(বাঁ দিকে) ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ হাতে কপিল দেব, মহিন্দর অমরনাথ। হতাশ জেসন হোল্ডার (ডান দিকে) । ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ এবং টুইটার।
১৯৮৩, লর্ডস। ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয় কপিল দেবের ভারতের। যে দল আগের দু’টি বিশ্বকাপ জিতেছিল, ক্রিকেট বিশ্ব শাসন করছিল, সেই দলকে হারিয়ে দেন কপিলেরা। সেখান থেকেই কি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের পতন শুরু হয়ে গিয়েছিল? ৪০ বছর আগের সেই হার অবশ্যই শনিবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার কোনও কারণ নয়। ওই ঘটনা শুধু একটি ম্যাচের ব্যাপার ছিল। ১৯৮৩-র বিশ্বকাপের পরই ক্যারিবিয়ান দল ভারতে এসে দুরমুশ করেছিল কপিলদের। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের পতনের পিছনে কারণ অনেক গভীর।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের প্রাক্তন পেসার উইনস্টন বেঞ্জামিন এক বছর আগে সচিন তেন্ডুলকরের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের তৃণমূল স্তরে উন্নতি চেয়েছিলেন বেঞ্জামিন। সচিনকে কি কোচ করতে চেয়েছিলেন? না। নিজের অ্যাকাডেমির জন্য সচিনের কাছে অর্থভিক্ষা করেছিলেন বেঞ্জামিন। ক্রিকেটের সরঞ্জাম চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, একটি ব্যাট হলেও চলবে। তরুণ ক্রিকেটারদের হাতে ব্যাট তুলে দেওয়ার জন্য সচিনের কাছে বেঞ্জামিনের এটিই ছিল কাতর আবেদন। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেটের অবস্থা বোঝার জন্য মনে হয় এই ঘটনাটাই যথেষ্ট।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ় মানেই ছিল সাদা চামড়ার রাজত্বে কালো চামড়ার শাসন। কোর্টনি ওয়ালস, কার্টলি অ্যামব্রোজ, মালকম মার্শালের নাম শুনলে এখনও দুঃস্বপ্ন দেখেন ব্যাটারেরা। তাঁদের বাউন্সারের ভয় কাঁপতেন সবাই। ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডসেরা ব্যাট হাতে বিশ্ব শাসন করতেন। ১৯৭৫ এবং ১৯৭৯ সালে বিশ্বকাপ জিতে তাঁরা প্রমাণও করে দিয়েছিলেন সেটা। কিন্তু এখন কেমার রোচ, জেসন হোল্ডার, আলজারি জোসেফদের নাম কষ্ট করে মনে রাখতে হয়। ব্র্যান্ডন কিং, জনসন চার্লসের মতো ব্যাটারদের আইসিসি-র ক্রমতালিকায় খুঁজে পাওয়া যায় না। সাদা বলের ক্রিকেটে কোনও ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার প্রথম ১০ জনে নেই। তবু পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো টেস্টে অলরাউন্ডারদের তালিকায় ষষ্ঠ এবং সপ্তম স্থানে রয়েছেন যথাক্রমে জেসন হোল্ডার এবং কাইল মেয়ার্স। তাঁরা ছাড়া আর কেউ ক্রমতালিকায় নেই।
টানা দু’বারের বিশ্বকাপজয়ী দলের এ বার বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে না পারা, এটা এক দিনের ঘটনা নয়। অরুণ লাল ভারতের হয়ে তাঁর শেষ ম্যাচ খেলেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বিরুদ্ধেই। তিনি আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “সেই সময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ় চ্যাম্পিয়ন দল ছিল। কী অসম্ভব প্রতিভাবান সব ক্রিকেটার! ব্যাটিংয়ে রিচার্ডস, লয়েডরা ছিল। বল হাতে মার্শাল, ওয়ালসের মতো ক্রিকেটারেরা ছিল। যে কোনও দলকে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার মতো শক্তিশালী। পর পর দু’বার বিশ্বকাপ জিতেছিল। এ বার তারাই নেই!”
ইডেনে ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। কিন্তু এ বার ভারতের মাটিতে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ খেলতেই আসা হবে না। ক্যারিবিয়ান দল এ ভাবে পিছিয়ে পড়ছে কেন? অরুণ লাল বললেন, “এটা এক দিনের ঘটনা নয়। দীর্ঘ দিন ধরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেট মানচিত্র থেকে পিছিয়ে যাচ্ছিল। ওদের দেশের তরুণেরা অ্যাথলেটিক্স, বাস্কেটবলের মতো খেলার দিকে বেশি ঝুঁকছে। আর্থিক ভাবে আমেরিকার দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা। সেই দেশে ক্রিকেট খুব বেশি গুরুত্ব পায় না। তাই ক্যারিবিয়ানেরাও ক্রিকেট নয়, অন্য খেলায় মেতে থাকে।”
ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে যে বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্ব খেলতে হবে, সেটাই ছিল অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা। সেই যোগ্যতা অর্জন পর্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ় হেরে যায় নেদারল্যান্ডস, জ়িম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে। সুপার সিক্সে উঠে ক্যারিবিয়ানেরা হারে স্কটল্যান্ডের কাছে। নেদারল্যান্ডস এবং স্কটল্যান্ডের মতো ক্রিকেট বিশ্বের দুধের শিশুদের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের হার এখন আর অঘটন নয়।
এর পিছনে কী কারণ? অবশ্যই ঘরোয়া ক্রিকেট। ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট বোর্ড এবং ম্যানেজমেন্টের পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। আগামী দিনের কথা ভেবে কাজ করার মতো দিশা দেখা যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে বড় সমস্যা আইপিএল-সহ সারা বিশ্বের টি-টোয়েন্টি লিগে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটারদের খেলতে চলে যাওয়া। নিজের দেশের হয়ে খেলার আগ্রহ দেখা যায় না সুনীল নারাইন, কায়রন পোলার্ড, আন্দ্রে রাসেলদের। ক্রিস গেলের মতো ক্রিকেটার দেশের হয়ে না খেলে বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি লিগে সময় দেন। পুরোটাই অর্থের কারণে। কিন্তু এটা ক্ষতি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের।
প্রথম সারির ক্রিকেটারদের বিভিন্ন দেশের টি-টোয়েন্টি লিগে খেলতে চলে যাওয়া নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রাক্তন অধিনায়ক এবং এই দলের সদস্য জেসন হোল্ডার। তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে হয় না সব কিছু শেষ হয়ে গিয়েছে। প্রচুর তরুণ ক্রিকেটার রয়েছে আমাদের। ওরা আরও উন্নতি করবে এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ক্রিকেট ঘুরে দাঁড়াবে।’’ তবে হোল্ডারের মতে, তরুণদের ঠিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সব রকম সাহায্য করতে হবে। তাঁর মতে, ‘‘আমাদের তরুণ ক্রিকেটারদের পাশে থাকহে হবে। শুধু প্রতিযোগিতার সময় নয়, অন্য সময়ও ওদের পাশে থাকা দরকার। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা হলে প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের তুলে আনতে পারব আমরা।’’
কী ভাবে আগের অবস্থায় ফিরতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ক্রিকেট, তা-ও জানিয়েছেন হোল্ডার। অভিজ্ঞ অলরাউন্ডার বলেছেন, ‘‘আমাদের এক দম নীচের স্তর থেকে নজর দিতে হবে। যাতে ওরা সিনিয়র পর্যায় আসার আগে শক্ত ভিত তৈরি করতে পারে। ছোটদের দিকে আমাদের বাড়তি নজর দিতেই হবে। আমাদের সময় দিতে হবে। চাইলেই রাতারাতি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে না। পরিকল্পনা করে এগোতে পারলে দু’বছর পর থেকে আমরা ফলাফল আশা করতে পারব।’’
হোল্ডার এ কথা বললেও অনেকেই মনে করছেন, সে দেশে তরুণদের মধ্যে ক্রিকেট সে ভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। কাজ করে না আবেগও। কারণ ওয়েস্ট ইন্ডিজ় কোনও দেশ নয়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দেশ থেকে ক্রিকেটারদের নিয়ে তৈরি হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। তাই দেশের পতাকা নিয়ে ক্রিকেট মাঠে খেলতে পারেন না তাঁরা। সঙ্গে রয়েছে রাজনীতি। একই দেশ থেকে সব ক্রিকেটারকে নেওয়া যাবে না। তাই প্রতিভা থাকলেও অনেক সময় সুযোগ পান না যোগ্য ক্রিকেটার। ইয়ান বিশপ ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় বলেন, “দেশে এখনও ক্রিকেট সমর্থকেরা রয়েছে। তাদের জন্য অন্তত বোর্ডের চিন্তাভাবনা পাল্টানো দরকার। কোচ বা অধিনায়ক বদল করে কিছু হবে না। একদম তৃণমূল স্তর থেকে পরিবর্তন প্রয়োজন।”
ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে এখন আর দল হিসাবে খেলতে দেখা যায় না। কখনও কোনও ম্যাচে হয়তো এক জন ব্যাটার রান করে গেলেন, কখনও বল হাতে পাঁচ উইকেট নিলেন কোনও বোলার। কিন্তু গোটা দল হিসাবে বিপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় না ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে। একের পর ক্যাচ ফেলে দলটি। বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার ম্যাচে যখন স্কটল্যান্ডের আর ১০ রান প্রয়োজন, তখনও ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ক্রিকেটারদের হাসতে দেখা যায়। সই বিলোতে দেখা যায়। কোনও আক্ষেপ নেই তাঁদের মধ্যে। বিশপের গলায় যে আক্ষেপ, রাগ, লজ্জা শোনা যাচ্ছিল ধারাভাষ্য দেওয়ার সময়, তার লেশমাত্র ছিল না ক্রিকেটারদের মধ্যে।
এই মানসিকতাকেই দায়ী করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের অধিনায়ক সাই হোপ। তিনি বলেন, ‘‘সত্যি বলতে আমরা পারিনি। পুরো প্রতিযোগিতাটাই অত্যন্ত হতাশাজনক। আমাদের বেশ কিছু জায়গায় নজর দিতে হবে। প্রাথমিক কিছু বিষয়ে নজর দিতে হবে। আমরা মোটেও প্রত্যাশিত পারফরম্যান্স করতে পারিনি। তবে মানসিকতাই আসল। আমাদের আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে। মানসিকতা বদলাতে হবে। কিছু ক্ষেত্রে ভাল করলেও আমাদের ধারাবাহিকতা ছিল না। আরও ভাল প্রস্তুতি নেওয়া উচিত ছিল আমাদের। ক্রিকেট কোনও রকেট বিজ্ঞান নয়। ফিরে আসার রাস্তা আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। নিজেদেরই ঠিক করতে হবে সামনের রাস্তা।’’
হার এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের ক্রিকেটারদের কাছে সত্যিই নতুন কোনও ঘটনা নয়। শুধু যে বিদেশের মাটিতে হারছে তা নয়, ঘরের মাঠে বাংলাদেশ, নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে হেরেছে তারা। ভারতে খেলতে এসে হেরেছে। পাকিস্তানে খেলতে গিয়ে হেরেছে। ১০ বছর আগেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। সেই সময় দলে ছিলেন ক্রিস গেল, ড্যারেন সামি, সুনীল নারাইন, আন্দ্রে রাসেলের মতো ক্রিকেটার। উঠে এসেছিলেন কার্লোস ব্রেথওয়েটের মতো ক্রিকেটার। তাঁর ব্যাটে ভর করেই ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। কিন্তু তাঁর ক্রিকেটার জীবন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে মাইক ধরেন ব্রেথওয়েট। ধারাভাষ্যকার হয়ে যান তিনি। এভিন লুইস ক্যারিবিয়ান দলের তারকা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু তাঁকে হঠাৎ ছেঁটে ফেলেন নির্বাচকেরা। তার পরেই ছন্দ হারান তিনি।
দলগঠনের সমস্যা ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে ভোগাচ্ছে। ড্যারেন ব্র্যাভো ব্যাট হাতে আগামীর ব্র্যায়ান লারা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন তিনি দলেই নেই। হারিয়ে গিয়েছেন মিগুয়েল কামিন্স, ওশানে থমাসেরাও। এর মাঝে শিমরন হেটমেয়ারের মতো ঘটনা ঘটে। আইপিএলে যিনি একটি ম্যাচও দলের বাইরে থাকেন না, তিনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে যাওয়ার বিমান ধরতে পারলেন না। তা-ও এক বার নয়, দু’বার। ফলে দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
ক্রিকেট এবং ক্রিকেটের বাইরের নানা সমস্যায় জর্জরিত ওয়েস্ট ইন্ডিজ়। তারা এখন সেই কুস্তিগিরের মতো, যাঁর শরীরে বিভিন্ন আঘাতে চিহ্ন। অতীতে তাঁর নামে কাঁপত সকলে, কিন্তু এখন কুস্তি করতে নামলে যে কেউ মাটিতে ফেলে দিতে পারে তাঁকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলতে না পারা, অনেকটা ব্রাজ়িলের ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতে না পারার মতো। সমর্থকদের একটা আবেগ কাজ করে এই দলগুলির সঙ্গে। তাই নিকোলাস পুরান, সাই হোপ রান পেলে এখনও আশা দেখেন অনেকে। অরুণ লাল বললেন, “ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ফিরবে। আগামী দিনে এমন অবস্থা থাকবে না। ওদের ঘরোয়া ক্রিকেট বদলাবে।”
সাদা বলে একাধিক দেশ উঠে আসছে, ‘কুলীন’ দেশগুলিকে হারিয়ে চমকে দিচ্ছে। হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ও ফিরবে। সেটার জন্য পাল্টাতে হবে অনেক কিছু। প্রাক্তন ক্রিকেটার মাইলস বাসকম্ব ওয়েস্ট ইন্ডিজ় ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন। আগামী তিন বছরের জন্য তাঁর কাঁধে দায়িত্ব। পরের বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়কে আবার ফেরাতে পারবেন কি তিনি? আশায় বুক বাঁধবেন ক্যারিবিয়ান সমর্থকেরা। যাঁরা আনন্দে থাকতে ভালবাসেন। শনিবার দল হেরে যাওয়ার সময়ও তাঁরা নাচছিলেন। আগামী দিনে সেই নাচ যেন জয়ের আনন্দের হয়।