এই চিঠি এমন ভাবে পড়ুন, আর উত্তর দিন, যেন আমি প্রেসিডেন্ট নই, কেবল এক জন বন্ধু...” লিখেছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন, সেনানায়ক ইউলিসিস গ্রান্টকে। তারিখ ছিল ১৯ জানুয়ারি ১৮৬৫। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ তখন শেষ পর্যায়ে, কাপাস-উৎপাদক দক্ষিণের এগারোটি বিদ্রোহী রাজ্যের ‘কনফেডারেসি’ ক্রমশ পিছু হটছে, তাদের সৈন্যদল অভুক্ত, বেতনহীন। তাদের সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছে গ্রান্টের কাছে। উত্তরের কুড়িটি রাজ্য, এবং তাদের নেতা প্রেসিডেন্ট লিঙ্কন বদ্ধপরিকর, দক্ষিণের রাজ্যগুলি যতই ধনী, প্রতাপশালী হোক, তাদের আমেরিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেওয়া চলবে না। রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ লিঙ্কনের মুখের রেখা আরও গভীর করছে, চোখের কোল আরও গাঢ় হয়েছে। তাঁর বাড়িতেও যুদ্ধ— একুশ বছরের পুত্র রবার্ট যুদ্ধে যোগ দেবেই, আর স্ত্রী মেরি কিছুতেই যেতে দেবেন না। বিব্রত লিঙ্কন চিঠি লিখলেন গ্রান্টকে— যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে রবার্ট কি সৈন্যদলে স্থান পেতে পারে? নাহয় লিঙ্কনই ছেলের সব খরচ দেবেন। পত্রপাঠ জেনারেল গ্রান্ট রবার্টকে ‘ক্যাপ্টেন’ পদমর্যাদা দিয়ে নিজের আধিকারিকদের মধ্যে স্থান করে দিলেন। তার মাত্র তিন মাস পরেই যুদ্ধ শেষ হল— ৯ এপ্রিল বিদ্রোহী রাজ্যগুলির সেনানায়ক রবার্ট লিভার্জিনিয়াতে আত্মসমর্পণ করলেন গ্রান্টের কাছে। ছ’লক্ষেরও বেশি জীবনের মূল্যে আমেরিকার ঐক্য বাঁচল। বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার অসমশক্তিধর হয়ে ওঠার সম্ভাবনার সেই ছিল সূত্রপাত। তার পাঁচ দিনের মাথায় আততায়ীর গুলি প্রাণ নিল আব্রাহাম লিঙ্কনের।
আজ থেকে একশো ষাট বছর আগের সেই দিনগুলিতে আমেরিকায় যা ঘটছিল, তা সারা বিশ্বে ইতিহাসের গতিতে আঁচড় কেটে যাচ্ছিল। ৩১ জানুয়ারি ১৮৬৫, কংগ্রেসে আমেরিকার সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করল। তাতে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের দাসত্ব থেকে মুক্তি ঘোষিত হল তো বটেই, সারা বিশ্বেই দাসপ্রথা, দাসত্ব-সমান মানবজীবনের বিরুদ্ধে প্রশাসন ও বাণিজ্যের অবস্থান প্রশ্নাতীত হয়ে উঠল। চার বছরের গৃহযুদ্ধ বদলে দিল দুনিয়ার যুদ্ধের রীতিও। সাবমেরিন, বেলুন, মেশিনগানের আদি সংস্করণ ‘গ্যাটলিং গান’-এর ব্যবহার, এমনকি যুদ্ধের জন্য রেলপথের ব্যবহার, এ সবের কার্যকারিতা বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছিল আমেরিকার গৃহযুদ্ধ। জলযুদ্ধে মাইন আর টর্পেডোর সাফল্য পরবর্তী কালে ল্যান্ডমাইন আর গ্রেনেড তৈরির পথ করে দেয়, মনে করেন অনেক ইতিহাসবিদ। চার বছরের গৃহযুদ্ধ বিপুল প্রভাব ফেলেছিল অনেক দূরের একটি দেশের অর্থনীতিতে, তার নাম ভারত। ১৮৬০ সাল অবধি ব্রিটেনের কাপড় কলগুলোতে কাপাস সরবরাহ করেছে প্রধানত আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলি। ভারত থেকে আমদানি হওয়া কাপাসের অনুপাত ছিল মাত্র বারো শতাংশ। যুদ্ধ শুরু হতে রফতানি বন্ধ হল। বছর না-ঘুরতেই দেখা গেল, ব্রিটেনের কাপাস আমদানির নব্বই শতাংশ আসছে ভারত থেকে, তার এক-চতুর্থাংশ শুধু বিদর্ভের। ভারতের নিজস্ব কাপড় শিল্প প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, বিশ্ববাণিজ্যে তার রফতানি দাঁড়াল তলানিতে। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির সামান্য চর্চাও যাঁরা করেছেন, তাঁরা জানেন কত দূরে ও গভীরে বিস্তৃত হল এই নতুন কৃষি-ব্যবস্থা, দেশীয় উৎপাদক বা দেশীয় উপভোক্তা কারও স্বার্থের কথা না ভেবে সমুদ্রপারের স্বার্থসিদ্ধিই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল। খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ফসল বাদ দিয়ে কেবলমাত্র কাপাস চাষ করার ফল আজও ভুগছেন বিদর্ভের চাষিরা।
এত বড় যুদ্ধ, এত প্রাণক্ষয়, বিশ্বের রাজনীতি ও বাণিজ্যে তার এত বিপুল প্রভাব। তবু যে লিঙ্কনের চিঠিটি দাগ কেটে যায়, তা দেখায় যে ইতিহাসে শুধু জনজীবনের নানা ঘটনার অতিকায় অক্ষরেই লেখা হয় না, ব্যক্তিগত জীবনের অজস্র ছোট ছোট আঁচড়ও তাকে ফুটিয়ে তোলে। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ আক্ষরিক অর্থেই ঘরে ঘরে প্রবেশ করেছিল। লিঙ্কনের স্ত্রী মেরি এবং গ্রান্টের স্ত্রী জুলিয়া, দু’জনেরই বাপের বাড়ি ছিল ধনী, ক্রীতদাসের মালিক। মেরি লিঙ্কনের রূঢ় ব্যবহার আহত করেছিল জুলিয়াকে, তাই মেরিকে এড়িয়ে চলতেন তিনি। লি-এর আত্মসমর্পণের আনন্দ উদ্যাপন করতে ফোর্ড থিয়েটারে নাটক দেখতে যাওয়ার জন্য গ্রান্ট দম্পতিকে আমন্ত্রণ করেছিলেন লিঙ্কন। জুলিয়ার আপত্তিতেই তা ফিরিয়ে দেন ইউলিসিস গ্রান্ট। পরে জেনেছিলেন, তাঁর উপরেও আক্রমণের ছক ছিল। ১৪ এপ্রিল ১৮৬৫ লিঙ্কনের সঙ্গী হলে হয়তো ৪ মার্চ ১৮৬৯, আমেরিকার অষ্টাদশ প্রেসিডেন্ট হতেন না ইউলিসিস গ্রান্ট।