ফুটবলে একুশে আইন। প্রতীকী ছবি
সুকুমার রায়ের ‘একুশে আইন’ এ বার ফুটবল মাঠে!
ইংল্যান্ডের ফুটবল ক্লাব অ্যাস্টন ভিলার কোচ স্টিভেন জেরার্ড দলের ফুটবলারদের জন্য যে নিয়ম চালু করেছেন, তাকে ‘একুশে আইন’ বললেও কম বলা হয়।
কী নিয়ম চালু করেছেন জেরার্ড?
সম্প্রতি নেটমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে অ্যাস্টন ভিলার জরিমানার একটি তালিকা। তাতে ১৮টি অপরাধের একটা সারণী তৈরি করা হয়েছে। একেক রকম নিয়মভঙ্গের ক্ষেত্রে জরিমানা একেক রকম। তার মধ্যে বিচিত্র কিছু অপরাধ এবং তার জরিমানার অঙ্কও লেখা রয়েছে।
যেমন, অনুশীলনে দেরি করে এলে দিতে হবে ৫০০ পাউন্ড (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪৮,২০৯ টাকা) জরিমানা। তার সঙ্গেই অনুশীলনের দেরি করে নামলে প্রতি মিনিটের জন্য ২০০ পাউন্ড (প্রায় ১৯,২০০ টাকা) করে গুণাগার দিতে হবে। ম্যাচের দিন দলের বৈঠকে যোগ দিতে দেরি হলে জরিমানার অঙ্ক এক লাফে বেড়ে ১০০০ পাউন্ড (প্রায় ৯৬৪০০ টাকা) হয়ে যাবে। এমনকী কোচও যদি দেরি করেন, তাঁকেও মোটা পাউন্ড গুনতে হবে। এখানেই শেষ নয়। ম্যাচের দিন অন্য পোশাক পরে এলে, ভুল জায়গায় গাড়ি রাখলে, টেবিলে কাপ, প্লেট ফেলে গেলে শাস্তি পেতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই জরিমানার অঙ্ক আলাদা।
পাশাপাশি, খেলার সময় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে কোনও ফুটবলার হলুদ কার্ড দেখলে তাঁকে পর দিন ২০০ পাউন্ড দিতে হবে। ম্যাচের দিন কোনও ফুটবলার লাল কার্ড দেখলে তাঁকে চার সপ্তাহের মধ্যে গোটা দলকে নিয়ে নৈশভোজে নিয়ে যেতে হবে।
আরও কিছু বিচিত্র অপরাধের ক্ষেত্রেও ফুটবলারদের জরিমানা দিতে হবে। যেমন, কোনও খেলোয়াড় যদি নিজের জন্মদিনে কেক আনতে ভুলে যান তাঁকে ৫০ পাউন্ড জরিমানা দিতে হবে। স্নান করার সময় খালি পায়ে থাকলে সেই ফুটবলারের জরিমানা ১০০ পাউন্ড। নির্দিষ্ট জুতো পরেই ফুটবলারদের স্নান করতে হবে। যিনি অনুশীলনে সবচেয়ে খারাপ খেলবেন, তাঁকে পর দিনের একটি বিশেষ জার্সি পরতে হবে, যাতে লেখা থাকবে, ‘আমি অনুশীলনে সবচেয়ে খারাপ খেলেছি।’
@MarcusMergulhao @debapriya_deb @TOISportsNews and other journalists - does our professional football clubs have a similar arrangement to bring in more professionalism? Just curious pic.twitter.com/yz5aS7vvij
— αүαη мαנυм∂αя (@ayanhere) July 29, 2022
ভারতেও কোচেদের এমন অনুশাসনের উদাহরণ রয়েছে। কোচিং জীবনে যথেষ্ট কড়া ছিলেন সৈয়দ নঈমুদ্দিন। তাঁর দাপটে শুধু ফুটবলাররাই নন, তটস্থ হয়ে থাকতেন কোচেরাও। সাফল্য পেতে বরাবর মরিয়া হয়ে থাকতেন নঈম। তাই শৃঙ্খলার ব্যাপারে কোনও দিন আপস করেননি। খেলোয়াড়দের মাথা যাতে ঘুরে না যায়, তাঁরা শুধু খেলাতেই ফোকাস করেন, সেটা নিশ্চিত করতেন নঈম। তাঁর আমলে কোনও ফুটবলার বড় চুল রাখতে পারতেন না। ছোট করে চুল কেটে আসতে হত। রাতে পার্টি করার অনুমতি ছিল না। ফিটনেসকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। সঠিক খাওয়া-দাওয়া এবং কড়া অনুশীলনে বিশ্বাস করতেন নঈম। ফুটবলারদের নির্দেশ দেওয়া হত শুধুই মিনারেল ওয়াটার খাওয়ার। এ ছাড়া, রোজকার খাবারে যাতে প্রচুর ভিটামিন থাকে সেটা নিশ্চিত করতেন তিনি। অনেক সময় নঈমের অনুশীলনে হাঁফিয়ে পড়তেন ফুটবলাররা। তবে তাঁরা জানতেন, কোচ যেটা বলছেন সেটা মেনে চললে আখেরে লাভ হবে তাঁদেরই।
এ ছাড়াও, কোনও প্রতিযোগিতা চলাকালীন সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ফুটবলারদের কথা বলতে দিতেন না। নিজেও বলতেন না। কোনও দিন সাংবাদিকদের সামনে নিজের দলের কোনও ফুটবলারকে আলাদা করে দোষ দেননি। তিনি বরাবর চাইতেন, টাকা দেখে ফুটবলারদের মাথা যেন ঘুরে না যায়।
নঈমের অধীনে ইস্টবেঙ্গলে খেলেছেন বিকাশ পাঁজি। প্রাক্তন এই ফুটবলার আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “শৃঙ্খলার ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে কারওর তুলনা হয় না। ছোট করে চুল কাটা, ফুটবলারদের ড্রাই ফ্রুট, ভিটামিনযুক্ত খাবার খাওয়ার নির্দেশ দেওয়া, নিয়মনিষ্ঠার মধ্যে থাকার নির্দেশ দিতেন সব সময়। আমরাও জানতাম, উনি যেটা বলতেন সেটা ভালর জন্যেই। তবে এখনকার দিনে এই কঠোর নিয়ম বলবৎ করা কঠিন। আমার মতে, এখনকার ফুটবলাররা কে কেমন চুল কাটবে, কে কী পোশাক পরবে, সেটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। কোচ তাঁদের থেকে পারফরম্যান্স চায়। সেটা দিতে পারলেই হল। ফুটবলারের ব্যক্তিগত জীবন তার নিজস্ব। সেখানে কোচের ঢোকা উচিত বলে মনে হয় না।”
বিকাশ আরও বললেন, “আমরা যখন খেলতাম তখন উনি এতটা কড়া ছিলেন না। তবে পরের দিকে ওঁর নিয়মকানুন অনেক কঠোর হয়ে গিয়েছিল। এক বার রোভার্স কাপে প্রথম ম্যাচ খেলার পর খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম আমরা। ডেম্পোর কাছে হেরে গিয়েছিলাম। নৈশভোজে উনি আমাদের সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা বলেন। তাতে ফুটবলাররা আত্মবিশ্বাস পায়। দলের থেকে ওঁর প্রত্যাশা থাকত অনেক।”
ফুটবলারদের কড়া অনুশাসনে রেখে যে খুব লাভ হবে, এমনটা মনে করেন না সুব্রত ভট্টাচার্যও। দুই প্রধানেই কোচিং করানো প্রাক্তন এই ফুটবলার বলেছেন, “মোহনবাগানকে আমি ৩৮টা ট্রফি দিয়েছি। যে ক্লাবেই গিয়েছি ট্রফি জিতেছি। টালিগঞ্জ অগ্রগামীর কোচ থাকার সময়ও সাফল্য পেয়েছি। কোনও দিন কড়া অনুশাসনের দরকার পড়েনি। আমি বা সুভাষ ভৌমিক কড়া কোচ হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। কিন্তু ফুটবলারদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল।”
কিছু দিন আগেই ইস্টবেঙ্গলের কোচ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে স্টিভন কনস্টানটাইনের নাম। আগে ভারতীয় দলে দু’দফায় কোচিং করিয়ে গিয়েছেন তিনি। প্রথম থেকেই কড়া কোচ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বার কোচ থাকাকালীন ২০০৩ সালে উত্তর কোরিয়া থেকে খেলে ফেরার পথে চিনে কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করেছিল ভারতীয় দল। তখন ফুটবলার জো পল আনচেরি এবং সহকারী কোচ ভিপি সাথিয়ানকে জরিমানা করেছিলেন কনস্টানটাইন। তাঁদের অপরাধ? কোচের অনুমতি না নিয়ে কেনাকাটা করতে চলে গিয়েছিলেন! ২০১৯-এ আমিরশাহিতে এশিয়ান কাপ চলাকালীন এক বার সহকারী কোচ সম্মুগম বেঙ্কটেশ দেরি করে আসায় তাঁকে ছাড়াই টিম বাস ছেড়ে দিয়েছিলেন। সুদানের কোচ থাকাকালীন সে দেশের সেরা ফুটবলার ফয়সাল আগাব প্রস্তুতি শিবিরে এক দিন দেরি করে এসেছিলেন বলে তাঁকে দলেই নেননি।
কনস্টানটাইনের অধীনে জাতীয় দলে খেলেছেন অর্ণব মণ্ডল। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘কনস্টানটাইন বিশৃঙ্খলা পছন্দ করতেন না। মাঠে নেমে ভাল খেলা ছাড়াও অন্যান্য ছোটখাটো বিষয়ে তাঁর কড়া নজর ছিল। সঠিক সময়ে অনুশীলনে আসা, গা-ছাড়া মনোভাব না দেখিয়ে কঠোর পরিশ্রম করা, অনুশীলন শেষে কোনও জিনিস মাঠে ফেলে না আসা — এ সব ব্যাপারে ওঁর কড়া নজর ছিল। অনেককেই উনি জরিমানা করেছেন।”
শুধু তাই নয়, ইস্টবেঙ্গলের কোচ থাকাকালীন ট্রেভর জেমস মর্গানও ফুটবলারদের জরিমানা করতেন বলে জানালেন অর্ণব। তাঁর কথায়, “মর্গান স্যরও খুব শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন। ফুটবলারদের অনুশাসনে রাখতে পছন্দ করতেন। ওঁর সময়েও জরিমানার ব্যাপারটা ছিল। অপরাধের ধরন অনুযায়ী ২০০ থেকে ৫০০ টাকা জরিমানা করতেন উনি।” আধুনিক ফুটবলে কোচেদের কঠোর অনুশাসন কতটা সফল? এ প্রশ্নের উত্তরে অর্ণব বলেছেন, “প্রত্যেক কোচের মানসিকতা আলাদা। ফুটবলারদের তাঁরা কী ভাবে পরিচালনা করছেন, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ম্যান ম্যানেজমেন্ট আধুনিক ফুটবলে খুবই জরুরি। জেরার্ড অ্যাস্টন ভিলায় যে নিয়ম চালু করেছে, একই জিনিস আমরা দেখেছি চেলসির প্রাক্তন কোচ ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড বা বার্সেলোনার কোচ জাভির ক্ষেত্রেও। ফুটবলারদের উপর প্রভাব পড়েই। কারণ, ১৭-১৮ বছর বয়সে কোনও ফুটবলার সিনিয়র দলে এলে তখন থেকেই শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়ে যায়। পরের দিকে তার আর কোনও অসুবিধা হয় না।”
বিদেশেও উদাহরণ কম নেই। ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের নতুন কোচ এরিক টেন হ্যাগ ক্লাবের ফুটবলারদের অনুশাসনে রাখতে অনেক নিয়ম জারি করেছেন। আয়াক্স আমস্টারডামের কোচ থাকাকালীন তরুণ ফুটবলারদেরও বিভিন্ন নিয়মশৃঙ্খলার জালে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সফল কোচ জোসে মোরিনহো বিভিন্ন ক্লাবে গিয়ে কড়া নিয়ম চালু করেছেন। মাঝেমধ্যে সফলও হয়েছেন।
গত মরসুমে ১৪ নম্বরে শেষ করেছিল অ্যাস্টন ভিলা। জেরার্ডের ‘একুশে আইন’ এ বার তাদের ভবিষ্যৎ বদলাতে পারে কি না, সেটাই এখন দেখার। জরিমানা দিতে দিতে কোনও ফুটবলারের পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে কিনা, দেখার রয়েছে সেটাও।