সৌজন্য: দ্বৈরথ শেষ। নাদালকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন জোকোভিচ। সোমবার প্যারিসে। ছবি: পিটিআই।
প্যারিস অলিম্পিক্সের চতুর্থ দিনে এসে আবিষ্কার করা গেল, গেমসে দু’টো পৃথিবী আছে। কিছু কিছু ইভেন্ট ঢিকিরঢিকির করে চলা লোকাল ট্রেনের মতো। ঝিমোতে ঝিমোতে এগোবে। দ্বিতীয়টা এক্সপ্রেস গতির। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দেখতে ছুটবে।
এত তফাত দু’টোর মধ্যে যে, মনে হবে একটা সাদা-কালো টিভির পুরনো দুনিয়া। অন্যটা ঝকঝকে রঙিন টিভির আধুনিক বিশ্ব। সোমবারের রোলঁ গ্যারোজ় রঙিন টিভির জগৎ। কে বলবে অলিম্পিক্সের ভবিষ্যৎ নিয়ে টানাটানি চলছে? প্রশ্ন উঠেছে, গেমসের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখা যাবে কি না। কয়েক দিন আগেও কয়েকটি সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, গেমসের অনেক ইভেন্টের টিকিট পড়ে আছে। কেউ কিনছে না। কিন্তু সোমবার রোলঁ গ্যারোজ়ে এত ভিড় যে, মনে হচ্ছিল নতুন কোনও আইফেল টাওয়ার কি বসানো হল নাকি এখানে? যা দেখতে এত মানুষ ছুটে এসেছে!
ইডেনে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ থাকলে কী গলদঘর্ম অবস্থা হয়, কল্পনা করুন। টিকিট হাতে রাস্তা দিয়ে চলতে থাকুন, কোন গেট দিয়ে ঢুকতে হবে তা গুলিয়ে যায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশ। ধাক্কা খেতে খেতে এগিয়ে চলো। এখানেও তেমন। অবশ্য, সোমবারের রোলঁ গ্যারোজ়ে যে দ্বৈরথ ছিল তাকে টেনিসের ভারত-পাক মহারণ বলা যেতেই পারে। রাফায়েল নাদাল বনাম নোভাক জোকোভিচ। ক্লে কোর্টের রাজা রাফার দুর্গে আধুনিক টেনিস সম্রাটের নেমন্তন্ন।
উইম্বলডনে যেমন সেন্টার কোর্ট, রোলঁ গ্যারোজ়ে তেমন ফিলিপ শাতহিয়ে (ফরাসিরা উচ্চারণ করেন ফিলিপ শাতহ্রিয়ে)। শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম, ইতিহাসের বিচারে সেন্টার কোর্টের পাশাপাশি থাকতেই পারে। রাফায়েল নাদাল যে এখানকার ক্লে কোর্টের অবিসংবাদী রাজা, রাস্তা ধরে রোলঁ গ্যারোজ়ের দিকে এগোতে থাকলেই বোঝা যাবে। প্যারিসে আসার পরে এ দিনই সব চেয়ে কড়া রোদ দেখা গেল। সঙ্গে তিরিশ ডিগ্রির উপরে তাপমাত্রা। অনেকে হাতপাখা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু অসহ্য গরমকে উপেক্ষা করে সকলে এগিয়ে চলেছেন প্রিয় রাজার দর্শন নেবেন বলে। ১৪ বার ফরাসি ওপেন জিতেছেন নাদাল। বিয়ন বর্গ, ইভান লেন্ডল ও জোকোভিচ মিলিয়ে জিতেছেন ১২ বার। এখানে তাঁর মূর্তি বসবে না তো কোথায় বসবে! একটা মঞ্চে এমন নিরঙ্কুশ আধিপত্যের নিদর্শন খেলাধুলোর ইতিহাসে আর দ্বিতীয়টা খুঁজে পাওয়া যাবে না। জোকোভিচ অস্ট্রেলীয় ওপেন জিতেছেন দশ বার। রজার ফেডেরার উইম্বলডন জিতেছেন আট বার।
প্রতিপক্ষের উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে কোনও গ্যালারি কি কখনও একজন খেলোয়াড়কে এমন তীব্র সমর্থনে ভরিয়ে দিয়েছে? তুলনা খুঁজে পাওয়া কঠিন। উইম্বলডনে ফেডেরারের কথা মনে পড়তে পারে। আর প্রতিপক্ষও তো যেমন তেমন কেউ নন। টেনিসের ইতিহাসে পুরুষদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি, ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম-জয়ী নোভাক জোকোভিচ। আরও আশ্চর্য লাগছিল দেখে যে, সোমবার তো ফরাসি ওপেন গ্র্যান্ড স্ল্যামের ম্যাচ ছিল না। ছিল অলিম্পিক্সের দ্বৈরথ, যাকে পেশাদার টেনিস পৃথিবী পাত্তাই দেন না। জোকোভিচই যেমন ২৪টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেও ট্রফি আলমারিতে একটা ব্রোঞ্জ (২০০৬ বেজিং) ছাড়া সোনার পদক নেই। তা নিয়ে এত দিন ধরে তাঁর রাতের ঘুম নষ্ট হয়েছে বলে শোনা যায়নি। নাদালের ঘরে আছে একটি অলিম্পিক্স সোনার পদক। এ বারে অবশ্য জোকোভিচ বলেছেন, এই শূন্যতা মেটাতে চান।
কিন্তু আজ যে অন্য রকম আবেগের বিস্ফোরণ ঘটার দিন ছিল। ক্লে কোর্টের রাজা তাঁর দুর্গে সম্ভবত শেষ বার সিঙ্গলস খেলতে নামছেন। না হোক গ্র্যান্ড স্ল্যাম, বুকে পাথর চাপা দিয়ে আজ যে বিদায়ের ঘণ্টা শোনার দিন! কে জানে, যদি আর দেখতে না পাই? সেই কারণেই রোলঁ গ্যারোজ়ের ফিলিপ শাতহিয়ে কোর্ট, যেখানে বহু মহাকাব্য লিখেছেন নাদাল, তা এমন একপেশে সমর্থনে ভরিয়ে দিল তাঁকে।
সংবাদমাধ্যমের দিক থেকেও, এত ভিড় এ বারের অলিম্পিক্সে আর দেখা যায়নি কোনও ইভেন্টে। সংগঠকেরা জায়গা দিতে পারছেন না বসার। কয়েক জন বললেন, বসার জায়গা দিতে হবে না। অন্তত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে দিন। তখন বারবার ঘোষণা চলছিল, এর পরে এমন দু’জনের ম্যাচ যাঁদের সংগ্রহে ৪৬টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম রয়েছে। ইগা শিয়নটেক তখন খেলছেন। এক বিদেশি সাংবাদিককে দেখলাম মোবাইলে অফিসকে ‘টক’ দিচ্ছেন, ‘‘রাফার বিরাট ফ্যান ইগা। মনে হয় দ্রুত মিক্সড জোনে সাক্ষাৎকার শেষ করে ম্যাচ দেখতে চলে আসবে।’’
কোর্টে আবির্ভাবের সময় রাফার নাম ঘোষণা হতেই গ্যালারি যে রকম গর্জন করে উঠল, তাতেই বোঝা গেল আজ রিখটার স্কেলে আবেগের বিস্ফোরণের মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছবে। সেই যে শুরু হল, তার পরে আর ডেসিবেল নীচে নামেনি। সময়-সময় চেয়ার আম্পায়ারকেও মনে হচ্ছিল জনতার আবেগ স্পর্শ করছে। ‘রাফা রাফা’ জয়ধ্বনি বার তিনেক হতে দিলেন, তার পরে বললেন ‘দয়া করে শান্ত হোন।’ জোকোভিচ সার্ভ পর্যন্ত করতে পারছেন না এমন রাফা-গর্জন চলছে। প্রথম সেটে অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছুটতে থাকলেন নোভাক। কোনও রকমে একটা গেম জিতলেন নাদাল। না হলে প্রথম সেট ০-৬ হারতেন। দ্বিতীয় সেটেও জোকার হেলায় এগিয়ে গেলেন ৪-০। আর কিছু ক্ষণেই তো সব শেষ। গ্যালারি তখন ঠিক করল, রাফা নয় নোভাকের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধে নামবে। আরও আগ্রাসী, রক্তলোলুপ ভঙ্গিতে যেন তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষের উপরে। রাফার প্রত্যেকটা শটে এমন হাততালি পড়ছে যে, বোঝা যাচ্ছে না কে জিতছে। তাঁর নামে গান ধরছে জনতা। ‘ভামোস ভামোস’ ধ্বনি উঠছে। কে বলবে এটা অলিম্পিক্স আর তিনি রাফায়েল নাদাল স্পেনের প্রতিনিধি। মনে হবে যেন ফ্রান্সের
হয়ে নেমেছেন।
জনতার অক্সিজেনে জেগে উঠলেন নাদাল। বিস্ময়কর ভাবে দ্বিতীয় সেটে চারটি গেম জিতে ৪-৪ করে ফেললেন। রোলঁ গ্যারোজ়ে তখন সিটে কেউ বসা নেই। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর একটা জাদু-ম্যাচ কি উপহার দিতে চলেছেন প্রিয় রাফা? কিন্তু ইনি ৩৮ বছরের নাদাল। চোট-আঘাতে জর্জরিত। কতবার অপারেশন টেবলে শুতে হয়েছে, হিসাব নেই। অবসরোত্তর জীবনে ঠিক মতো হাঁটতে পারবেন কি না, সেই সংশয় পর্যন্ত দেখা দিয়েছে। এ দিনও নেমেছিলেন ডান হাঁটুতে স্ট্র্যাপ লাগিয়ে। জোকোভিচ বুদ্ধি করে ড্রপ শট ব্যবহার করলেন বারবার। দৌড় করিয়ে গেলেন। চোট-আঘাতে রক্তাক্ত, বিপর্যস্ত নাদাল সেই ধকল নিতে পারলেন না। হেরে গেলেন ১-৬, ৪-৬। বোঝা গেল, ওই চারটি গেম জেতা আসলে প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে জ্বলে ওঠা।
কিন্তু তিনি যখন কোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন আর ফিলিপ শাতহিয়ে গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়ে হাততালিতে ভরিয়ে দিচ্ছে, কে বলবে তিনি পরাভূত! জোকোভিচ পর্যন্ত হাততালি দিচ্ছেন। দারুণ খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখিয়ে নাদালকে আগে বেরোতে দিলেন। নাকি তাঁর ভিতরটাও আজ খালি খালি লাগছিল। কে জানে আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না বন্ধু। গত আঠেরো বছর ধরে আনন্দ দিয়ে যাওয়া এক দ্বৈরথ। এই নিয়ে ৬০তম সাক্ষাৎ। সেটাও হয়তো আজই শেষ হয়ে গেল। চলতি অলিম্পিক্সেই কার্লেস আলকারাসের সঙ্গে ডাবলসে নামবেন নাদাল। তাঁর উত্তরসুরি এ দিন লেবাননের হাদি হাবিব-কে হারালেন ৬-২, ৬-১। কিন্তু সিঙ্গলসে আর তাঁকে দেখা যাবে না, সোমবারের প্যারিস এই করুণ সুরে আক্রান্ত। জাদুঘরে ঢুকে থাকবে ওই তথ্য যে, এ দিনেরটা ধরে ১১৬টি সিঙ্গলস ম্যাচ খেলে রোলঁ গ্যারোজ়ের রাজা হেরেছেন মাত্র পাঁচ বার।
কোনও কোনও হার আসলে জয়কেও টেক্কা দিয়ে যায়। কোনও কোনও পরাজিতের জন্য বিজয়ীর বরণমালা অপেক্ষা করে থাকে। সোমবারের রোলঁ গ্যারোজ়েও ছিল সে রকমই একটা দিন।
কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই!