এ বারের আইপিএলে ব্যাটার বেশি বাউন্সার সামলাতে হচ্ছে। —ফাইল চিত্র।
আরশদীপ সিংহের করা বলটা বুকের উচ্চতায় উঠে এসেছিল। ঠিক মতো সামলাতে না পেরে ক্যাচ তুলে দিয়েছিলেন কুইন্টন ডি’কক। চতুর্থ ওভারে লোকেশ রাহুলকেও বাউন্সারেই আউট করেছিলেন আরশদীপ। পঞ্জাব কিংস বনাম লখনউ সুপার জায়ান্টসের ম্যাচ দেখলে মনে হবে এ বারের আইপিএলে এক ওভারে দুই বাউন্সারের নিয়ম সত্যিই সুবিধা করে দিয়েছে পেসারদের।
এ বছর আইপিএলে পেসারদের দাপট বেশি দেখা যাচ্ছে। বেগনি টুপির লড়াইয়ে থাকা বোলারদের মধ্যে যুজবেন্দ্র চহাল ছাড়া প্রথম দশে সকলেই পেসার। বাঁহাতি মুস্তাফিজুর রহমান শীর্ষে রয়েছেন। দ্বিতীয় স্থানে স্পিনার চহাল। পরের তিন জন মোহিত শর্মা, খলিল আহমেদ এবং ট্রেন্ট বোল্ট। পরের পাঁচ জনও পেসার। অর্থাৎ প্রথম ১০ জনের মধ্যে মাত্র এক জন স্পিনার। ভারতের পিচে এই ভাবে পেসারদের দাপট চোখে পড়ার মতো।
এই দাপটের নেপথ্যে কী এক ওভারে দু’টি বাউন্সার দেওয়ার নিয়ম? বাংলার রঞ্জিজয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন নতুন এই নিয়ম অবশ্যই পেসারদের সাহায্য করছে। তিনি বললেন, “ওভারে দুটো বাউন্সার দিতে পারলে অবশ্যই পেসারদের সুবিধা হয়। এটা খুব বড় একটা অস্ত্র। ব্যাটারদের প্রশ্নের মুখে ফেলে দেওয়া যায়। খুব ইতিবাচক একটা সিদ্ধান্ত।”
বাউন্সার মানে শর্ট লেংথ বল যা মাথা লক্ষ্য করে উঠে আসে। পেসারদের কাছে এই বল বড় অস্ত্র। কারণ মাথার উপর দিকে বল যাচ্ছে মানে, ব্যাটারের চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে সেই বল। টি-টোয়েন্টিতে সব বলই খেলতে চান ব্যাটারেরা। এমন বলে পুল করতে গিয়ে একটু ভুল করলেই ক্যাচ উঠে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
একটা সময় ছিল যখন, বাউন্সার দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। ক্যারিবিয়ান পেসারেরা একটা সময় ওভারের ছ’টি বলই বাউন্সার করতেন। সেই সময় সুনীল গাওস্করের মতো ব্যাটারেরা হেলমেট ছাড়াই ওই বাউন্সার সামলাতেন। ১৯৯১ সালে আইসিসি প্রথম বার বাউন্সারের উপর নিষেধাজ্ঞা আনে। সেই সময় এক ওভারে এক জন ব্যাটারকে একটি মাত্র বাউন্সার করার অনুমতি দিয়েছিল আইসিসি। পরে তা পাল্টে নিয়ম করা হয়, এক ওভারে দু’টি বাউন্সার দেওয়া যাবে। ২০০১ সালে তা কমিয়ে করে দেওয়া এক ওভারে একটি বাউন্সার। ২০১২ সালে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এই নিয়ম চালু রাখলেও এক দিনের ক্রিকেটে ওভারে দু’টি বাউন্সার করার অনুমতি দেওয়া হয়। এ বারের আইপিএলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে দু’টি বাউন্সার করার অনুমতি দেয় বিসিসিআই।
এ বারের আইপিএল বাউন্সার বেশি করতে পারায় যে সুবিধা হচ্ছে, তা মেনে নিয়েছেন বিজয় শঙ্কর এবং সন্দীপ শর্মা। রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলা সন্দীপ বলেন, “বাউন্সারের জন্য বোলারেরা সুবিধা পাচ্ছে। আগে একটা বাউন্সার হয়ে গেলেই ব্যাটারেরা নিশ্চিন্ত হয়ে যেত। ওরা সহজে বুঝতে পারত আমরা কী ধরনের বল করব।” গুজরাত টাইটান্সের বিজয় যদিও অসুবিধার কথাও জানালেন। তিনি বলেন, “বোলারদের এই নিয়ম ঠিক করে কাজে লাগাতে হবে। সব সময় তো আর বাউন্সার করা যাবে না। আর বাউন্সারে যদি কোনও ব্যাটার বাউন্ডারি মেরে দেয়, তখন আর সেই বল করে খুব একটা লাভ হয় না। তবে ভারতের যে মাঠগুলো বড়, সেখানে বাউন্সার কাজে লাগবে। বোলারেরা চেষ্টাও করবে সেখানে বাউন্সার করতে।”
বাংলার এক প্রাক্তন পেসার মনে করেন, এক ওভারে দু’টি বাউন্সার করতে পারলে ব্যাটারদের মনে প্রশ্ন তৈরি করা যায়। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ওই পেসার বললেন, “এক ওভারে দু’টি বাউন্সার মানে ব্যাটারকে অপেক্ষায় থাকতে হয় কখন ওই বল দু’টি আসবে। আগে একটি বাউন্সার করে দিলেই ব্যাটার নিশ্চিন্ত হয়ে যেত। এখন সেটা পারছে না। মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে, এই বুঝি বাউন্সার এল। সেটা ক্রিকেটের জন্য ভাল। না হলে ক্রিকেটটা বড্ড বেশি ব্যাটারদের খেলা হয়ে যায়।”
বাউন্সারের এই নতুন নিয়ম ক্রিকেটকে বদলে দিতে পারে বলে মনে করেন সম্বরণ। তিনি বললেন, “এটা কখনও দেখতে ভাল লাগে না, যে ব্যাটার শুধু রান করে যাবে আর বোলার মার খাবে। দুটো বাউন্সার করতে পারলে বোলারদের জন্যেও কিছু থাকবে। তারাও সাহায্য পাবে। এটা জরুরি। ক্রিকেটের জন্য এটা খুব ভাল একটা সিদ্ধান্ত। কাজেও লাগছে। এ বারের আইপিএলে অনেক বোলারদেরই দেখা যাচ্ছে ওভারে দু’টি বাউন্সার দিতে। তাঁরা উইকেটও পাচ্ছেন।”
বাউন্সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ পেসারদের এগিয়ে রাখছেন ইরফান পাঠান। ভারতের বাঁহাতি অলরাউন্ডার বিখ্যাত ছিলেন সুইংয়ের জন্য। সেই পেসার বলেন, “বিদেশি পেসার এবং অভিজ্ঞ ভারতীয় পেসার যেমন যশপ্রীত বুমরা, এই বাউন্সার কাজে লাগাবে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটারদের জন্য। বিশেষ করে তরুণ ব্যাটারদের বিরুদ্ধে। কারণ তাঁরা বাউন্সারের বিরুদ্ধে খেলতে তেমন অভ্যস্ত নয়। সেই সুযোগটা নিতে চাইবেন পেসারেরা।”
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ডট বল (যে বলে রান হয়নি) ব্যাটারদের কাছে অপরাধের মতো। ফলে টেস্টে বাউন্সার দিলে অনায়াসে তা ছেড়ে দিতে পারেন ব্যাটারেরা। টি-টোয়েন্টিতে এক ওভারে দু’টি বাউন্সার ছেড়ে দেওয়া মানে, দু’টি ডট বল। যা সব সময় ব্যাটারেরা হতে দিতে পারেন না। সেই কারণে বাউন্সারের বিরুদ্ধে ব্যাট চালাতে বাধ্য হচ্ছেন ব্যাটারেরা। ভুলও করছেন অনেক সময়। আর তাতেই আসছে উইকেট।
বাউন্সার প্রাণঘাতীও। ফিল হিউজ়ের ঘটনা এখনও ভুলতে পারেননি কেউ। অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটার বাউন্সারের স্বীকার হয়েই প্রাণ হারিয়েছিলেন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে। যে কারণে এখন শুধু হেলমেট পরলেই হয় না। তাতে সঠিক জায়গায় গার্ডও লাগাতে হয়। সেই কারণেই বাউন্সার করার ক্ষেত্রে পুরোপুরি ছাড়পত্র দিতে পারে না আইসিসি। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বাংলার ওই প্রাক্তন পেসার বললেন, “মানছি বাউন্সার অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। কিন্তু এখন ক্রিকেটীয় সরঞ্জাম অনেক উন্নত। ফলে ব্যাটারের কাছে সুযোগ থাকে নিজেকে বাঁচানোর। সেটা মাথায় রেখেই বলছি, ওভারে দু’টি বাউন্সার করার ছাড়পত্র আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও দেওয়ার কথা ভাবতে পারে আইসিসি।”
আইপিএলে এখনও পর্যন্ত ১৪টি ম্যাচ হয়েছে। তাতে পেসারদের দাপট দেখা গিয়েছে। আইপিএল শেষেও এই দাপট থাকে কি না সেই দিকে নজর থাকবে। আইসিসি-রও নজর থাকতে পারে এই দিকে। আইপিএল থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও টি-টোয়েন্টিতে ওভারে দু’টি বাউন্সারের ছাড়পত্র দেওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।