প্রেরণা: ঋষভের রাজকীয় প্রত্যাবর্তনে রোমাঞ্চিত সৌরভ। অধিনায়কের মনোবল বাড়িয়ে চলেছেন ডিরেক্টর। ছবি: সমাজমাধ্যম।
বুধবার বিশাখাপত্তনমে কলকাতা নাইট রাইডার্স তাঁর প্রতিপক্ষ। বসবেন বিপক্ষ দিল্লি ক্যাপিটালসের ডাগআউটে। কলকাতার কাছে ফের সেই বিভাজনের ম্যাচ। তার আগে তিনি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য আচ্ছন্ন ঋষভ পন্থকে নিয়ে। ধোনির চেন্নাইকে হারানোর পরের দিন সমুদ্র উপকূলবর্তী বন্দর-শহরে বসে মোবাইল থেকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে।
প্রশ্ন: ঋষভ পন্থ টুইটারে ট্রেন্ডিং। আপনিও খুব আবেগপূর্ণ টুইট করেছেন। কী মনে হচ্ছে, ঋষভ ইজ় ব্যাক?
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: কাল যা খেলেছে, খুবই উৎসাহিত হওয়ার মতো। আমি বরাবরই ঋষভের ক্রিকেটের ফ্যান। আমার খুব পছন্দের ক্রিকেটার ও। এত বড় একটা দুর্ঘটনা থেকে ফিরছে। এই ইনিংসটা ওকে অনেক আত্মবিশ্বাস দেবে।
প্র: দেখে কী মনে হল, পুরনো ঋষভ ফেরার মুখে?
সৌরভ: এখনই সে রকম কিছু বলছি না। ছেলেটা সবে এত বড় দুর্ঘটনা থেকে মাঠে ফিরেছে। সবে তো তিনটে ম্যাচ খেলল। ওকে আর একটু সময় দেওয়া দরকার। এখনই খুব বড় কোনও মন্তব্য করে ওর উপরে চাপ বাড়াতে চাই না।
প্র: আজকের দিনে দাঁড়িয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ভারতীয় দল গড়তে হলে আপনি কি ঋষভকে নিতেন?
সৌরভ: শুনুন, ঋষভ পন্থ ফিট থাকলে যে কোনও ভারতীয় দলে চোখ বুজে ঢুকবে। শুধু টি-টোয়েন্টি নয়, সব ধরনের ক্রিকেটে ও অপরিহার্য। ছেলেটা বিদেশে গিয়ে কী সব ইনিংস খেলেছে দেখুন। কিন্তু আবার বলছি, ওকে একটু সময় দিন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল তো আজই করতে হচ্ছে না। ঋষভের মতো ম্যাচউইনার রোজ রোজ আসবে না। তাই ভারতীয় দলে ওর থাকা নিয়ে খুব বেশি কথা হওয়ার অবকাশ নেই। একই সঙ্গে বলতে চাই, এত তাড়াহুড়োই বা কীসের? ঋষভকে আর একটু ধাতস্থ হতে দিন না।
প্র: আপনি টুইট করেছেন, ঋষভ তুমি অনেক ভাল ইনিংস খেলেছ। আরও অনেক খেলবে। দলকে জেতাবে। কিন্তু এই ইনিংস বিশেষ ভাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সৌরভ: হ্যাঁ, আমার তাই মনে হয়। কী ভাবে বেঁচে ফিরেছে, সেই কাহিনি ওর মুখ থেকে শোনার পরে সত্যিই কাল দিল্লি ডাগআউটে বসে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। ছেলেটা শরীরে এতগুলো সেলাই নিয়ে তৃতীয় ম্যাচেই এ রকম ইনিংস খেলে দিল! এমন সব শট খেলল! অবিশ্বাস্য! পুরনো ঋষভের ফেরার কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমার মনে হয়, পুরনো ঋষভ পন্থকে ফেরানোর ব্যাপারে এই ইনিংস খুব বড় ভূমিকা নিতে চলেছে।
প্র: কেন এমন মনে হচ্ছে?
সৌরভ: কারণ, এত দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পরে এই ইনিংস ওকে অনেক সাহস দেবে। বিশ্বাস ফেরাবে যে, আমি এখনও পারি। মনের দিক থেকে যতই জেদি হোক বা সংকল্পে অটল থাকুক, মাঠে নেমে কাজটা নিজের হাতে করতে পারলে তার প্রভাবই আলাদা।
প্র: আপনি ভারত অধিনায়ক থাকাকালীন অনেক নতুন নতুন মুখ তুলে এনেছেন। হরভজন। সহবাগ। যুবরাজ। জাহির। প্রতিভার দিক থেকে ঋষভ পন্থকে কোথায় রাখবেন?
সৌরভ: উফ্, অসামান্য প্রতিভা। কারও থেকে পিছিয়ে রাখতে পারব না। এ রকম ম্যাচ জেতানো প্লেয়ার যে কোনও দলের, যে কোনও ক্যাপ্টেনের সম্পদ। ব্রিসবেনে কী রকম টেস্ট জিতিয়েছিল, মনে করুন। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সেঞ্চুরি করে এসেছে। ঋষভ আরও অনেক ম্যাচ জেতাবে ভারতের জার্সি গায়ে।
প্র: ঋষভকে কেন বিশেষ প্রতিভাসম্পন্ন মনে হয়?
সৌরভ: যে রকম শাসকের ভঙ্গিতে ও ফাস্ট বোলিংটা খেলে, তার জন্য। খুব বেশি ব্যাটসম্যানকে এ রকম রাজকীয় ভঙ্গিতে ফাস্ট বোলিং খেলতে দেখিনি।
প্র: টুইট যা করেছেন, সেটা তো সবাই দেখলাম। গত কাল ম্যাচের পরে ঋষভকে কী বললেন?
সৌরভ: বিশেষ কিছুই বলিনি। শুধু হাততালি দিচ্ছিলাম। জীবনের রাস্তায় কী ভয়ঙ্কর ঝড়-ঝঞ্ঝা কাটিয়ে উঠে এই ইনিংস খেলল ছেলেটা! কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। পরে শুধু একটাই কথা বললাম— চালিয়ে যাও। যত ম্যাচ খেলবে তত ছন্দে ফিরবে, তত বলগুলো উড়ে উড়ে গ্যালারিতে গিয়ে পড়বে।
প্র: ঋষভের এই প্রত্যাবর্তন তো একদম কাছ থেকে দেখলেন। কতটা কঠিন ছিল এই লড়াই?
সৌরভ: খুব কঠিন, খুবই কঠিন। ভীষণ মনের জোর, জেদ আর ইচ্ছাশক্তি না থাকলে এ ভাবে ফেরত আসা যায় না। সেই মূহূর্তটার কথা ভাবলে এখনও তো বুক কেঁপে ওঠে। সারা ভারত যে দিন ঘুম থেকে উঠে জানল, ঋষভ পন্থ ভয়ানক গাড়ি দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত। জীবন-মৃত্যুর লড়াই চলছে হাসপাতালে। সেখান থেকে মাঠে ফেরত আসা আর তৃতীয় ম্যাচেই এ রকম ইনিংস খেলা চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। ঋষভের প্রতিভা, দক্ষতা নিয়ে কখনও কারও সন্দেহ ছিল না। শুধু এটাই দেখার ছিল যে, দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে ফিরে কী ভাবে নিজেকে আবার ফিট করে তুলতে পারে। কত তাড়াতাড়ি নিজেকে সর্বোচ্চ স্তরের জন্য তৈরি করতে পারে। এখনও পর্যন্ত যা দেখেছি, খুবই আশাবাদী আমি।
প্র: ঋষভের বয়স ২৬। একই দিনে ৪৩ ছুঁই ছুঁই এক উইকেটকিপার মাতিয়ে দিয়ে গেলেন। ১৬ বলে ৩৭। তিনটে ছক্কা। স্ট্রাইক রেট ২৩১.২৫। মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে নিয়ে কী বলবেন?
সৌরভ: বলব এটাই যে, বয়স সব কিছু কেড়ে নিতে পারে না আবার প্রমাণ হল। অভিজ্ঞতার কোনও বিকল্প নেই, আবার দেখা গেল। দারুণ ব্যাট করেছে। ধোনি যে মারতে পারে, তা নতুন কিছু নয়। তবে এই বয়সে নেমে এ রকম খেলে দেবে, সেটা হয়তো কেউ ভাবেনি।
প্র: ধোনি কি এখনও ম্যাচ জেতাতে পারবেন?
সৌরভ: কাল তো দারুণ খেলল। আইপিএলের এখনও অনেক ম্যাচ বাকি। সময়ই বলে দেবে।
প্র: দিল্লির পরের ম্যাচ তো কেকেআরের বিরুদ্ধে। এই ম্যাচটা এলে কী রকম একটা মনে হয় না যে, কলকাতার বিপক্ষ দলের ডাগআউটে গিয়ে বসছি?
সৌরভ: অনেক বছর তো হয়ে গেল। এখন আর ও সব মনে হয় না।
প্র: কী বলছেন? আইপিএল শুরু হয়েছিল কলকাতার ব্লকবাস্টার জুটি দিয়ে। আপনি আর শাহরুখ খান এক সঙ্গে। সেখান থেকে দু’জনার পথ দু’টি দিকে...
সৌরভ: দু’টি পথ তো অনেক কাল হল দু’টি দিকে। আমি দিল্লি ডাগআউটে বসছি, অনেক বছর হয়ে গেল। নতুন করে আর কী অনুভূতি হবে এ নিয়ে!
প্র: যদি এই ম্যাচটার পূর্বাভাস জানাতে হয়, কাদের এগিয়ে রাখবেন?
সৌরভ: গত বার আমরা জিতেছি। তার আগের বছর দু’বারে দু’বারই হারিয়েছি কেকেআর-কে। তবে বুধবার নতুন দিন, নতুন দ্বৈরথ। কেকেআর এ বারে ভাল দল। দু’টোতে দু’টোই জিতেছে। আমরাও শেষ ম্যাচে জিতে নামছি। ভাল ম্যাচ হবে।
প্র: কেকেআর ভাল টিম বলতে দিল্লি ডিরেক্টরের নোটবুকে বিশেষ কার কার নাম লেখা থাকবে যে, এদের কিছু করতে দেওয়া যাবে না। রাসেল? রিঙ্কু? নাকি সুনীল নারাইন?
সৌরভ: ও ভাবে এক জন-দু’জনকে নিয়ে ভেবে তো আর মাঠে নামা যায় না। পুরো দলটাকে নিয়ে আলোচনা করতে হয়। কেকেআর ভাল দল। অনেকে ভাল প্লেয়ার আছে। শ্রেয়স আয়ার এ বার ফিরেছে। গৌতম গম্ভীর দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ওদের ব্যাটিং, বোলিং দুটোই ভাল। আমাদের পরের ম্যাচের টিম মিটিং এখনও হয়নি। দেখা যাক, কী আলোচনা হয়।
প্র: মিচেল স্টার্ককে এত টাকা দিয়ে নিয়ে এসে কী লাভ হল, এই প্রশ্ন ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। আপনার কী মনে হয়? এতে কেকেআরের বোলিংয়ের উপরে চাপ বাড়ছে না? প্লিজ় বলবেন না যে, কেকেআর দারুণ টিম আর আপনাদের টিম মিটিং হয়নি।
সৌরভ: নিলামে তো এ রকমই হয়। কার যে কখন কত দর উঠে যায়, কেউ বলতে পারে না। স্টার্কের তাই হয়েছে। প্যাট কামিন্সের হয়েছে। আইপিএল সবে শুরু হয়েছে। এখনও অনেক ম্যাচ বাকি। কার কী রকম মরসুম যাবে, তা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য আর একটু অপেক্ষা করা দরকার।
প্র: দু’টো হারের পরে জয়। তার উপরে চেন্নাই সুপার কিংসের মতো দলকে হারানো। দিল্লি শিবিরে নিশ্চয়ই ফুরফুরে মেজাজ?
সৌরভ: ভাল জিতেছি আমরা। তাই শিবিরে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। দ্বিতীয় ম্যাচটাও (রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে) আমাদের জেতা উচিত ছিল। তবে এখনও অনেক পথ বাকি। এখনই বেশি উত্তেজিত হওয়ার কিছু হয়নি।
প্র: দু’টো ম্যাচ হারার পর দলকে কী বলেছিলেন?
সৌরভ: বলেছিলাম, বিশ্বাস রাখো নিজেদের দক্ষতায়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ক্লোজ় ম্যাচ হবেই। কাছাকাছি এসে হারতে হয়। তার মানে এই নয় যে, সেই দলটা খারাপ হয়ে গেল।
প্র: ঋষভের মতো পৃথ্বী শ-ও ফিরলেন। আর এক উজ্জ্বল প্রতিভা। কিন্তু হারিয়ে যাচ্ছেন। পৃথ্বীর ভবিষ্যৎ নিয়ে কী মনে হচ্ছে?
সৌরভ: আমার বিশ্বাস, পৃথ্বী ফিরবে। ওকেও সেই বিশ্বাস রাখতে হবে। ওর ফিটনেস নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল তাই প্রথম দুই ম্যাচে খেলানো যায়নি। গত কালের ম্যাচে ভাল খেলেছে। তবে পৃথ্বীকে বুঝতে হবে, টি-টোয়েন্টি মানেই সব বলে মারতে গেলে চলবে না। ইনিংস গড়ার দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্র: এ বারের আইপিএলে কাদের ভাল দল বলে মনে হচ্ছে?
সৌরভ: কেকেআর ভাল। রাজস্থান, চেন্নাইও ভাল খেলছে। আইপিএলে কোন দল খারাপ? কবে যে কে খেলে দেবে!
প্র: আইপিএল জিততে হলে কোন জিনিসটা সব চেয়ে বেশি করে দরকার?
সৌরভ: ধারাবাহিকতা। যে দল টানা ছন্দ ধরে রাখতে পারবে,
তারাই জিতবে।