গ্রাফিক: সনৎ সিংহ
একজন বলেন, ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতির অবশ্যই মিল রয়েছে। দুটো ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিতে হয়। অন্যজন বলেন, যখন রাজনীতিতে ছিলেন, ক্রিকেটজীবনের সততা নিয়েই রাজনীতি করেছেন।
প্রথমজন এখন বাংলার মন্ত্রী। পাশাপাশি বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফি খেলেন এখনও। দ্বিতীয়জনও মন্ত্রী ছিলেন। এখন রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। ফিরে গিয়েছেন ক্রিকেটে। রাজনীতির ময়দানের প্রতি অনীহাই কি তাঁকে আবার ক্রিকেটে ফিরিয়ে দিল?
প্রথমজন মনোজ তিওয়ারি। আপাতত বাংলার ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। দ্বিতীয়জন লক্ষ্মীরতন শুক্ল। বাংলার প্রাক্তন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী। দু’জনেই ভারতের হয়ে খেলেছেন। খেলেছেন আইপিএলে। দু’জনেই বাংলার ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়কও বটে।
ভারত-পাক সীমান্তের ওপারে যখন উইকেট বাঁচাতে মরিয়া এক ক্রিকেটার আম্পায়ার ‘ম্যানেজ’ করে খেলাটাই ভন্ডুল করে দিচ্ছেন, তখন বাংলার দুই ক্রিকেটার-রাজনীতিক কী বলছেন?
১৯৯২ সালে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিয়ে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ইমরান খান। অতঃপর তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। সেই ইমরানকে নিয়েই এখন পাকিস্তানের রাজনীতি উত্তাল। রবিবার সারা দিন সরগরম ছিল একটাই প্রশ্নে— রাজনীতির ময়দানে ইমরান তাঁর উইকেট বাঁচাতে পারেন কি না। দিনের শেষে দেখা গেল, ম্যাচ বানচাল করে উইকেট টিকিয়ে রাখলেন ‘খানসাব’।
এমনিতে পাকিস্তানের তখ্ত কার দখলে কতদিন থাকবে, তা ঠিক করে রাওয়ালপিন্ডির সেনাছাউনি। সে তিনি জিয়াউল হকই হোন বা বেনজির ভুট্টো অথবা নওয়াজ শরিফ। ইমরানের ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্ব কূটনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লোকজন। অনেকে বলছেন, আমেরিকার বিরোধিতা করে ইমরান রাওয়ালপিন্ডিকে চটিয়েছেন। সে কারণেই তাঁর এমন বিপন্ন অবস্থা। কিন্তু এই ঘটনা আরও একটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে— ক্রিকেটারদের কি আদৌ রাজনীতিতে আসা উচিত। অনেকে মনে করেন, না।
হাতের সামনে উদাহরণ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। যাঁকে গত বিধানসভা ভোটে দাঁড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে সৌরভ সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিক করেছেন কি না, তা নিয়ে তাঁর ঘনিষ্ঠদের মধ্যেও বিতর্ক রয়েছে।
তবে সৌরভ যখন রাজনীতির ময়দান থেকে দূরে সরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন সেই একই সময়ে রাজনীতির ময়দানে নেমে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছেন সৌরভেরই দুই প্রাক্তন সতীর্থ মনোজ এবং অশোক ডিন্ডা। মনোজ তৃণমূলের হয়ে জিতে রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছেন। অশোক জিতেছেন বিজেপি-র হয়ে। তিনি এখন শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিরোধীদলের সদস্য।
আর তাঁদের সমসাময়িক লক্ষ্মী রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছেন। ইমরানের কি রাজনীতিতে আদৌ আসার উচিত ছিল? রাজনীতির ময়দান থেকে পুরোপুরি সরে-আসা লক্ষ্মীর কথায়, “প্রতিটা মানুষের নিজস্ব ইচ্ছার উপর তার জীবন নির্ভর করে। ইমরান যখন দেশকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন, তখন তো কেউ জিজ্ঞাসা করেনি যে ওঁর সেটা করা উচিত ছিল কি না!”
আর মনোজের বক্তব্য, “ইমরান ক্রিকেট থেকে অর্থ-সম্মান সব কিছু পেয়েছেন। তাঁর ক্রিকেট জীবন শেষ হওয়ার পর তিনি কী করবেন, সেটা তাঁর সিদ্ধান্ত। কেউ ধারাভাষ্য দেন, কেউ প্রশিক্ষণ দেন। ইমরান নতুন চ্যালেঞ্জ বেছে নিয়েছিলেন। মানুষের জন্য কাজ করতে হলে রাজনীতিই সেরা জায়গা। হয়তো সেই চ্যালেঞ্জটা নেবেন বলেই রাজনীতিতে এসেছিলেন।’’ কিন্তু এখন তো তিনি ঘোর বিপাকে! মনোজের জবাব, ‘‘এখন ইমরানের যা পরিস্থিতি, সেটা তো রাজনীতিতে হতেই পারে। সেটা জেনেই তো উনি রাজনীতিতে এসেছিলেন।”
সৌরভের নেতৃত্বে খেলেছেন মনোজ-লক্ষ্মী। ইমরানকে খেলতে দেখেছেন। যদিও সে ভাবে কখনও মুখোমুখি দেখা হয়ে ওঠেনি ইমরানের সঙ্গে। সে কারণেই সৌরভ না ইমরান— কে বড় অধিনায়ক, তা নিয়ে তুল্যমূল্য বিচারেও যেতে চান না তাঁরা।
প্রসঙ্গত, এ বিষয়ে মন্তব্য এড়িয়ে গিয়েছেন বিজেপি-র বিধায়ক ডিন্ডা। বারবার তাঁর সঙ্গে হোয়াট্সঅ্যাপে এবং ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছে। কিন্তু কথা বলবেন বলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডিন্ডা মুখ খোলেননি।
সদ্য রাজনীতিতে পদার্পণ-করা মনোজ ২০২১ সালে হাওড়ার শিবপুর কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হয়েছেন। আপাতত তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভায় ক্রীড়া এবং যুবকল্যাণ দফতরের প্রতিমন্ত্রী। খেলার মাঠ থেকে সরে এসে রাজনীতির যে টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়, তা কি একজন ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর ভাল লাগে? আনন্দবাজার অনলাইনকে মনোজ বলেছেন, “রাজনৈতিক টানাপড়েন ভাল লাগে না। কিন্তু কিছু তো করার নেই। আমি তো নিজেই এই রাস্তাটা বেছে নিয়েছি। যখন এই টানাপড়েন সামলাতে হচ্ছে, তখন তো নিজেকে ক্রিকেটার ভাবলে চলবে না। ইমরান খান কত বড় ক্রিকেটার সেটা নিয়ে ভাবলে হবে না। রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে দেখতে হবে। সেটা মেনে নিতে হবে।”
২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের সময়ে মনোজকে রাজনীতিতে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু তখন ক্রিকেটেই বেশি মনোযোগ দিতে চেয়েছিলেন তিনি। করোনা অতিমারি পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ বাতিল হয়। মনোজ নিজেও হাঁটুতে বড় চোট পান। এমন অবস্থায় কত দিন ক্রিকেট থেকে বাইরে থাকতে হবে, তা নিয়ে নিজেও দ্বন্দ্বে ছিলেন মনোজ। ২০২১ সালে ফের ‘দিদি’র ডাক আসে। তখন আর তিনি সেই আহ্বান ফিরিয়ে দেননি। রাজ্যের মন্ত্রী মনোজের কথায়, “মানুষের জন্য ভাল কাজ করার লক্ষ্য নিয়েই রাজনীতিতে এসেছি। প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষের জন্য কাজ করতে হলে তবে কি রাজনীতিতে আসতেই হবে? সেটা নয়। কিন্তু পরিধিটা অনেক বড় হয়। রাজনীতিতে এসে একটা পদে থেকে কাজ করতে পারলে অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছন সম্ভব হয়।”
মনোজের আগমনের সময়কালেই রাজনীতি ছেড়ে মাঠে ফিরেছিলেন লক্ষ্মী। ২০১৬ সালে তৃণমূলে যোগ দিয়ে বাংলার প্রাক্তন অলরাউন্ডার উত্তর হাওড়া থেকে ভোটে জিতে বিধায়ক হন তিনি। মনোজে এখন যে দফতরের প্রতিমন্ত্রী, সেই দফতরে সেই মন্ত্রিত্বেই ছিলেন লক্ষ্মী। কিন্তু ২০২১ সালের ভোটের আগে হঠাৎ করেই রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাংলার রাজনীতির তৎকালীন পরিস্থিতিতে অনেকেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে গিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ্মী যাননি। তিনি দল তো বটেই, রাজনীতিই ছেড়ে দিয়ে ফিরে যান ক্রিকেটে। আপাতত তিনি বাংলার অনূর্ধ্ব-২৫ দলকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। রাজনীতি ছাড়ার কী কারণ ছিল? এখনও পর্যন্ত তা জানাননি লক্ষ্মী। রাজনীতি ছাড়ার কারণ কি ‘ব্যক্তিগত’ ছিল, নাকি রাজনীতির ময়দানের ‘টানাপড়েন’, তা-ও বলতে চাননি লক্ষ্মী। তবে ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তিনি রাজনীতির চেয়ে ক্রিকেট মাঠকেই তাঁর স্বাচ্ছ্যন্দের এলাকা হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
তবে রাজনীতি ছাড়ার কারণ না বললেও রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কারণ নিয়ে লক্ষ্মী অকপট। তাঁর কথায়, “ক্রিকেটার হিসেবে যেখানেই খেলেছি, ভারত হোক বা বাংলা—সৎ ভাবে খেলার চেষ্টা করেছি। সেই সততার সঙ্গেই বাংলার মানুষের জন্য কাজ করেছি। পাঁচ বছর মানুষের ভাল করার চেষ্টা করেছি। মানুষের জন্য আবেগ এবং তাঁদের জন্য ভাল করার কারণেই রাজনীতিতে আসা। নিজের উপর বিশ্বাস ছিল, ক্রিকেটার হিসেবে যেমন বিপক্ষ দলকে সম্মান জানিয়ে সততার সঙ্গে লড়াই করেছি, রাজনীতির ময়দানেও সেটাই করব। যত দিন রাজনীতি করেছি, নিজের দলের প্রতি সৎ থেকেছি এবং বিপক্ষকে কখনও ছোট করিনি।”
লক্ষ্মী সম্ভবত রাজনীতির সঙ্গে ক্রিকেট মাঠের মিল পাননি। তবে মনোজ মিল পেয়েছেন। তাঁর কথায়, “মিল তো অবশ্যই রয়েছে। দুটো ক্ষেত্রেই নেতৃত্ব দিতে হয়। খেলার সময় বিভিন্ন পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়। কখনও হার, কখনও জিত। রাজনীতির মঞ্চেও সেটা থাকে। আমি একটা এলাকার দায়িত্বে আছি। সেই জায়গাটা সামলাতে নেতৃত্ব দিতে হয়। এখানেও পরিস্থিতি আসে যেখানে মতানৈক্য হয়। সেগুলো সামলাতেও হয়। সেই জায়গা থেকে মিল তো অবশ্যই রয়েছে।”
আপাতত দু’জনেই তাকিয়ে আছেন। আটারি সীমান্তের ওপারে হারা ম্যাচ বাঁচাতে পারেন কি না ‘খানসাব’।