Rahul Dravid

বন্যেরা বনে সুন্দর, দ্রাবিড় ছোটদের প্রশিক্ষণে! রাহুল কি বেমানান দাদাদের দলে?

ভারতের ছোটদের দলে কোচ হিসাবে সফল রাহুল দ্রাবিড় বড়দের দলে ব্যর্থ। কেন একের পর এক আইসিসি প্রতিযোগিতায় সাফল্য পাচ্ছেন না তিনি? নেপথ্যে কী কারণ?

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৩ ১২:০৯
Rahul Dravid

রাহুল দ্রাবিড়। —ফাইল চিত্র

তিনি যখন ভারতীয় দলের কোচের দায়িত্ব নেন, তখন সবাই ভেবেছিলেন, এ বার হয়তো আইসিসি ট্রফির খরা কাটবে। কারণ, তার আগের কয়েক বছরে ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ ও ‘এ’ দলের হয়ে তিনি যে সাফল্য দেখিয়েছিলেন, তা আশা জাগিয়েছিল সমর্থকদের মনে। কিন্তু বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের কোচ হওয়ার পরে যেন সেই ‘জাদুকাঠি’ বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতেই রেখে এসেছেন রাহুল দ্রাবিড়। নইলে গত ১৯ মাসে দু’-তিনটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় ছাড়া আর কী জিততে পেরেছেন তিনি? তিনটি আইসিসি প্রতিযোগিতা খেলে তিনটিতেই হারতে হয়েছে তাঁর দলকে।

দ্রাবিড়ের পূর্বসূরি রবি শাস্ত্রীর কোচিংয়ে ৪২ মাস ধরে টেস্টের শীর্ষস্থান ধরে রেখেছিল ভারত। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে দু’বার অস্ট্রেলিয়াকে টেস্ট সিরিজ়ে হারিয়েছিল তারা। কিন্তু আইসিসি প্রতিযোগিতায় ট্রফি জিততে না পারার কারণেই চাকরি যায় শাস্ত্রীর। দ্রাবিড়েরও পরীক্ষা ছিল সেই আইসিসি ট্রফি জয়। দায়িত্ব নেওয়ার পরে শুরুতেই নিউ জ়িল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ও শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে সিরিজ় জেতে ভারত। দলের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় পান দ্রাবিড়। তাঁর প্রথম বড় পরীক্ষা হয় দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ়ে। প্রথম টেস্ট জেতার পরেও সিরিজ়ে হারতে হয় ভারতকে। তার পরেই টেস্ট অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন কোহলি। তিন ফরম্যাটেই অধিনায়ক হন রোহিত।

Advertisement

শাস্ত্রীর অধীনে ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ়ে ২-১ এগিয়ে ছিল ভারত। কোভিডের কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া বার্মিংহ্যাম টেস্ট পরে হয়। তখন দ্রাবিড় কোচ। সেই ম্যাচও হেরে যায় ভারত। ফলে সিরিজ় ড্র হয়। এমনকি বাংলাদেশের কাছেও ১-২ ফলে এক দিনের সিরিজ় হারতে হয় ভারতকে।

দ্বিপাক্ষিক সিরিজ়ে হারের ধাক্কা কাটতে না কাটতেই খেলতে হয় পর পর তিনটি আইসিসি প্রতিযোগিতা। প্রথমে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ১০ উইকেটে লজ্জার হার। তার পরেই এশিয়া কাপ। সেখানেও সুপার ফোরে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে ছিটকে যায় দল। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে ব্যর্থতা কাটানোর সুযোগ ছিল। বিশেষ করে তার আগে বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি জেতায় এগিয়ে থাকার কথা ছিল ভারতের। কিন্তু কোথায় কী? প্রথম দিনই খেলার ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ২০৯ রানে হারতে হয়েছে কোহলি, রোহিতদের।

কিন্তু কেন বার বার বড় প্রতিযোগিতায় হারতে হচ্ছে দ্রাবিড়ের দলকে? কোথায় সমস্যা? অনেকগুলি কারণ রয়েছে।

দেশের মাটিতে খারাপ পিচে খেলা

২০২১ সালে কানপুরে পঞ্চম দিনে নিউ জ়িল্যান্ডকে অলআউট করতে পারেনি ভারতীয় বোলিং। মন্থর উইকেটে রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও রবীন্দ্র জাডেজার স্পিন জুটি ব্যর্থ হয়। তার পরেই দ্রাবিড় বুঝতে পারেন, বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে উঠতে এমন উইকেট বানাতে হবে যেখানে ভারতীয় স্পিনাররা সুবিধা পাবেন। তারই ফসল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে নাগপুর, ইনদওরের উইকেট, যেখানে আড়াই দিনেই টেস্ট শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রথম ওভার থেকে স্পিনারদের হাতে বল তুলে দেওয়া হয়েছে। এই সব পিচে খেলে কী ভাবে ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ার পিচে খেলার প্রস্তুতি সারতে পারবেন ভারতীয় ক্রিকেটাররা? ফলে সুইং, রিভার্স সুইংয়ের সামনে সমস্যায় পড়ছেন ভারতীয় ব্যাটাররা। যে পিচে অস্ট্রেলিয়া ৪০০-র উপর রান তুলছে সেখানে ৩০০ করতে হিমশিম খাচ্ছেন কোহলি, রোহিতরা।

ক্রিকেটার বাছাইয়ে গলদ

গত বছর টেস্ট দলের উইকেটরক্ষক ঋদ্ধিমান সাহাকে দ্রাবিড় জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে আর ভাবনায় রাখছে না ম্যানেজমেন্ট। অথচ তখনও ক্রিকেটীয় দক্ষতায় বিশ্বের সেরা উইকেটরক্ষক ছিলেন ঋদ্ধি। দ্রাবিড় চেষ্টা করলেন শ্রীকর ভরতকে তুলে আনার। কিন্তু তিনি না উইকেটের পিছনে ভাল, না সামনে। ভরত যে পাঁচটি ম্যাচ খেলেছেন তাতে তাঁর ব্যাটিং ঋদ্ধির থেকেও খারাপ। আইপিএলেও ভরতের আগে ঋদ্ধিকে সুযোগ দেয় গুজরাত। অথচ দ্রাবিড় রয়েছেন ভরত নিয়েই। ঋদ্ধির পাশাপাশি ইশান্ত শর্মাকেও একই বার্তা দেন দ্রাবিড়। তিনি তুলে আনার চেষ্টা করেন প্রসিদ্ধ কৃষ্ণকে। সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ। কারণ, চোটে দীর্ঘ দিন মাঠের বাইরে প্রসিদ্ধ। তা ছাড়া যশপ্রীত বুমরা চোট পাওয়াতেও সমস্যায় পড়েছেন ভারতীয় কোচ।

ক্রিকেটারদের সাপ্লাই লাইন বন্ধ

দ্রাবিড় যখন ছোটদের দায়িত্বে ছিলেন তখন বড়দের দলের জন্য ক্রিকেটারদের একটি সাপ্লাই লাইন তৈরি করেছিলেন। অর্থাৎ, প্রধান দলের কোনও প্লেয়ার চোট পেলে তাঁর একাধিক বিকল্প তৈরি থাকত। গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় চতুর্থ টেস্টে ভারতীয় দলের অন্তত ৬ জন প্লেয়ার চোটে ছিটকে গিয়েছিলেন। প্রধান বোলারদের কেউ ছিলেন না। তার পরেও টেস্ট খেলেছিল ভারত। জিতেওছিল। কিন্তু যে দিন থেকে দ্রাবিড় ভারতীয় দলের কোচ হয়েছেন, ক্রিকেটারদের সাপ্লাই লাইন কোথাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নইলে কেন আইপিএলে চোটে থাকা উমেশ যাদবকে খেলাতে হবে টেস্ট বিশ্বকাপে। বাকি কোনও জোরে বোলারকে কি তৈরি করা যায়নি!

ক্রিকেটারদের মানসিকতায় বদল

শুধু ক্রিকেটার বাছাই নয়, বদলে গিয়েছে দলের মানসিকতাও। শাস্ত্রী জমানায় অনেক বেশি আগ্রাসী ক্রিকেট খেলত ভারত। কোহলির আগ্রাসন বাকি ক্রিকেটারদের মধ্যেও দেখা যেত। চোখে চোখ রেখে লড়াই হত। কোথায় যেন সেই আগ্রাসনটা উধাও হয়ে গিয়েছে। দ্রাবিড় বরাবরই শান্ত প্রকৃতির। রোহিতও মাঠে হাসিমুখেই থাকেন। বিপক্ষ অধিনায়ক বা ক্রিকেটারদের সঙ্গে খুব একটা বিবাদে জড়ান না। ফলে কোথাও একটা ঠান্ডা মানসিকতা ছড়িয়ে পড়েছে দলে। এখনকার ক্রিকেটে তা বেমানান। তার খেসারত হয়তো দিতে হচ্ছে দলকে।

শোনা যায়, দ্রাবিড়কে যখন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের বোর্ড ভারতীয় দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব দেয় তখন শুরুতে কিছুটা ইতস্তত করেছিলেন তিনি। ছোটদের সঙ্গে খুব ভাল মিশতে পারেন তিনি। তাঁদের হাতে ধরে শেখাতে পারেন। বড়দের ক্রিকেটে তিনি মানিয়ে নিতে পারবেন কি না সেই প্রশ্ন জেগেছিল দ্রাবিড়ের মনে। বন্যেরা যেমন বনে সুন্দর, দ্রাবিড়ও ভারত ‘এ’ দলে মানানসই। কিন্তু বড়দের ক্রিকেটে তাঁকে ঠিক মানাচ্ছে না। কারণ, কোহলি, রোহিতদের টেকনিক শেখানোর থেকে পরিকল্পনা ও সাজঘরের পরিবেশ ঠিক রাখা কোচের সব থেকে বড় কাজ। সেখানেই কি কিছুটা সমস্যা হচ্ছে দ্রাবিড়ের! কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত, যা দীর্ঘ মেয়াদে দলের ভাল করতে পারে, তা নিতে পারছেন না তিনি। সেই কারণেই কি বড় প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ হতে হচ্ছে!

দ্রাবিড় হয়তো নিজেকে প্রমাণ করার আর একটিই সুযোগ পাবেন। চলতি বছরের শেষে দেশের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপ। শেষ বার যখন দেশের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপ হয়েছিল তখন চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। এ বারও মঞ্চ তৈরি। কোহলি, রোহিতরা পরের বিশ্বকাপ খেলবেন কি না নিশ্চিত নয়। তাই এ বারই আইসিসি ট্রফি জিততে চাইবেন তাঁরা। এখন থেকেই জল্পনা শুরু হয়েছে দ্রাবিড়ের অপসারণের। বোর্ডের অন্দরেও কেউ কেউ নাকি তাঁর কাজে খুশি নন। এক দিনের বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি আছে দ্রাবিড়ের। ক্রিকেটার দ্রাবিড়ের উপর ভরসা রাখত গোটা দেশ। কোচ দ্রাবিড়ের উপরেও হয়তো আরও এক বার ভরসা রাখবে সবাই। কিন্তু ওই এক বারই।

আরও পড়ুন
Advertisement