বিশ্ব মঞ্চে রাজা হয়ে ফিরলেন বিরাট কোহলি। ফাইল চিত্র।
ঠিক এক বছর আগের জন্মদিনে স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে মাত্র ২ রান করে বিরাট কোহলি যখন ক্লান্ত, বিষণ্ণ, ধ্বস্ত মনে সাজঘরে ফিরছেন, তখন অনেকেই ভেবে নিয়েছিলেন তিনি শেষ। একসময় যে ব্যাট মাঠে থাকলে বোলাররা আতঙ্কে থাকতেন, সেই বিরাট-অস্ত্র তখন ভোঁতা। সেই সুযোগে অনেকেই আক্রমণ করেছিলেন। বিরাটকে দল থেকে বাদ দেওয়ার কথাও বলেছিলেন অনেকে। বিরাট কিন্তু নিজের লক্ষ্য থেকে সরেননি। তিনি জানতেন ফিরতে হবে। সকলকে চুপ করিয়ে দিতে হবে। বিরাট ফিরলেন। বিশ্ব মঞ্চে রাজা হয়ে ফিরলেন।
২০০৮ সালে ভারতের জার্সি পরার আগেই বিরাটের নাম ক্রিকেট মহলে ছড়িয়ে পড়েছিল। অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন তিনি। ১৯-এর তরুণ বিরাট তখন লাগামহীন ঘোড়া। তাঁর শরীরে প্রচুর তেজ, কিন্তু কী ভাবে ব্যবহার করতে হয় জানেন না। তাই তিনি ছুটছেন, কিন্তু সাফল্যের সাদা লাইনটা কিছুতেই পার করতে পারছেন না। জীবনের প্রথম সিরিজ়ে (শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে) একটি অর্ধশতরান-সহ ১৫৯ রান (৫ ম্যাচে) করে বাদ যেতে হল। প্রথম ধাক্কা খেলেন।
ভারতে বহু ক্রিকেটার আছেন যাঁদের একটি সিরিজ় খেলে বিদায় নিতে হয়েছে। প্রাক্তন হয়ে যেতে হয়েছে নামের পাশে এক অঙ্কের ম্যাচ সংখ্যা নিয়ে। কিন্তু বিরাট জানতেন তাঁকে খেলতে হবে। তিনি যে তাঁর বাবাকে কথা দিয়েছিলেন। বাবার মৃত্যুর (২০০৬ সালে) পর যে ছেলে দিল্লির হয়ে রঞ্জি খেলতে নেমে পড়তে পারে, সে যে সহজে কোনও কিছু ছাড়ার বান্দা নয় তা তো বলাই যায়। বিরাট ফিরলেন। এক বছরের মধ্যেই ফিরলেন।
এর পর একে একে মাইলফলক টপকানো শুরু। ইডেনে জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক শতরান দিয়ে যে দৌড় শুরু করেছিলেন, তা এখনও চলছে। ৭১টি শতরান হয়ে গিয়েছে। তিন ধরনের ক্রিকেটেই আন্তর্জাতিক শতরান রয়েছে বিরাটের। ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নামের পাশে ১০২টি টেস্ট, ২৬২টি এক দিনের ম্যাচ এবং ১১৩টি টি-টোয়েন্টি হয়ে গিয়েছে। এই সংখ্যা আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে রানের সংখ্যাও। টেস্টে ৮০৭৪ রান, এক দিনের ক্রিকেটে ১২,৩৪৪ রান এবং টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ৩৯৩২ রান। বলা বাহুল্য, এটাও বাড়বে।
বিরাটের তুলনা করা হয় সচিন তেন্ডুলকর, ডন ব্র্যাডম্যানের সঙ্গে। মনে করা হয় সচিনের শততম শতরানের কীর্তি ভাঙতে পারেন শুধু বিরাটই। সেই বিরাট প্রসঙ্গে সচিন বলেছিলেন, “বিরাট কোহলির ব্যাটিং দেখা আনন্দের। ও আমার রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে।” এ বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯তম ওভারে ব্যাকফুটে হ্যারিস রউফকে মারা ছক্কাটা দেখে যে কোনও ক্রিকেটপ্রেমীর মতো উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন সচিনও। ভারতের জয়ের পরে সঙ্গে সঙ্গে টুইট করে সচিন লিখেছিলেন, “নিঃসন্দেহে এই ইনিংসটা তোমার (বিরাটের) জীবনের সেরা। তোমার খেলা দেখাটা দারুণ উপভোগ্য। ১৯তম ওভারে হ্যারিস রউফকে ব্যাক ফুটে যে ছয়টা মারলে, সেটা অভাবনীয়। এ ভাবেই খেলে যাও।”
কিন্তু শেষ তিন বছর ক্রিকেটপ্রেমীরা বিরাটের ব্যাটিংটাই উপভোগ করতে পারছিলেন না। ইডেনে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শতরানের পর থেকেই যেন তাঁর রানের ব্যাটটা হারিয়ে গিয়েছিল। প্রায় তিন বছর শতরান আসেনি তাঁর ব্যাট থেকে। ‘গোল্ডেন ডাক’ (প্রথম বলেই আউট) হয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি ভারতের নেতৃত্ব ছেড়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। এক দিনের ক্রিকেটে তাঁর থেকে নেতৃত্ব নিয়ে নেওয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তাদের দেশে টেস্ট সিরিজ় হেরে লাল বলের নেতৃত্বও ছেড়ে দেন বিরাট। তাঁর ব্যাট চুপ করেছিল, আর বাইরে থেকে সকলে কথা বলে যাচ্ছিল। রাজা বিদ্ধ হচ্ছিলেন চতুর্দিক থেকে। অনেকে বলেছিলেন, “বিরাট শেষ।” অনেকে মানতে চাননি। সংবাদ মাধ্যমে একাধিক বিশেষজ্ঞ সেই সময় জানিয়ে যাচ্ছেন বিরাটের কী করা উচিত। নানা মুনির, নানা মত তখন শুধুই বিরাটের জন্য। ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক সেই সময় যদিও একজনের ফোন পেয়েছিলেন বলেই জানিয়েছেন। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির, যিনি সংবাদ মাধ্যমে বিরাট সম্পর্কে ওই সময় একটি কথাও বলেননি।
বিরাট মুখ খুলেছিলেন এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৬০ রানের ইনিংসের পর। তিনি বলেছিলেন, “আমি যখন টেস্ট অধিনায়কত্ব ছাড়ি, এক জন মাত্র প্রাক্তন ক্রিকেটার আমাকে ফোন করেছিল। অনেকের কাছেই আমার নম্বর আছে। কিন্তু ফোন করেছিল শুধু মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। এর থেকেই বোঝা যায় কে আমার ভাল চায়। সত্যি যদি আমার কথা কেউ ভেবে থাকে তা হলে সে আমাকে ফোন করে কথা বলতে পারত।”
বিরাট যখন রান পাচ্ছিলেন না, তখন অনেকেই সংবাদমাধ্যমে তাঁর সম্পর্কে কথা বলেছিলেন। বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক কপিল দেব বলেছিলেন, “এমন নয় যে গত পাঁচ-ছ’বছরে কোহলিকে ছাড়া কোনও দিন ভারত খেলেনি। তবে ওর মতো ক্রিকেটারকে আমি ছন্দে দেখতে চাই। ওকে হয়তো বাদ বা বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। এখনও ওর মধ্যে অনেক ক্রিকেট বাকি রয়েছে। আমি চাই ও রঞ্জি খেলে ছন্দে ফিরে আসুক।” এ বারের আইপিএলের সময় থেকে রান নেই বিরাটের ব্যাটে। শতরান আসেনি আড়াই বছর পেরিয়ে গিয়েছে। রবি শাস্ত্রী বলেছিলেন বিশ্রাম নিতে। নাম না করে ইরফান পাঠান বলেছিলেন, বিশ্রাম নিয়ে কেউ কোনও দিন রানে ফেরেনি। নানা মত সেই সময় ঘুরছিল। বিরাটকে ছিঁড়ে খাচ্ছিলেন সকলে। বিরাট কখনও কিছু বলেননি। শুধু ১৬ জুলাই একটি টুইট করেছিলেন। নিজের একটি ছবিতে লিখেছিলেন ‘দৃষ্টিভঙ্গি’।
২০২২ সালে সেই দৃষ্টিভঙ্গিটাই পাল্টে দিলেন বিরাট। এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে শতরান। নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “মাঝের এই কয়েকটা মাসের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। কারণ, এই সময়টা শুধু ক্রিকেট নয়, জীবনের অন্য মানে আমাকে বুঝিয়েছে। আমি আবার শূন্য থেকে শুরু করেছি। আবার খেলতে ভাল লাগছে।” একসময় যাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়ার কথা শুরু হয়ে গিয়েছিল, সেই বিরাটই আবার ফিরে এলেন দলের অন্যতম সেরা ব্যাটার হয়ে।
মাঝের এই সময়টার কথা বিরাট জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “১০ বছরে এই প্রথম বার আমি এক মাস ব্যাট ছুঁইনি। শরীর বলছিল থামতে। একটু পিছিয়ে যেতে। কিচ্ছু ভাল লাগত না। আমি এমনিতে মানসিক ভাবে খুব শক্ত। কিন্তু সব কিছুর একটা সীমা আছে। সেটা ছাড়িয়ে গেলে তার ফল খুব খারাপ হয়। তাই কখনও একটু থেমে যেতে হয়।” একের পর এক ব্যর্থতা তাঁকে মানসিক ভাবে দুর্বল করে দিয়েছিল বলেও জানিয়েছিলেন বিরাট। সেটা সবার সামনে স্বীকার করতে তাঁর কোনও সঙ্কোচ নেই। বিরাট বলেছিলেন, ‘‘এই খারাপ সময় আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। স্বীকার করতে কোনও লজ্জা নেই যে আমি মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু অনেকেই তা বলতে লজ্জা পায়। কারণ, আমরা চাই না কেউ আমাদের দেখে দুর্বল বলুক। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আত্মবিশ্বাসী থাকার মিথ্যা অভিনয় করার থেকে দুর্বল হিসাবে নিজেকে স্বীকার করে নেওয়া অনেক ভাল।’’
বিরাট ফিরে আসতে জানেন। এ বারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ইতিমধ্যেই দু’বার ম্যাচের সেরা হয়েছেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব থেকে বেশি রানের মালিক এখন তিনিই। রাজারা এ ভাবেই ফেরে। এ ভাবেই ফিরে আসতে হয়।