আইপিএলে আলোচনার কেন্দ্রে গুজরাতের কোচ আশিস নেহরা। ছবি: আইপিএল।
১৮ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন। ১৬৪টি ম্যাচে সংগ্রহ ২৩৫টি উইকেট। ক্রিকেট দুনিয়া আশিস নেহরাকে মনে রেখেছে ২০০৩ বিশ্বকাপের একটি ম্যাচের জন্য। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে ২৩ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন ভারতের প্রাক্তন বাঁহাতি জোরে বোলার। ক্রিকেটার হিসাবে দারুণ আকর্ষণীয় নয় তাঁর পরিসংখ্যান। তবু আইপিএলের অন্যতম আকর্ষণ তিনি।
সাধারণত সাজঘরে বা ডাগআউটে বসে থাকতে দেখা যায় ক্রিকেট কোচদের। দলের খেলা দেখতে দেখতে কথা বলেন ক্রিকেটার, সহকারীদের সঙ্গে। মাঠে উত্তেজনা তৈরি হলে তাঁরাও উত্তেজিত হন। তবু অধিকাংশ ক্রিকেট কোচই সংযমের আবরণ নষ্ট হতে দেন না। চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত বা জন বুকাননের মতো চিরাচরিত রাশভারী ক্রিকেট কোচদের সঙ্গে মেলানো যাবে না আশিস নেহরাকে। আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজ়ি গুজরাত টাইটান্সের কোচ সব সময়ই ‘আউট অফ দ্য বক্স’। ক্রিকেট কোচের সংজ্ঞাই এক রকম বদলে দিয়েছেন নেহরা।
কোচ নেহরাকে এক ঝলক দেখলে ভ্রম হতে পারে। প্রথম একাদশের বাইরে থাকা কোনও ক্রিকেটার মনে হতে পারে। গুজরাতের ডাগআউটে চোখ রাখলে নেহরার দেখা পাওয়া যাবে না। নেহরা সারা ক্ষণ বাউন্ডারি লাইনের ধারে। দলকে নাগাড়ে নির্দেশ দিয়ে চলেছেন। টি-শার্ট, শর্টস আর মাথার পিছনে টুপির সান গার্ড। কোচ নেহরার এই স্টাইলও এখন পরিচিত ক্রিকেট মহলে।
সব কোচের কাজ করার নির্দিষ্ট ধরন থাকে। নেহরারও আছে। হার্দিক পাণ্ড্যদের কোচ অনেকটা ফুটবল কোচদের মতো। ম্যাচের সারা ক্ষণই প্রায় সক্রিয়। ফুটবল কোচদের জন্য লক্ষ্মণরেখা থাকে। টেকনিক্যাল এরিয়ার বাইরে যেতে পারেন না তাঁরা। মাত্রা ছাড়ালে রেফারি হলুদ বা লাল কার্ড দেখাতে পারেন। ক্রিকেট কোচদের জন্য নিয়মের এই বেড়াজাল নেই। টেকনিক্যাল এরিয়ার বাঁধন নেই। হলুদ বা লাল কার্ডের চোখরাঙানি নেই। সেই সুবিধা এক মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া হতে দেন না।
গত বছর থেকে আইপিএল খেলতে শুরু করেছে গুজরাত। দলকে প্রথম বছরেই চ্যাম্পিয়ন করেছেন কোচ নেহরা। গুজরাত দলে কোচিং স্টাফদের অন্যতম ২০১১ সালে ভারতকে বিশ্বকাপ জেতানো কোচ গ্যারি কার্স্টেন। তবু তাঁর হাতে ব্যাটন নেই। নেহরা ধরে রেখেছেন দলের রাশ। তিনি ছুটছেন, তাঁর দলও ছুটছে। গত বারের চ্যাম্পিয়নরা এ বারও আইপিএলের লিগ পর্বে শীর্ষে শেষ করেছে।
গত বছর আইপিএলের সময় নেহরাকে দেখা যেত সমানে কাগজে কিছু না কিছু লিখছেন। তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে নানা রসিকতাও হয়েছে। কী লিখতেন তিনি? গত বছর সেপ্টেম্বরে এক সাক্ষাৎকারে নেহরা বলেছিলেন, “ওই কাগজে কিছুই লেখা থাকত না। আমি জানি না কেন লোকে ভাবত যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা রয়েছে। কাগজে শুধু লেখা থাকত অনুশীলনে আমাদের খাবারের মেনু কী হবে।” প্রথম বছরেই দলকে আইপিএল চ্যাম্পিয়ন করা নিয়ে বলেছিলেন, “আমি কোনও সুপার কোচ নই। সাধারণ এক জন। মাঠের বাইরে বসে আমিও দর্শকদের মতো খেলা দেখি। দল জিতলে এ সব কথাবার্তা লোকে বলেই। প্রত্যেক কোচই কঠোর পরিশ্রম করে এবং ম্যাচে তারই ফল পায়। গুজরাতে আমার প্রথম মরসুম খুব ভালই কেটেছে।”
নেহরা ঠিক বলেছেন। সব কোচই দলের জন্য পরিশ্রম করেন। নিজের সমস্ত ক্রিকেট জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ক্রিকেটারদের মধ্যে উজাড় করে দেন। ক্রিকেটারদের ছন্দে ফেরার মন্ত্র দেন। প্রতিপক্ষকে হারানোর পরিকল্পনা তৈরি করেন। নেহরাও করেন। ক্রিকেটারদের সঙ্গে কোচ নয় ক্রিকেটার হিসাবে মিশে গিয়ে করেন। সে জন্যই দলের সব সাফল্যের কৃতিত্ব অনায়াসে নেহরাকে দিয়ে দেন হার্দিক। প্রথম বছর খেলতে নেমেই আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে গুজরাত অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘‘গুজরাতকে নেতৃত্ব দেওয়াই শুধু নয়, ওখানে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছি কোচের সঙ্গে কাজ করে। আশিস ভাই আমার জীবনে বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন। আমার মানসিকতা বদলে গিয়েছে। হতে পারে আমরা আলাদা ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ক্রিকেটীয় ভাবনাচিন্তায় আমরা দু’জনেই এক জায়গায়।” অধিনায়ক হিসাবে সাফল্যের কৃতিত্বও নেহরাকে দিয়েছেন হার্দিক। এ নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘ওঁর সঙ্গে থাকার কারণে আমার নেতৃত্ব দিতে খুবই সুবিধা হয়েছে। নিজে যেগুলো জানতাম সেটা নিয়ে কোনও দিনই সন্দেহ ছিল না। আমার দরকার ছিল শুধু ভরসার। সেটা পাওয়ার পরে আর ভাবতে হয়নি। ক্রিকেট সম্পর্কে নেহরা ভাইয়ের জ্ঞানের ব্যাপারে আগেই জানতাম। আমি যা জানতাম সেটাকে সমর্থন করাই আসল ব্যাপার ছিল। আমাকে খুব সাহায্য করেছে ওটা।”
অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায় এক বার বদোদরাকে নেতৃত্ব দেওয়া হার্দিককে আইপিএলের সফল অধিনায়ক হিসাবে গড়ে তুলেছেন নেহরাই। পাশে থেকেছেন। ভুল শুধরে দিয়েছেন। সাহস দিয়েছেন। ভরসা দিয়েছেন। ব্যর্থতায় আড়াল করেছেন। সাফল্যে এগিয়ে দিয়েছেন। শুধু হার্দিকের পাশে নয়। নেহরা অন্যদেরও পাশে থেকেছেন। ভারতীয় ক্রিকেটের মূল স্রোত থেকে দূরে চলে যাওয়া ঋদ্ধিমান সাহাকেও গুরুত্ব দিয়েছেন।
নেহরাকে ছোট থেকে চেনেন বীরেন্দ্র সহবাগ। তিনি প্রাক্তন সতীর্থ সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘ক্রিকেটারদের সারা ক্ষণ কিছু না কিছু পরামর্শ দেয় নেহরা। এটাই সেরা পারফরম্যান্সের জন্য ওদের উপর চাপ তৈরি করে। প্রতি বলে ভুল শুধরে দেওয়ার পর কি আর ভুল করার সুযোগ থাকে?’’ নেহরার কোচিংয়ের এই ধরন তাঁরও অন্য রকম মনে হয়েছে। কার্স্টেন বলেছেন, ‘‘কোচ নেহরার ক্রিকেট মস্তিষ্ক যেমন পরিষ্কার তেমনই ঠান্ডা। এটাই ওর সাফল্যের রহস্য।’’
সবাইকে আত্মবিশ্বাস দিয়ে ভরসা আদায় করে নেওয়া কোচ নেহরার অন্যতম শক্তি। হার্দিক ছাড়াও রশিদ খান, মহম্মদ শামি, ডেভিড মিলার, শুভমন গিল, কেন উইলিয়ামসন, দাসুন শনাকার মতো নাম রয়েছে তাঁর দলে। বিভিন্ন দেশের নানা চরিত্রের ক্রিকেটারদের এক সুতোয় বেঁধে রাখাও কম কঠিন নয়। কোচ নেহরা সেটাও করছেন সাফল্যের সঙ্গে। তাই মাঠের বাইরে তিনিই যেন গুজরাতের অধিনায়ক।
গুজরাত তাঁকে কোচ করতে পারে শুনে অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন গত মরসুমের আগে। তাঁরা আরও বেশি বিস্মিত হয়েছিলেন কোচ নেহরার দল প্রথম বারই আইপিএল চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়।