়াইয়ের চেষ্টা করেছিলেন বটে। শেষে ৭-১৫ ব্যবধানে হারতে হয় তাঁকে।
ফেন্সিংয়ে ভারতকে পদক এনে দিতে পারেননি ভবানী। ভারতের এক মাত্র প্রতিযোগীর হাত ধরে ফেন্সিংয়ে যে স্বপ্ন বুনেছিল ভারত তা থেমে যায় দ্বিতীয় রাউন্ডেই।
ভবানী পারেননি ঠিকই। কিন্তু ফেন্সিং নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শিখিযে দিলেন দেশের বহু ছেলে-মেয়েকেই। দেশের প্রথম ফেন্সার হিসাবে অনুপ্রেরণা হয়ে রইল তাঁর জীবন। ভবানীর পাখির চোখ এখন প্যারিস অলিম্পিক্স।