খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। তাই সময়ে, অসময়ে জল-ডুবিও এখন প্রায় রোজকারই ঘটনা। -ফাইল ছবি।
দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অর্থনৈতিক ভাবে চড়া মাসুল দিতে হবে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারকে। শুধু তা-ই নয়; এই দু’টি রাজ্যের নাগরিকদেরই আর্থিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়ে পড়বে। এই দু’টি রাজ্যের নাগরিকদেরই উপার্জন, জীবনযাপন হয়ে পড়বে সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত।
আর সেটা যত দিন গড়াবে ততই বাড়বে উদ্বেগজনক ভাবে। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা আর মাত্র এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই।
গোটা ভারতের ক্ষেত্রেই ছবিটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে। কারণ, গড় তাপমাত্রা আর এক ডিগ্রি বাড়লেই প্রতি বছরে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) তিন শতাংশ হারে কমবে যদি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার উদ্ভাবনী পথ অবিলম্বে খুঁজে বার করা না যায়।
ভয়ঙ্কর সেই দিন শুরু হয়েও গিয়েছে
এই হুঁশিয়ারি দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও সেবি স্বীকৃত দেশের আর্থিক বৃদ্ধির মূল্যায়নকারী শীর্ষস্তরের সংস্থা ‘ইন্ডিয়া রেটিংস অ্যান্ড রিসার্চ (ইন্ড-রা)’। জানিয়েছে, এই পিছিয়ে পড়ার ছবিটা আর শুধুই ভবিষ্যতের নয়। দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের মাসুল গুনতে ইতিমধ্যেই শুরু করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অসম, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়-সহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি। কারণ, কৃষিনির্ভর এই দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় সব ধরনের ফসলের উৎপাদন উদ্বেগজনক ভাবে কমে গিয়েছে। আরও কমবে ভবিষ্যতে। তার ফলে কমবে কৃষিপণ্যাদির উৎপাদনও।
গভীর সঙ্কটে বাংলার অর্থনীতি, নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তাও
চরম জলাভাব, চরম আবহাওয়ার তীব্রতা ও মেয়াদ, বাস্তুতন্ত্রের উপর ক্রমশই বেড়ে চলা চাপ এবং সুস্বাস্থ্য রক্ষার পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিবেশের ভয়াবহ প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড-সহ কৃষিনির্ভর এই দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির গতি উত্তরোত্তর শিথিল হয়ে পড়বে। ক্রমশই কমবে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন। ফিবছরে অন্তত তিন শতাংশ হারে।
জলবায়ু পরিবর্তনের যে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন খুব বিপদের মুখে পড়ে গিয়েছে সেই ছবিটা বেরিয়ে এসেছে আরও একটি সমীক্ষায়। সেই সমীক্ষাটি চালিয়েছে পৃথিবীর আবহাওয়া ও জলবায়ুর উপর নজর রেখে চলা আন্তর্জাতিক অলাভজনক বিজ্ঞান সংগঠন ‘অ্যাডভান্সিং আর্থ অ্যান্ড স্পেস সায়েন্স’।
ধাক্কায় সবচেয়ে বেসামাল হবে বাংলা, বিহার
দু’টি সমীক্ষারই দাবি, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা কম-বেশি দেশের প্রায় সবক’টি রাজ্যকেই সহ্য করতে হবে। সেই ধাক্কা রাজ্যগুলি কতটা সামলে উঠতে পারবে শেষ পর্যন্ত তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির আর্থিক সঙ্গতির উপর। তাদের অনুসৃত প্রশাসনিক নীতি, সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের উপর।
ইন্ড-রা-র সমীক্ষা জানাচ্ছে, অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কার মাসুল সবচেয়ে বেশি গুনতে হবে দেশের ছ’টি রাজ্যকে। তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ। সেই তালিকায় রয়েছে আরও চারটি রাজ্য— অসম, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও ছত্তীসগঢ়।
দু’টি সমীক্ষারই মোদ্দা বক্তব্য, রাজ্যের অর্থনীতির ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে দেশের মূলত কৃষিনির্ভর রাজ্যগুলির মধ্যে পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও খুব দ্রুত হারে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা ঝাড়খণ্ডকেই সবচেয়ে বেশি সইতে হলেও ব্যক্তিগত স্তরে রাজ্যবাসীর আর্থিক নিরাপত্তা সবচেয়ে বেশি সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়বে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে। তুলনায় সেই নিরাপত্তা কিছুটা কম বিপন্ন হবে ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ়ে। আর এই তালিকায় রাজ্যবাসীর ব্যক্তিগত আর্থিক নিরাপত্তা সবচেয়ে কম ক্ষুণ্ণ হবে অসমে।
আবার জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রাজ্যবাসীর ব্যক্তিগত আর্থিক নিরাপত্তা খুব বেশি সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়লেও অন্ধ্রপ্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে তার প্রভাবটা হবে মাঝারি মানের। একই অবস্থা হবে হিমাচল প্রদেশ, কেরল ও পঞ্জাবেরও।
ধাক্কা সবচেয়ে কম সইতে হবে তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্রকে
রাজ্যের অর্থনীতি ও সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নাগরিকদের ব্যক্তিগত আর্থিক নিরাপত্তা, এই দু’টি নিরিখেই জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা দেশের রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম সইতে হবে মাত্র দু’টি রাজ্যকে— মহারাষ্ট্র এবং তেলঙ্গানা।
সমাধানে কি ততটা তৎপর নয় বাংলা? প্রশ্ন সমীক্ষায়
দু’টি সমীক্ষা এ-ও জানিয়েছে, এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে বার করতে রাজ্যগুলির বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন রোখার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পের সংখ্যা ও সেগুলিতে অর্থবরাদ্দ বাড়তে শুরু করেছে গত এক/দু’দশকে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে দু’টি রাজ্য— অসম ও মহারাষ্ট্র। দু’টি রাজ্যই এই সব খাতে লাগাতার অর্থবরাদ্দ বাড়িয়ে চলেছে গত এক/দু’দশক ধরে।
কোনও বছরে বেশি বরাদ্দ আর তার পরের বছরে কম, এমনটা হচ্ছে না শুধু এই দু’টি রাজ্যেই। এটা কিন্তু হচ্ছে না পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, গুজরাত, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে। এই রাজ্যগুলিতে কোনও বছরে জলবায়ু পরিবর্তন রোখার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ বাড়লে পরবর্তী বছরগুলিতে তা কমানোও হচ্ছে। যা খুবই উদ্বেগজনক, জানিয়েছে দু’টি সমীক্ষাই।