মিচেল স্টার্ক। ছবি: সংগৃহীত।
এমন রুদ্ধশ্বাস ম্যাচ জেতার পরের দিনই জরুরি বৈঠকে বসে কোনও দল?
নাইট রাইডার্স বসল।
শেষ বলে জয়ের প্রবল উত্তেজনা আর হইচই দূরে সরিয়ে বোলিং বিশ্লেষণে ব্যস্ত থাকে কোনও দল?
নাইট রাইডার্স থাকল।
২০৮ তুলেও কোনও দল খোঁজার চেষ্টা করে পাওয়ার প্লে-তে কেন আটকে গেলাম?
নাইট রাইডার্স খুঁজতে বসল।
ইডেনে শুভ মহরৎ সম্পন্ন হওয়ার পরের দিন কেকেআর শিবিরে খোঁজ নিতে গিয়ে বিস্মিতই হতে হল। মনে হয়েছিল, দশ বছর আইপিএল ট্রফি না জেতা একটা দল প্রথম ম্যাচে এমন দুর্ধর্ষ, নাটকীয় জয় পেয়েছে। স্বয়ং শাহরুখ খান যেখানে হাজির। জেতার পরে নিশ্চয়ই ফাটিয়ে পার্টি চলেছে। নিশ্চয়ই শাহরুখের সঙ্গে নাচা-গানায় ব্যস্ত ছিল সকলে। আগাম হোলি খেলাও শুরু হয়ে গিয়ে থাকতে পারে। শাহরুখ স্বয়ং এত মজা করতে ভালবাসেন, এমন অফুরন্ত এনার্জি।
কিন্তু কোথায় কী? শাহরুখ ড্রেসিংরুমে গিয়ে সকলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, মাঠে রাসেলকে আলিঙ্গনের সময় ইডেনের গ্যালারি সবচেয়ে জোরে গর্জন করেছে এ সব শনিবার রাতেই হয়েছে। রিঙ্কু সিংহের পরিবারের সঙ্গে বলিউড বাদশার ছবি টুইটারে ট্রেন্ডিং। রাস-লীলা সম্পন্ন করে তিনি আন্দ্রে রাসেল সিংহাসনে রাজার মতো বসে আছেন, সেই ছবি দিয়েছে নাইট রাইডার্স। এর বেশি কিছু চোখে পড়ল না। উল্টে শোনা গেল জিতে ওঠার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই কোচেদের বৈঠক হয়েছে কেকেআরের। এবং সেখানে চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে শনিবারের ম্যাচ নিয়ে। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, এর মধ্যেও খুব বিস্ময়ের কিছু আছে কি? সত্যিই তো ম্যাচ জিতলেও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। পকেটে সর্বিট্রেট নিয়ে বসার মতো অবস্থা। নাইট রাইডার্স জিতে হোলি খেলবে কী, তাদের পাড়ায় এসে তাদেই প্রধান বোলারের মুখে তো বাঁদুরে রং লগিয়ে দিয়ে গিয়েছেন হেনরিখ ক্লাসেন। সেই রং তুলতে এখন হিমসিম খাচ্ছে পুরো দল।
আজ, দোলের দিনই বেঙ্গালুরু রওনা হচ্ছে কেকেআর। সেখানে আর এক মারকাটারি দ্বৈরথ অপেক্ষা করছে। গম্ভীর বনাম কোহলি মানেই ওয়েব সিরিজ় থ্রিলার। পরের সিনে কী রক্তারক্তি অপেক্ষা করছে কে জানে! আর একটা জরুরি তথ্য হচ্ছে, বাঁদুরে রং মুখে মেখে স্টার্ক নামছেন তাঁর পুরনো দলের পাড়ায়। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, আইপিএলে চিন্নাস্বামী ব্যাটিং উইকেটের জন্য প্রসিদ্ধ এবং এখানকার ছোট বাউন্ডারি বরাবর বোলারদের নিশি-আতঙ্ক।
বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। নিলামের দিন থেকে চর্চা চলছে বাঁ হাতি অস্ট্রেলীয় পেসারকে নিয়ে। ২৪.৭৫ কোটি টাকায় তাঁকে কিনে কি ঠিক করল কেকেআর? এত টাকা দিয়ে এমন এক পেসারকে কেনা হল যাঁর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তেমন কোনও সাফল্য নেই। যিনি একটা বছর ছাড়া আইপিএল খেলেনইনি। যিনি এমনকি নিজের দেশে বিগ ব্যাশেও খেলেন না। চর্চা তো হবেই।
প্রথম দিনেই আতঙ্ক বাড়িয়ে দিয়েছেন স্টার্ক। চার ওভারে দিলেন ৫৩। কোনও উইকেট নেই। এক-এক সময় মনে হচ্ছে, অজ্ঞাত-অখ্যাত হর্ষিত রানা শেষ ওভারে জিতিয়ে মহাতারকা বোলারকে বাঁচিয়ে দিলেন। শোনা যাচ্ছে, শেষ ওভার করবেন বলে নিজেই এগিয়ে এসেছিলেন হর্ষিত। ডাকাবুকো রানার প্রতাপ দেখে মুগ্ধ গোটা দল। না হলে সমাজমাধ্যমে কী ভয়ঙ্কর ট্রোলিংয়ের মুখে পড়তে পারতেন তিনি মিচেল স্টার্ক! তাঁর প্রত্যেকটা বলের দাম ৬ লক্ষ, এই হিসাব আগেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। শনিবারের ম্যাচের পরে নতুন হিসাব বেরিয়ে পড়েছে যে, ২৪.৭৫ কোটির ১ কোটি ৪৪ লক্ষ ইতিমধ্যেই জলে গেল। চার ওভার মানে চব্বিশটা বল, সেই হিসাব ধরে দ্রুত অঙ্ক কষে ফেলা হয়েছে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই আইপিএলে স্টার্কের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ কোনও ব্যাটসম্যান নন। বিরাট কোহলি বা রোহিত শর্মা নন। তাঁকে ক্রমাগত বল করে যেতে হবে ২৪.৭৫ কোটি মূল্যের বিরুদ্ধে। মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাওয়া খুব স্বাভাবিক যে, আমি এত টাকার যোগ্য তো? আর একটা তুলনাও শুরু হল বলে। তাঁর অর্ধেক টাকায় অর্থাৎ ১২ কোটির আন্দ্রে রাসেল ম্যাচ জেতাচ্ছেন। গত দু’বছর সামান্য নিষ্প্রভ ছিলেন কেকেআরের ‘মাস্ল’। এ বার কিন্তু দারুণ ভঙ্গিতে বছরটা শুরু করেছেন। ২০২৪-এ ১৪টি টি-টোয়েন্টি ইনিংসে রাসেল করেছেন ৪১০ রান, স্ট্রাইক রেট ২২২.৮২। এই ছন্দের প্রতিফলন দেখা গিয়েছে শনিবারের ইডেনে। তিনি স্টার্ক কী করছেন?
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান যে খুব বেশি করে স্টার্কের পক্ষে ছিল, তা-ও নয়। একটা হিসাব দেখছিলাম যে, ২০২১ থেকে ধরলে টি-টোয়েন্টিতে পাওয়ার প্লে-তে অর্থাৎ শুরুর ছয় ওভারে স্টার্কের স্ট্রাইক রেট ৩১.৭। অর্থাৎ প্রত্যেক উইকেট তুলতে এতগুলি বল লেগেছে তাঁর। যা যথেষ্ট বেশি। আর স্লগ বা ডেথ ওভার, অর্থাৎ শেষের দিকে তিনি দিয়েছেন ওভার প্রতি ১১.২৯ রান। এটাও তো কোনও ম্যাচ জেতানো বোলারের পরিসংখ্যান হতে পারে না।
এটা বললে অন্যায় হবে যে, জেতার আনন্দ ভুলে নাইট রাইডার্স কোচেদের তড়িঘড়ি বৈঠকে বসার একমাত্র কারণ স্টার্ক। মনে রাখা দরকার দলের নতুন মেন্টরের নাম গৌতম গম্ভীর। তিনি আর চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত এক ভাবলে এটাও ধরে নিতে হয় যে, লিলুয়া যা লন্ডনও তাই। বৃহত্তর ক্যানভাস দেখতে জানেন জিজি। একটা-দুটো জয়ে আত্মপ্রসাদে ভোগার বান্দা নন। অধিনায়ক হিসেবে কেকেআরের ট্রফির খরা মিটিয়েছিলেন। দশ বছর ধরে আইপিএল না জেতার হতাশা মেটাতে তাঁকেই ফের মেন্টর হিসেবে ফিরিয়েছেন স্বয়ং শাহরুখ খান। প্রথম দিনেই বোঝা গিয়েছে, দলটার বস্ এ বারে কে। গম্ভীরের নিশ্চয়ই চোখ এড়ায়নি শ্রেয়স আয়ার মাঠে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে অনেক ভুলচুক করছেন। হয়তো বোর্ড ও নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে লাল কার্ড দেখে থাকা এবং উল্টোপাল্টা শটে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসা নাইট অধিনায়কের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করে রাখছে। নাইট অধিনায়ককে দ্রুত রানে ফিরতে হবে। আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতায় সেরা ফর্মুলা হচ্ছে, শুরুতে ছন্দ এনে ফেলো। না হলে যত সময় গড়াতে দেবে, তত চাপ বাড়বে। সমস্যা নম্বর দুই ও তিন হচ্ছে, যেমন ব্যাটিং পাওয়ার প্লে-তে হোঁচট খাচ্ছে দল, তেমনই বোলিং পাওয়ার প্লে-তে উইকেট আসছে না। বেঙ্কটেশ আয়ার, শ্রেয়স, নীতীশদের এতটা ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলার দরকার আছে কি? গম্ভীর নিশ্চয়ই এ দিনের বৈঠকে আলোকপাত করেছেন। বোলিংয়ের ক্ষেত্রে ২০২৩ আইপিএলের একটা হিসাব তুলে ধরা যাক। শুরুর পাওয়ার প্লে-তে কেকেআর বোলাররা ৫৬ ওভারে উইকেট তুলেছেন মাত্র ১০টি। রান দিয়েছেন ওভার প্রতি ১০-এর কাছাকাছি। আর ডেথে অর্থাৎ শেষের দিকে রান দিয়েছেন ওভার প্রতি ১২-র উপরে। স্টার্ককে আনা হয়েছে এই অভাব মেটানোর জন্য। শুরুতে দুই ওভার, শেষে দুই— এই ছিল তাঁকে ব্যবহারের ফর্মুলা। কিন্তু তিনি সমস্যা দূর করবেন না বাড়িয়ে দেবেন, সেটাই তো এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।
থুড়ি, ২৪.৭৫ কোটি টাকার প্রশ্ন!