(বাঁ দিক থেকে) যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি ও মহম্মদ সিরাজ। —ফাইল চিত্র
মাইকেল হোল্ডিং জনিয়েছেন, তাঁর মনে পড়ে যাচ্ছে অ্যান্ডি রবার্টস ও ম্যালকম মার্শালের কথা। তাঁদের খেলোয়াড় জীবনের কথা। যখন তাঁরা আগুন ঝরাতেন, তখনকার কথা। হরভজন সিংহ আবার জানিয়েছেন, ভারতে এই রকম বিধ্বংসী পেস বোলিং আক্রমণ তিনি কোনও দিন দেখেননি। হতবাক ওয়াসিম আক্রমও। সুইংয়ের সুলতানের মনে পড়ে যাচ্ছে তাঁর ও ওয়াকার ইউনিসের কথা, যাঁরা মরা পিচেও বলকে কথা বলাতেন। হোল্ডিং, হরভজন বা আক্রম প্রত্যেকেই কিন্তু তিন জনের কথাই বলছেন। যশপ্রীত বুমরা, মহম্মদ শামি ও মহম্মদ সিরাজ। ভারতের পেসারত্রয়ী। চলতি বিশ্বকাপে সবার চোখ কপালে তুলে দিয়েছেন তিন জন। যেখানে বাকি দলের পেসারেরা সমস্যায় পড়ছেন সেই পিচেও ভারতীয় পেসারেরা বলকে কথা বলাচ্ছেন। কী ভাবে? বাকি দলের পেসারদের তুলনায় কেন এতটা সফল ভারতীয় পেসারেরা? নেপথ্যে কী কী কারণ রয়েছে?
ভারতের পেসারদের পরিসংখ্যান দেখলেই বোঝা যাবে, কতটা ফর্মে রয়েছেন তাঁরা। শামি খেলেছেন মাত্র ৪টি ম্যাচ। নিয়েছেন ১৬টি উইকেট। মাত্র ৭ গড় ও ৪.৩০ ইকোনমি রেটে বল করেছেন শামি। এই বোলিং গড় যে কোনও বোলারের কাছে স্বপ্নের মতো। সব থেকে ভাল বোলিং ১৮ রান দিয়ে ৫ উইকেট। বুমরা নিয়েছেন ৮টি ম্যাচে ১৫টি উইকেট। বোলিং গড় ১৫.৫৩। বুমরার ইকোনমি রেট আরও কম। মাত্র ৩.৬৫। সাধারণত পাওয়ার প্লে ও ডেথ ওভারে বল করেন তিনি। সেই সময়ই সব থেকে রান তোলার সুযোগ থাকে। অথচ সেই সময়ই ওভার প্রতি ৪ রানের কম দেন বুমরা। তাঁর সব থেকে ভাল বোলিং ৩৯ রান দিয়ে ৪ উইকেট। সিরাজ ৮টি ম্যাচে ১০টি উইকেট নিয়েছেন। তাঁর বোলিং গড় ৩১.৭০। ইকোনমি রেট ৫.২৩। প্রথম দিকের ম্যাচগুলিতে সিরাজ তেমন ভাল বল করতে না পারলেও যত সময় গড়িয়েছে তত ধার বাড়িয়েছেন তিনি। ১৬ রান দিয়ে ৩ উইকেট তাঁর সব থেকে ভাল বোলিং।
ভারতের পেস বোলিং আক্রমণকে বিশ্লেষণ করতে গেলে বেশ কয়েকটি দিক সামনে আসে। প্রথমেই বলা যায় বল সিমের উপর পড়া। আক্রম জানিয়েছেন, ভারতীয় পেসারদের সিম যে ভাবে উইকেটে পড়ে তাতেই অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। সিম দেখেই বোঝা যায়, বল কতটা সুইং করবে বা বাউন্স করবে। সেই সঙ্গে গতির বৈচিত্র তো রয়েছেই।
তিন পেসারই ডান হাতি। কিন্তু তিন জনের আলাদা আলাদা গুণ রয়েছে। তিন জনেরই বলের গতি ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমটারের বেশি হলেও বল করার ধরনে তফাত রয়েছে। বুমরা অনেক বেশি সুইংয়ের উপর নির্ভর করেন। তাঁর বল হাওয়ায় দিক পরিবর্তন করে। আগে তিনি শুধু ইনসুইং করতেন। অর্থাৎ, তাঁর বল ডান হাতি ব্যাটারের ক্ষেত্রে ভিতরের দিকে ও বাঁ হাতি ব্যাটারের ক্ষেত্রে বাইরে বেরিয়ে যেত। কিন্তু চোট সারিয়ে ফেরার পর থেকে আউটসুইংও শুরু করেছেন তিনি। অর্থাৎ, তাঁর বল এখন উইকেট পড়ে দু’দিকেই সুইং করে। ফলে ব্যাটারেরা আরও সমস্যায় পড়ছেন।
সিরাজের বোলিংও অনেকটা সুইংয়ের উপর নির্ভর করে। তবে বুমরা যেমন লেংথে বল করেন, সিরাজ কিছুটা আলাদা। তিনি ব্যাটারের কাছে বল ফেলতে পছন্দ করেন। ব্যাটারকে সামনের পায়ে খেলাতে চান। কোনও পিচে সামান্য সুইং থাকলে সেখানে সিরাজ ভয়ঙ্কর। কারণ, তিনি এমন লাইন ও লেংথে বল করেন যেখানে ব্যাটার বল খেলতে বাধ্য। সেই কারণে বল পিচে পড়ে সুইং করলে ব্যাটারের খেলতে খুব সমস্যা হয়। আর যে পিচে সুইং কম থাকে সেখানে সিরাজকে মূলত বলের গতির উপর নির্ভর করতে হয়। মাঝেমাঝে ব্যাটারকে সমস্যায় ফেলতে ভাল বাউন্সারও করেন তিনি।
শামি আবার এই দু’জনের থেকে আলাদা। তিনি নির্ভর করেন সিমের উপর। তাঁর বল বুমরা বা সিরাজের মতো হাওয়ায় দিক পরিবর্তন করে না। তাঁর বল পিচে সিমের উপর পড়ে তার পর দিক পরিবর্তন করে। আর শামির বলের সিম এতটাই সোজা থাকে যে প্রতিটা বল সিমের উপর পড়ে। লেংথে বল করতে ভালবাসেন তিনি। শামিকে নিয়ে শ্রীলঙ্কা ম্যাচের পরে সিরাজ বলেছেন, ‘‘শামি ভাইকে নিয়ে আর কী বলব? ওকে তো মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে এনে বল করালেও সব বল সিমে পড়বে।’’ ফলে নতুন হোক, বা পুরনো বল, সব ক্ষেত্রেই শামির বলে কিছু না কিছু হয়। তার পরে মাঝেমাঝে কাটার বা স্লোয়ারও দেন শামি। এত রকম বৈচিত্র থাকায় সমস্যা হয় ব্যাটারদের। এ বারের বিশ্বকাপে সেটা বার বার দেখা যাচ্ছে।
ভারতের পেস বোলিং আক্রমণ দেখে হতবাক নিজের সময়ের অন্যতম সেরা ওপেনার অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। তিনি বলেন, ‘‘দিনে হোক বা রাতে, ভারতের পেস আক্রমণ যা বল করছে তা এক কথায় ভয়াবহ। বুমরা, শামি, সিরাজকে খেলা কার্যত অসম্ভব।’’ একই কথা শোনা গিয়েছে আক্রমের গলাতেও। তিনি বলেন, ‘‘শুরুটা করে বুমরা ও সিরাজ। ওদের দু’জনকে সামলানোর পরে ব্যাটার যখন ভাবে একটু থিতু হয়েছে তখন আসে শামি। তা হলে ব্যাটার কোথায় যাবে? যে দলের তৃতীয় পেসার শামির মতো ভয়ঙ্কর, সে দল যে দাপট দেখাবে সেটাই স্বাভাবিক।’’
তবে শুধুই কি গতি আর সুইং, এই সাফল্যের নেপথ্যে কি কোনও পরিকল্পনা নেই! আছে। প্রতিটা দলের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা করে নামছেন বুমরা, শামিরা। তাঁরা সবার আগে চেষ্টা করছেন, উইকেটে বল করার। যাতে বল ব্যাটে না লাগলে যেন উইকেট বা পায়ে লাগে। তার পরে প্রত্যেক ব্যাটারের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা পরিকল্পনা করা হচ্ছে। যে ব্যাটার বাউন্সারের বিরুদ্ধে দুর্বল, তাঁকে ঠিক জায়গায় বাউন্সার করা হচ্ছে। যে ব্যাটার আবার অফ সাইডে শট খেলতে পছন্দ করেন, তাঁকে হাত খোলার জায়গা দিচ্ছেন না তাঁরা। রান আটকানোর চেষ্টা করছেন। ব্যাটারকে বিরক্ত করে তুলছেন যাতে তিনি হতাশ হয়ে খারাপ শট খেলেন। ব্যাটার সেটাই করছেন।
কোনও দলের বোলিং আক্রমণ তখনই সফল হয় যখন তারা একটি দল হিসাবে আক্রমণ করে। ভারতের এই পেস বোলিং আক্রমণে তিন জন থাকলেও মূলত তারা একসঙ্গে আক্রমণ করছেন। একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠছেন। কোনও ম্যাচে এক জন রান দিলে বাকি দু’জন সেই খামতি ঢেকে দিচ্ছেন। ফলে প্রতিটা ম্যাচে দলকে সাফল্য এনে দিচ্ছে এই বোলিং আক্রমণ। অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, স্রেফ উড়ে যাচ্ছে। বুমরা, শামি, সিরাজের কাঁধে ভর করে হাসিমুখে এগিয়ে যাচ্ছেন রোহিত শর্মারা।