হুঙ্কার: সৌরভের আগ্রাসনই বদলে দিয়েছিল দলকে। ফাইল চিত্র।
লর্ডসে স্বপ্নের অভিষেক ঘটানো বেহালার বাঁ হাতি। গড়াপেটার কালো অধ্যায়ের শাপমোচন ঘটিয়ে নতুন, লড়াকু টিম ইন্ডিয়ার স্থপতি। তিনি আজ পা দিচ্ছেন পঞ্চাশ বছরে। লন্ডনে শুরু হয়ে যাওয়া প্রাক-জন্মদিন উৎসবের প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেই আনন্দবাজারের সঙ্গে বৃহস্পতিবার একান্ত আলাপচারিতায় সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। অধিনায়ক হাঁটতে থাকলেন তাঁর ক্রিকেটযাত্রার সরণি ধরে...
প্রশ্ন: পঞ্চাশতম জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা...
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়: থ্যাঙ্ক ইউ!
প্র: ক্রিকেট মাঠে অনেক সেঞ্চুরি করেছেন, জীবনের বাইশ গজে ৫০ সংখ্যা ছোঁয়া নিয়ে অনুভূতি কী?
সৌরভ (হাসি): সংখ্যাটা তো প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটছে ভালই।
প্র: লন্ডনে উৎসব তো শুরু হয়ে গিয়েছে।
সৌরভ: লন্ডনে এসেছি অনেক কাজ নিয়ে। সানা এখানে থাকে। তার পর ভারতীয় দল টেস্ট খেলছিল। ক্রিকেট সংক্রান্ত কিছু মিটিংও ছিল। তার মধ্যেই জন্মদিন নিয়ে কিছু আয়োজন। কাল (শুক্রবার) এখানকার তাজ হোটেলে ডিনার রাখা হয়েছে।
প্র: প্রি-বার্থডে সেলিব্রেশনও তো শুরু হয়ে গিয়েছে। ছবিতে দেখলাম সচিন এসেছিলেন...
সৌরভ: হ্যাঁ, সচিন আসলে এখানেই রয়েছে। তাই ওকে আমন্ত্রণ করেছিলাম। ও, অঞ্জলি এসেছিল। বোর্ড কর্তারা চলে যাচ্ছেন। তাই তাঁদেরও ডেকেছিলাম।
প্র: সচিনকে প্রি-বার্থডে সেলিব্রেশনের ছবিতে দেখে মনে হচ্ছিল, বেশ খুশি মনে আপনার সঙ্গে ব্যাট করছেন!
সৌরভ (হাসি): হ্যাঁ, বেশ ফুরফুরে রয়েছে সচিন। মাঠে অনেক ভাল সময় কাটিয়েছি আমরা। সেই কিশোর বয়স থেকে আমরা একসঙ্গে ট্র্যাভেল করছি। কৈলাস ঘাটানির দলের সঙ্গে ইংল্যান্ডে এসেছিলাম আমরা। ইনদওরে বাসু পরাঞ্জপের ক্যাম্পেও একসঙ্গে ছিলাম। তখন থেকেই সচিন খুব প্রতিভাবান। ‘ওয়ান্ডার বয়’ বলা শুরু হয়ে গিয়েছে। আর নেটে ঢুকলে ব্যাট ছাড়তে চাইত না।
প্র: ইনদওরে আপনার ঘরে বালতি করে এনে জল ঢেলে ভাসিয়েও দিয়েছিল!
সৌরভ: সত্যি! একটা কাণ্ড ঘটিয়েছিল বটে! ঘরের মধ্যে আমার কিটব্যাগ জলে ভাসছে। আমার একমাত্র অপরাধ ছিল কী? না, প্র্যাক্টিসে খাটাখাটনি করে এসে রবিবার দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সচিন এ রকমই। খুব মজা করতে পারে। অনেক ট্যুরেই আমরা রুম পার্টনার থেকেছি।
প্র: জন্মদিনের উৎসবে এসেও কি কিছু ঘটালেন?
সৌরভ (হাসি): না, না। এখানে চান্স পায়নি। অনেক লোকজন ছিল তো!
প্র: সৌরভ-সচিন নামের দুই কিশোর ছুটেছিল কি না এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে ফাস্ট বোলার হবে বলে!
সৌরভ: হ্যাঁ, চেন্নাইয়ে এমআরএফ পেস ফাউন্ডেশনে গিয়েছিলাম আমরা। ডেনিস লিলির কাছে। ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। লিলির মন জিততে পারেনি দুই বোলার।
প্র: ভাগ্যিস পারেনি। না হলে ভারতীয় ক্রিকেট তার সেরা ব্যাটিং জুটি পেত কোথা থেকে?
সৌরভ (হাসি): আসলে ওই বয়সে তো আর নিশ্চিত করে কিছু ঠিক করে ফেলা যায় না, কী হব। তাই আমরাও হয়তো ছুটেছিলাম পেস বোলার হব বলে।
প্র: ক্রিকেটযাত্রায় ফিরে তাকিয়ে সব চেয়ে তৃপ্তিদায়ক মুহূর্ত কোনটা মনে হয়?
সৌরভ: ক্রিকেটার হিসেবে অভিষেক টেস্ট সেঞ্চুরি। আমাকে বিশ্বাসটা দিয়েছিল ওই সেঞ্চুরি যে, ক্রিকেট পৃথিবীতে আমি বসবাসের যোগ্য। লর্ডসের ওই ইনিংসের পরে নিজেকে বলতে পেরেছিলাম, আমি পারব টেস্ট ক্রিকেট খেলতে।
প্র: অভিষেক টেস্টের আগে প্রস্তুতি ম্যাচে আপনি ভাল খেলেছিলেন। তাই বিশ্বাসটা তৈরি হচ্ছিল?
সৌরভ: হ্যাঁ, প্রস্তুতি ম্যাচে রান করেছিলাম। ওয়ান ডে-তে ভাল খেলেছিলাম। তাই ভিতরে-ভিতরে আত্মবিশ্বাসী হয়েই আমি লর্ডসে নামি।
প্র: আর অধিনায়ক হিসেবে সেরা প্রাপ্তি?
সৌরভ: বিদেশের মাটিতে নিয়মিত ভাবে জেতা শুরু করা। সেটাই অধিনায়ক হিসেবে আমার কাছে সেরা প্রাপ্তি। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, বিদেশে যত ক্ষণ না দাপুটে দল হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছ, তত ক্ষণ কেউ সম্মান করবে না। সেই দলটাকে নিয়ে কেউ ভাবে না, যারা শুধু নিজেদের দেশে জেতে আর বিদেশে হেরে মাথা হেঁট হয়ে ফেরে।
প্র: হরভজন একটা কথা বলছিলেন দুপুরে যে, দাদা ম্যাচ গড়াপেটার কালো অধ্যায় থেকে ভারতীয় ক্রিকেটকে বার করে এনেছিল। বিশ্বাস ফিরিয়েছিল মানুষের মনে যে, ক্রিকেট মানে ডব্লিউ ডব্লিউ এফ নয়!
সৌরভ: ওই সময় মানুষের বিশ্বাস ফেরানোটা জরুরি ছিল। আর সেটা একমাত্র ফেরে যখন সমর্থকেরা দেখেন, তাঁদের দল চেষ্টায় ত্রুটি রাখছে না। সব কিছু উজাড় করে মাঠে লড়ছে। দারুণ সব প্রতিভাও উঠে আসতে শুরু করল। সচিন, রাহুল, অনিল, শ্রীনাথের মতো সিনিয়র তো ছিলই। সঙ্গে পেয়েছি সহবাগ, যুবরাজ, হরভজনদের মতো সব তরুণ প্রতিভাও। কী সব ম্যাচউইনার এক-এক জন! দীর্ঘ দিন ভারতীয় ক্রিকেটকে সেবা করেছে।
প্র: তাঁদের অধিনায়কের সমর্থন আর জহুরির চোখের কথাও তো বলতে হবে! একটা নির্বাচনী বৈঠকে উত্তরাঞ্চল নির্বাচকই যুবরাজকে চাইছিলেন না। আপনি বললেন, যুবি টিমে না থাকলে সই করব না। আর এক বার রাহুল দ্রাবিড়ের ওয়ান ডে দল থেকে বাদ পড়া পাকা। আপনি চার ঘণ্টা ধরে লড়াইয়ের পরে মিটিং শেষে দ্রাবিড় সহ-অধিনায়ক!
সৌরভ: অধিনায়ক যদি তার প্লেয়ারের পাশে না দাঁড়ায়, কে দাঁড়াবে! পাশে না দাঁড়ালে খেলোয়াড় তৈরি হয় না। আমি মনে করতাম, অধিনায়ক হিসেবে আমার দায়িত্ব যোগ্য সতীর্থের জন্য ‘ফাইট’ করা। আমার প্লেয়াররা নির্বাচনী বৈঠকে যেত না। আমি যেতাম। মনে করতাম, এই বিশ্বাসটা যেন ওদের থাকে অধিনায়কের উপরে যে, এই লোকটা আমার সামনে এক রকম আর নির্বাচকদের সামনে গিয়ে আর এক রকম কথা বলে আসে না!
প্র: ১৯৯২-এ ওয়ান ডে অভিষেকের পরে চার বছর বাইরে থেকেও প্রত্যাবর্তন। গ্রেগ চ্যাপেলের সময় অন্যায় ভাবে বাদ পড়েও দুর্দান্ত ভাবে ফিরে আসা। হার-না-মানা এই মনোভাব তৈরি করার রেসিপি কী?
সৌরভ: কাঙ্খিত স্টেশনে পৌঁছনোর জন্য চেষ্টায় কোনও ত্রুটি না থাকে, সেটাই নিশ্চিত করতে হবে। আমি সব সময়ই ক্রিকেট খেলতে চেয়েছি। যখনই বাদ গিয়েছি, বিশ্বাস করেছি আমার ক্রিকেট ফুরিয়ে যায়নি। নিজের দক্ষতায় আস্থা হারাইনি। তাই হয়তো ফিরে আসতে পেরেছি।
প্র: সেই হার-না-মানা অধিনায়ক এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। এজবাস্টনে ভারতীয় দলকে হারতে দেখে তাঁর কী প্রতিক্রিয়া?
সৌরভ: টেস্ট ম্যাচটা আমাদের জেতার ছিল। শেষ ইনিংসে অনেক রানই তাড়া করতে হচ্ছিল ইংল্যান্ডকে। ওরা ভাল খেলেছে নিশ্চয়ই কিন্তু রানটাও অনেকটা পেয়েছিলাম আমরা।
প্র: দল নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠছে...
সৌরভ: ম্যাচ হয়ে যাওয়ার পরে অনেক রকম কথাবার্তাই হতে পারে। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে মন্তব্য করা তো সহজ।
প্র: ক্রিকেটার ও অধিনায়ক সৌরভ। এখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভ। এর পর কি তৃতীয় ইনিংস অপেক্ষা করছে?
সৌরভ: তৃতীয় ইনিংস হতেই পারে। যদি সুযোগ, সম্ভাবনা আসে নিশ্চয়ই ভেবে দেখা যাবে।
প্র:সেই তৃতীয় ইনিংস কি ক্রিকেট ময়দান ছাড়িয়ে অন্য কোনও জগতে? জন্মদিনে এমন কোনও রেজ়োলিউশন কি নিতে পারেন?
সৌরভ: আপাতত ক্রিকেটের মধ্যে থেকেই ভাবছি। ক্রিকেটের ময়দানের বাইরে যাব কি না, নিশ্চিত নই। বার্থডে রেজ়োলিউশন তেমন কিছু নেই।
প্র: সৌরভ, খুব ভাল কাটুক পঞ্চাশতম জন্মদিন।
সৌরভ: থ্যাঙ্ক ইউ!