গবেষণাপত্র বাতিলের সেই নোট। ইনসেটে, অধ্যাপক জয়ন্ত উদগাঁওকর (বাঁ দিকে) এবং অধ্যাপক এম কে ম্যাথিউ। গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ।
বিজ্ঞানের জগৎসভায় ফের মাথা হেঁট হয়ে গেল ভারতের।
ভারতীয়দের বিজ্ঞান গবেষণার গৌরবময় ঐতিহ্যে ফের পড়ল কলঙ্কের দাগ। গত এক বছরে দ্বিতীয় বার।
দেশের দুই বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র এ বার উঠল কাঠগড়ায়। বিভ্রান্তিকর ছবি ও তথ্যাদি দিয়ে গবেষণার ফলাফল মেলানোর অভিযোগে। সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্রটিকে বাতিল ঘোষণা করলেন একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের জানানো হল, সম্মান রক্ষার্থে তাঁরাই তাঁদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রটিকে প্রত্যাহার (‘রিট্র্যাকশান’) করে নিতে রাজি হয়ে যান।
প্রশ্ন দুই বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীর গবেষণা নিয়ে
বাতিল হয়ে যাওয়া গবেষণাপত্রে কাজ রয়েছে যে দুই বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীর, তাঁদের এক জন কিছু দিন আগে পুণের সর্বভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশান অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার পুণে)’-এর অধিকর্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। অন্য জন সবে অবসর নিয়েছেন। গবেষণার সময় দুই বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীই ছিলেন দেশের জীববিজ্ঞান গবেষণায় ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস (এনসিবিএস)’-এর সিনিয়র অধ্যাপক। মাস কয়েক আগে এই এনসিবিএস-এরই আর এক জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক আরতি রমেশ ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্রটিও একই ধরনের অভিযোগে বাতিল ঘোষণা করে দেয় অন্য একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা গোষ্ঠী।
আগেরটির চেয়ে এ বারের ঘটনায় দেশের বিজ্ঞান মহল আরও বেশি আলোড়িত হয়ে পড়েছে দেশের দুই প্রবীণ ও বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র অভিযোগের কাঠগড়ায় উঠে বাতিল হয়ে যাওয়ায়। অভিযুক্তদের এক জন সম্প্রতি অধিকর্তার দায়িত্ব নেওয়ায় আইসার পুণের মতো দেশের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তিতেও কালির ছিটে লেগেছে বলে মনে করছেন ভারতীয় বিজ্ঞানীদের একাংশ।
তদন্তে নেমেছে টিআইএফআর
এনসিবিএস রয়েছে যে তদারকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হাতে, সেই মুম্বইয়ের ‘টাটা ইনস্টিটিউট ফর ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর মুম্বই)’ তদন্তের জন্য বিষয়টি পাঠিয়েছে অ্যাকাডেমিক এথিক্স কমিটির কাছে। ৯ সদস্যের সেই এথিক্স কমিটির চেয়ার গণিতবিদ অধ্যাপক বেঙ্কটরামন এবং কো-চেয়ার পদার্থবিজ্ঞানী অমল দিঘে।
কাঠগড়ায় কোন গবেষণাপত্র? কী কী অভিযোগ?
যে গবেষণাপত্রটি নিয়ে এত হইচই সেটি প্রকাশিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘বায়োফিজিক্যাল জার্নাল’-এ। পাঁচ বছর আগে, ২০১৬ সালের ২৬ এপ্রিল। গবেষণাপত্রটির শিরোনাম— ‘দ্য প্যাথোজেনিক এ১১৬ ভি মিউটেশন এনহ্যান্সেস আয়ন-সিলেক্টিভ চ্যানেল ফরমেশন বাই প্রায়ন প্রোটিন ইন মেমব্রেন্স’। পাঁচ গবেষকের গবেষণাপত্র। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দুই সিনিয়র অথর, বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী জয়ন্ত উদগাঁওকর এবং এম কে ম্যাথিউ। জয়ন্ত কিছু দিন আগে আইসার পুণের অধিকর্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। আর ম্যাথিউ অবসর নিয়েছেন কিছু দিন আগে।
বায়োফিজিক্যাল জার্নাল কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট গবেষকদের কাছে একটি রিট্র্যাকশান নোটিস পাঠান গত ১৬ নভেম্বর। তাতে লেখা হয়, ‘‘গবেষণাপত্রের যাবতীয় তথ্য পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, নির্দিষ্ট ফলাফলে পৌঁছনোর তাগিদে তথ্য ও ছবিকে বিকৃত করা হয়েছে। ফলাফলের সঙ্গে ছবিকে ইচ্ছাকৃত ভাবে মেলানো হয়েছে। যাতে প্রমাণিত হয়, গবেষণায় নির্দিষ্ট লক্ষ্যেই পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে। তার ফলে ছবি ও তথ্যাদি বিভ্রান্তিকর হয়েছে। একই তথ্য থেকে চারটি পরিস্থিতির চারটি হিস্টোগ্রাম বানানো হয়েছে। যা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। বিপথচালিতও। এই সবের প্রেক্ষিতেই গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট গবেষকরাও সেই অনুরোধ করেছেন।’’
ভুল ধরা পড়তে পাঁচ বছর লাগল কেন?
বিজ্ঞানী মহলে প্রশ্ন উঠেছে, গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার দীর্ঘ পাঁচ বছর পর কেন তার অসঙ্গতিগুলি নজরে এল প্রকাশকদের? কেনই বা সেই ভুলগুলি ধরতে পাঁচটা বছর কেটে গেল জয়ন্ত উদগাঁওকর এবং এম কে ম্যাথিউয়ের মতো দেশের বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানীদের?
দেশের এক প্রথম সারির পদার্থবিজ্ঞানীর কথায়, ‘‘এটা হঠাৎই হয়নি। এর পিছনেও কারণ রয়েছে। মাস কয়েক আগে এনসিবিএস-এরই এক জীববিজ্ঞানী অধ্যাপক আরতি রমেশের প্রকাশিত গবেষণাপত্র একই দোষে দুষ্ট হওয়ার অভিযোগে পরে বাতিল হয়ে যায়। সেই সময় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন এনসিবিএস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই কমিটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সর্বত্র। সেই তদন্ত কমিটি অভিযুক্ত অধ্যাপকেরই পক্ষ নিয়েছে বলে শোরগোল হয় শিক্ষাবিদ মহলে। এর পরেই এনসিবিএস-এর অধ্যাপক, বিজ্ঞানীদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলি খুঁটিয়ে দেখা শুরু করে ‘পাবপিয়ার’ নামে একটি সংস্থা। সেই সুবাদেই জানা যায় ২০১৬ সালে বায়োফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত জয়ন্ত, ম্যাথিউ-সহ পাঁচ জনের গবেষণাপত্রটিতে দেওয়া ছবি ও তথ্যাদিতে প্রচুর অসঙ্গতি ছিল। যেগুলি একেবারেই বিভ্রান্তিকর।’’
খুব দুঃখজনক, বলছেন এনসিবিএস, টিআইএফআর অধিকর্তা
বিষয়টি নিয়ে ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-এর তরফে আলাদা আলাদা ভাবে যোগাযোগ করা হয়েছিল অভিযুক্ত গবেষকদের অন্যতম, অধুনা আইসার পুণের অধিকর্তা জয়ন্ত উদগাঁওকরের সঙ্গে। কথা বলা হয়েছে এনসিবিএস-এর অধিকর্তা সত্যজিত মেয়রের সঙ্গে। ঘটনার তদন্তের জন্য বিষয়টি ৯ সদস্যের যে এথিক্স কমিটির কাছে পৌঁছেছে তার তদারকির দায়িত্বে রয়েছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মুম্বইয়ের সেই টিআইএফআর-এর অধিকর্তা শ্রীনিবাসন রামকৃষ্ণণের সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে ‘আনন্দবাজার অনলাইন’-এর তরফে। তিন জনের কেউই ঘটনাটিকে অস্বীকার করেননি। এ কথাও কবুল করেছেন, বিষয়টি বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে জগৎসভায় ভারতীদের মান-সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে। বিজ্ঞান গবেষণায় যেটা সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সেই তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, তথ্যনিষ্ঠা (বিজ্ঞানীদের পরিভাষায়, ‘রিসার্চ ইনটিগ্রিটি’)-র অভাব এই ঘটনায় (আরতি রমেশের আগের ঘটনাটিতেও) প্রকট হয়েছে। পরীক্ষালব্ধ ফলাফলকে যে ভাবেই হোক কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে মিলিয়ে দিয়ে বাজিমাত করার অপচেষ্টারই প্রকাশ ঘটেছে। যা বিজ্ঞানের গবেষণায় সর্বদা পরিত্যজ্য।
ঘটনাটি যে আদৌ কাঙ্ক্ষিত নয়, তা স্বীকার করেছেন বেঙ্গালুরুর এনসিবিএস-এর অধিকর্তা সত্যজিৎ মেয়রও। তাঁর কথায়, ‘‘একেবারেই অনভিপ্রেত ঘটনা। মোটেইত কাঙ্ক্ষিত নয়। বিষয়টিতে কার বা কাদের গাফিলতি রয়েছে, তা তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে টিআইএফআর-এর অ্যাকাডেমিক এথিক্স কমিটির কাছে। তবে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা গবেষণাপত্রের অসঙ্গতিগুলি চিহ্নিত করেছেন। বিজ্ঞানের গবেষণায় এমন ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়। যদিও বিষয়টি অনভিপ্রেতই।’’
টিআইএফআর মুম্বইয়ের অধিকর্তা শ্রীনিবাসন রামকৃষ্ণণের প্রতিক্রিয়া অবশ্য একটু বেশি সদর্থক। তিনি বলেছেন, ‘‘অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এতে বিশ্বের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তদন্তের জন্য এনসিবিএস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমাদের ৯ সদস্যের অ্যাকাডেমিক এথিক্স কমিটি ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এই ঘটনায় কে বা কারা জড়িত তা খুঁজে বার করতে। কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন বিশিষ্ট গণিতবিদ অধ্যাপক বেঙ্কটরামন। রয়েছেন পদার্থবিজ্ঞানী অমল দিঘের মতো খ্যাতনামা অধ্যাপকরা। এটুকু বলতে পারি, খুবই গর্হিত কাজ। দেখতে হবে, কে বা কারা এই ঘটনায় জড়িত। তার পর অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর তা আমাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে। আশ্বাস দিতে পারি, প্রকৃত দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা হবে না এই তদন্তে। এথিক্স কমিটির রিপোর্ট আমার হাতেই আসবে।’’
কী বলছেন অন্যতম অভিযুক্ত অধ্যাপক জয়ন্ত উদগাঁওকর?
যাঁদের গবেষণাপত্রকে ৫ বছর পর বাতিল ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা গোষ্ঠী, তাঁদের অন্যতম আইসার পুণের অধিকর্তা অধ্যাপক জয়ন্ত উদগাঁওকর বলেছেন, ‘‘গবেষণাপত্রটির যে সব অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলি আমরা মাস তিনেক আগে জানতে পেরেছি।’’
এখানেই প্রশ্ন— তাঁদের গবেষণাপত্রের ভুলত্রুটিগুলি কী ভাবে পাঁচ বছর ধরে জয়ন্ত ও ম্যাথিউয়ের মতো জীববিজ্ঞানীদের নজর এড়িয়ে থাকতে পেরেছিল? তাঁরা কি গবেষণাপত্রের সিনিয়র অথর হওয়ার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছিলেন? তা যখন তাঁরা করেননি, তখন তার দায় কেন তাঁদের উপর বর্তাবে না?
আরও প্রশ্ন— মাসতিনেক আগে এনসিবিএস-এরই আর এক অধ্যাপক আরতি রমেশ ও তাঁর সহযোগীদের গবেষণাপত্রটি একই অভিযোগে বাতিল হওয়ার পরেই কি এনসিবিএস-এর বিজ্ঞানী, অধ্যাপকদের প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলি খুঁটিয়ে দেখা শুরু হয়েছে? তারই পরিণতিতে প্রকাশিত হওয়ার পাঁচ বছর পর জয়ন্ত ও ম্যাথিউয়ের গবেষণাপত্রে প্রকাশিত ছবি ও তথ্যগুলির বিভ্রান্তি পত্রিকা গোষ্ঠীর নজরে এল? জয়ন্তের কথাতেই স্পষ্ট, বিষয়টি পত্রিকা গোষ্ঠীর নজরে আসে মাসতিনেক আগে। তখন তাঁরাও জানতে পারেন!
কার গাফিলতি, তার তদন্ত এখন টিআইএফআর-এর অ্যাকাডেমিক এথিক্স কমিটি করছে। তাই ‘‘এ ব্যাপারে আমি সবিস্তারে এখন আর কিছু বলতে চাই না’’, বলেছেন জয়ন্ত।
কেউই ছাড় পাবেন না: টিআইএফআর অধিকর্তা
তবে তাঁকে যে তদন্ত কমিটির সদস্যদের সামনে হাজির হতে হবে, নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে, তা কোনও রাখঢাক না রেখেই জানিয়ে দিয়েছেন টিআইএফআর মুম্বইয়ের অধিকর্তা শ্রীনিবাসন রামকৃষ্ণণ। তাঁর কথায়, ‘‘জয়ন্ত, ম্যাথিউ-সহ গবেষণাপত্রের সব অথরকেই এথিক্স কমিটির সামনে হাজির হতে হবে। কেউই ছাড় পাবেন না। এ ব্যাপারে যাঁর বা যাঁদের দায় প্রমাণিত হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে দেরি হবে না। তা টিআইএফআর-এর ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হবে।’’
অ্যাকাডেমিক এথিক্স কমিটির কো-চেয়ার পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক অমল দিঘে অবশ্য সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। সম্ভবত বিষয়টি এথিক্স কমিটির বিচারাধীন বলেই। শুধু বলেছেন, ‘‘গবেষণাপত্রটি বাতিল হওয়ার বিষয়ে আমি জানি। তবে তদন্তের ফলাফল কী হবে এখনই সে সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না।’’
জল কত দূর গড়ায়, আপাতত সে দিকেই এখন নজর রাখছে দেশের বিজ্ঞানী মহল।