Harmanpreet Singh

গোলের পর গোল করেও কৃতিত্ব নেন না! ভারতীয় হকি দলের দর্শনই বদলে দিয়েছেন কৃষকের পুত্র হরমনপ্রীত

প্রিয় খেলা হকি। প্রিয় বাহন ট্রাক্টর। সারা বছর হকির ব্যস্ততার মাঝে ফুরসত পেলে ট্র্যাক্টর চালান হরমনপ্রীত। ভারতীয় দলে টোটাল হকি নিয়ে এসেছেন কৃষকের পুত্র।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২৪ ১৯:৩২
Picture of Harmanpreet Singh

হরমনপ্রীত সিংহ। ছবি: পিটিআই।

হকিতে ভারতের একছত্র দাপটের দিন অতীত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দেশ উন্নতি করছে। অনেক নতুন দেশ খেলছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির সাহায্য পায় সব দেশের খেলোয়াড়েরাই। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও বিদেশি কোচদের পাওয়া কঠিন নয়। তবু হরমনপ্রীত সিংহ জায়গা পাবেন ভারতীয় হকির ইতিহাসে।

Advertisement

হকিতে বিভিন্ন দেশের (বিশেষত ইউরোপের) উন্নতি ভারতের সোনালি যুগের অবসান ঘটিয়েছে আগেই। ১৯৮০ সালের পর কখনও অলিম্পিক্সের সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি ভারতীয় দল। অথচ ১৯২৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত টানা ছ’বার সোনা জিতেছিল ভারত। ১৯৭২ পর্যন্ত সব অলিম্পিক্সে পদক জিতেছে। অলিম্পিক্সে পদক আসেনি মানে ভারতে বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরি হয়নি, তা নয়। জাফর ইকবাল, পারগত সিংহ, ধনরাজ পিল্লাই, ভরত ছেত্রী, দিলীপ তিরকে, যুগরাজ সিংহ— একের পর এক বিশ্বমানের খেলোয়াড় উঠে এসেছেন। তবু পরবর্তী সময় বিশ্বমানের দল হয়ে উঠতে পারেনি ভারত। ঘাসের মাঠ থেকে টার্ফে হকি খেলা শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমশ পিছিয়ে গিয়েছে ভারতীয় হকি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভারতীয় হকির আত্মবিশ্বাস তলানিতে পৌঁছে গিয়েছিল একটা সময়। সেই ভারতই গত ছ’-সাত বছর ধরে উন্নতি করতে করতে বিশ্বের প্রথম সারিতে উঠে এসেছে।

২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সে খেলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি ভারত। চার বছর পর লন্ডন অলিম্পিক্সে পেয়েছিল সবার শেষ দ্বাদশ স্থান। এর পরই টনক নড়ে ভারতের হকি কর্তাদের। কঠিন সময় পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ওড়িশার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক। লন্ডনের ব্যর্থতার পর ঢেলে সাজানো হয় ভারতীয় হকির পরিকাঠামো। নতুন খেলোয়াড় তুলে আনার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেই প্রচেষ্টাতেই চার দশকের পদক খরা কাটিয়ে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ পায় ভারত। সেই প্রচেষ্টার অন্যতম ফসল হরমনপ্রীত। ভারতীয় দলের অধিনায়ক বিশ্বের অন্যতম সেরা ড্র্যাগ ফ্লিকার। আধুনিক হকিতে ড্র্যাগ ফ্লিকারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব হকি সংস্থা হরমনপ্রীতকে একাধিক বার বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার দিয়েছে।

গত টোকিয়ো অলিম্পিক্সের পর ভারতীয় দলের নেতৃত্ব পান হরমনপ্রীত। দায়িত্ব নিয়ে দলের খেলা বদলে দিয়েছেন তিনি। পরিবর্তনের একটা সময় পর্যন্ত ভারত শক্তিশালী দলগুলির বিরুদ্ধে মূলত প্রতিআক্রমণমূলক হকি খেলত। এই দর্শন বদলে দিয়েছেন হরমনপ্রীত। তাঁর দর্শনে আক্রমণই একটি দলের প্রধান অস্ত্র। যত বেশি আক্রমণ করা যাবে, তত বেশি প্রতিপক্ষকে চাপে রাখা যাবে। যত বেশি সময় প্রতিপক্ষের অর্ধে বল রাখা যাবে, তত জয়ের সম্ভাবনা বাড়বে।

একটা সময় দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তানের মতো এশিয়ার দলগুলিকে হারাতে পারত না ভারত। জাপান, চিনের বিরুদ্ধেও বেগ পেতে হত। হরমনপ্রীত এশিয়ার প্রতিপক্ষদের নিয়ে ভাবেননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, আর্জেন্টিনার মতো বিশ্বের সেরা দলগুলির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। তিনি জানতেন বিশ্বের সেরা দলগুলির সঙ্গে সমানে সমানে লড়াই করতে পারলেই এশিয়া সেরা হওয়া সম্ভব। হকি বিশ্বে ভারতের এক সময়ের দাপট ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তাঁর দর্শনের সঙ্গে মিলে গিয়েছে কোচ ক্রেগ ফুলটনের মানসিকতাও। যা ভারতকে টোকিয়ো অলিম্পিক্সের পর আরও শক্তিশালী দলে পরিণত করেছে। বিশ্বের সেরা পাঁচ দলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ভারতীয় হকি দল।

বিশ্ব হকির ক্রমতালিকা শুরু হওয়ার পর থেকে একটা সময় পর্যন্ত প্রথম ১০ দলের মধ্যে জায়গা হত না ভারতের। কখনও কখনও প্রথম ১৫ দলের মধ্যেও জায়গা হত না। আর গত চার বছরে ভারতীয় দল কখনও ক্রমতালিকায় প্রথম ১০-এর বাইরে যায়নি। মনপ্রীত সিংহের নেতৃত্বে টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ব্রোঞ্জ জয় আত্মবিশ্বাসী করেছিল ভারতের খেলোয়াড়দের। হকির সর্বোচ্চ স্তরে লড়াই করার সাহস ফিরিয়ে এনেছিল। হরমনপ্রীত সেই আত্মবিশ্বাস কাজে লাগিয়ে সতীর্থদের নিজের হকি দর্শনে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

কে এই হরমনপ্রীত? অমৃতসরের কাছে তিম্মোওয়াল গ্রামের বাসিন্দা ২৮ বছরের যুবকের জন্ম কৃষক পরিবারে। ১০ বছর বয়সে গ্রামে হকি খেলা শুরু। ১৫ বছর বয়স হলে হরমনপ্রীতের বাবা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দেন সুরজিৎ সিংহ হকি অ্যাকাডেমিতে। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি হরমনপ্রীতকে। শুধু এগিয়েছেন। ২০১৪ সালে ভারতের অনূর্ধ্ব-২১ দলে প্রথম সুযোগ পান। সেই দলের হয়ে ৩৫টি ম্যাচ খেলে ৩২টি গোল করেছিলেন হরমনপ্রীত। সিনিয়র দলেও জায়গা পেতে তাই সমস্যা হয়নি। ২০১৫ সালেই জাতীয় দলের দরজা খুলে যায়। সেই থেকে খেলছেন দেশের হয়ে। অলিম্পিক্সের আগে পর্যন্ত ২১৯টি ম্যাচে ১৮৮টি গোল করেছেন তিনি। গোল করা তাঁর কাছে প্রায় বাঁ হাতের খেল। এ বারে অলিম্পিক্সেও হরমনপ্রীতের স্টিক থেকে এসেছে ১০টি গোল। ফাইনালের আগে পর্যন্ত তিনিই প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ গোলদাতা। কিন্তু কোনও গোলই তিনি নিজের বলে মনে করেন না। হরমনপ্রীত বলেন, ‘‘আমার সব গোল দলের। সকলের কৃতিত্ব রয়েছে। একা গোল করা যায় না।’’

হরমনপ্রীতের কাছে সব সময় দল আগে। দলের স্বার্থে ডিফেন্স, মাঝমাঠ, ফরোয়ার্ড যে কোনও পজিশনে খেলতে প্রস্তুত থাকেন। তাঁকে দেখে ভারতীয় দলের অনেক খেলোয়াড় এখন নিজেদের নির্দিষ্ট পজিশন ভুলে দলের স্বার্থে খেলেন। টোটাল ফুটবলের মতো ভারতীয় দলে হরমনপ্রীত টোটাল হকি নিয়ে এসেছেন। তাতেই বদলেছে, ক্রমাগত বদলাচ্ছে ভারতীয় হকির চেহারা। বদলের অন্যতম রূপকার হিসাবে অধিনায়ক হরমনপ্রীতকে মনে রাখবেন হকিপ্রেমীরা। যাঁর প্রিয় বাহন ট্রাক্টর।

আরও পড়ুন
Advertisement