গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গভীর রাতে মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন সরগুজার (বর্তমান ছত্তীসগঢ়) রামানুজ প্রসাদ সিংহদেও। মোটরগাড়ির হেডলাইটের আলোয় হঠাৎ রাস্তার অদূরে জ্বলজ্বল করে উঠল তিন জোড়া চোখ। মুহূর্তের মধ্যে নির্ভুল লক্ষ্যে গর্জে উঠল পাকা শিকারি রামানুজের হাতের রাইফেল। আর ভারতের অরণ্য থেকে পাকাপাকি ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একটি বন্যপ্রাণ প্রজাতি— এশীয় চিতা।
১৯৪৭ সালের সেই রাতে তিনটি চিতাশাবক নিধনের পরেও ইতিউতি চিতা দর্শনের ‘খবর’ শোনা গিয়েছিল। ওড়িশার ঢেঙ্কানলে স্থানীয় এক শিকারির গুলিতে একটি চিতার মৃত্যু হয়েছে বলেও দাবি উঠেছিল। কিন্তু সে বিষয়ে কোনও প্রমাণ মেলেনি। কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাই সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন— ৭০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া চিতা আবার ফিরে আসছে ভারতের অরণ্যে। আফ্রিকার নামিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বৎসোয়ানা থেকে সেই চিতা এনে ছাড়া হবে মধ্যপ্রদেশের কুনো-পালপুর জাতীয় উদ্যান-সহ আরও কয়েকটি সংরক্ষিত অঞ্চলে।
মন্ত্রীর সেই ঘোষণার পরেই প্রশ্ন তুলেছিলেন বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের একাংশ— ভারতে চিতা আসছে বটে। কিন্তু ‘ফিরে আসছে’ কি? সেই সঙ্গেই সামনে এসেছিল এক দশকের পুরনো বিতর্ক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতের ‘গর্ব’ সিংহকে মধ্যপ্রদেশের কুনো-পালপুরে স্থানান্তরের প্রস্তাব আর তা ঘিরে আইনি টানাপড়েনের।
ঘটনাচক্রে, ইউপিএ সরকারের আমলে কুনো-পালপুরেই এশীয় সিংহের বিকল্প বাসস্থান গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, এক মাত্র প্রাকৃতিক আবাসস্থল গুজরাতের গির অরণ্য থেকে কিছু এশীয় সিংহ এনে মধ্যপ্রদেশে তাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা ‘ক্যানাইন ডিস্টেম্পার ডিজিজ’-এর মতো ভয়াবহ মড়ক হলে পুরো প্রজাতিটি যাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়, তা নিশ্চিত করা। দ্বিতীয়ত, গির অরণ্য এবং আশপাশের সংরক্ষিত এলাকায় জায়গার অনুপাতে সিংহের সংখ্যা (বর্তমানে প্রায় ৭০০) বেড়ে যাওয়ায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে তাদের স্থানান্তর নিশ্চিত করা। দেহরাদূনের ‘ওয়াইল্ডলাইফ ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া’ (ডব্লিউআইআই)-র বিশেষজ্ঞ এবং মধ্যপ্রদেশ বনবিভাগের সহায়তায় কুনো-পালপুরে সিংহের শিকারক্ষেত্রে উপযোগী বিস্তীর্ণ তৃণভূমি তৈরির কাজও হয়েছিল সে সময়।
কিন্তু বাদ সাধেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদী। কিছুতেই পড়শি রাজ্যের সঙ্গে ‘সিংহবিক্রম’ ভাগাভাগি করতে রাজি হননি তিনি। নিন্দকেরা বলেন, সিংহ পর্যটন থেকে গুজরাত সরকারের বিপুল আয়ের একাংশ হাতছাড়া হবে বুঝেই সে সময় কড়া অবস্থান নিয়েছিলেন মোদী। বস্তুত, গুজরাতের ‘ইউএসপি’ ধরে রাখতে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিল তাঁর গুজরাত সরকার।
কিন্তু নিরাশ হতে হয় মোদীকে। ২০১৩ সালে বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণন এবং বিচারপতি সি কে প্রসাদকে নিয়ে গঠিত শীর্ষ আদালতের বেঞ্চ সংরক্ষণের স্বার্থে এশীয় সিংহের ‘সেকেন্ড পপুলেশন’ গড়ে তোলার রায় দেয়। গুজরাত সরকারকে সিংহ হস্তান্তরের নির্দেশ দিয়ে কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়তে বলেন দুই বিচারপতি। বছর খানেকের মধ্যেই লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হন মোদী। আর হিমঘরে চলে যায় কুনো-পালপুরে এশীয় সিংহের দ্বিতীয় বসত গড়ে তোলার প্রকল্প।
এর কয়েক বছর পরেই কেন্দ্রীয় সরকারের ‘ঝুলি’ থেকে বেরোয় আফ্রিকা থেকে চিতা আনার পরিকল্পনা। আর তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে চিতা ‘পুনর্বাসনের’ জন্য মোদী সরকারের প্রথম পছন্দ হয় কুনো-পালপুরই। বাঘ বা চিতাবাঘের (লেপার্ড) মতো বড় গাছের জঙ্গল নয়, সিংহ এবং চিতার পছন্দসই শিকারক্ষেত্র হল বিস্তৃত ঘাসবন। মধ্যপ্রদেশের ওই জাতীয় উদ্যান ততদিনে হয়ে উঠেছে সিংহের উপযোগী আবাসস্থল। সেই সঙ্গে চিতারও।
চলতি সপ্তাহে কেন্দ্রের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী অগস্টেই আফ্রিকা থেকে গোটা ছ’য়েক চিতা নিয়ে আসা হবে। এর পর ধাপে ধাপে আনা হবে আরও প্রায় ৪৫টি। কুনো-পালপুরের পাশাপাশি আরও কয়েকটি সংরক্ষিত এলাকায় ঠাঁই মিলবে তাদের।
প্রাচীন যুগ থেকেই পঞ্জাব, রাজপুতানা, উত্তর ভারত, মধ্যভারত, দাক্ষিণাত্য এমনকি, ওড়িশায় ছিল চিতার বসতি। এদের পোষ মানিয়ে ‘কোর্সিং’ (লেলিয়ে দিয়ে শিকার করানোর খেলা)-এর রেওয়াজও প্রায় হাজার বছরের পুরনো। দ্বাদশ শতকে কল্যাণীর চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের দরবারি নথিতে পোষা চিতার সাহায্যে কৃষ্ণসার, চিঙ্কারা শিকারের খেলার প্রসঙ্গ রয়েছে। ‘তুজ্ক-ই-জহাঙ্গিরি’ বলছে, মুঘলরাজ জহাঙ্গিরের পশুশালায় ছিল কয়েক হাজার প্রশিক্ষিত শিকারি চিতা। তাঁর বাবা আকবরের জমানায় আরও বেশি।
কিন্তু এত ‘আদরযত্ন’ সত্ত্বেও এশীয় চিতারা ভারতে বেশি দিন টেকেনি। ব্রিটিশ জমানায় শিকারের পাশাপাশি এর নেপথ্যে রয়েছে আরও দু’টি কারণ— শিকারের উপযোগী তৃণভূমি ধ্বংস করে চাষাবাদ এবং বন্দি অবস্থায় প্রজননে অক্ষমতা। ভারতের মাটিতে অস্তিত্বের লড়াইয়ে পৃথিবীর দ্রুততম স্থলচর প্রাণীটিকেও তাই হার মানতে হয়েছিল।
অস্তিত্বের প্রান্তসীমায় চলে যাওয়া এশীয় চিতাদের একমাত্র প্রাকৃতিক আবাস এখন ইরান। ‘পার্সিয়ান ওয়াইল্ডলাইফ হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ এবং ‘ইরানিয়ান চিতা সোসাইটি’-র সমীক্ষায় দাবি, সে দেশের তুরান সংরক্ষিত অঞ্চল-সহ কিছু এলাকায় এখনও কিছু এশীয় চিতা টিকে রয়েছে। তবে সংখ্যায় তারা ১০০-র কম। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে অংশ নেওয়া ইরান টিমের জার্সিতেও ছিল এশীয় চিতার ছবি।
ঘটনাচক্রে, মনমোহন সিংহের সরকারের আমলে ২০০৯ সালে ইরান থেকে এশীয় চিতা আনার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল। এ বিষয়ে তেহরানের প্রাথমিক সম্মতিও মিলেছিল। তবে এশীয় চিতার বিনিময়ে ভারত থেকে এশীয় সিংহ চেয়েছিল ইরান। একদা ভারতের মতো ইরানও ছিল এশীয় সিংহের প্রাকৃতিক বাসভূমি। কিন্তু পরে সেখান থেকে বিলুপ্ত হয় তারা। ঠিক যে পরিণতি হয়েছিল ভারতের বাসিন্দা এশীয় চিতাদের।
পড়শি রাজ্য মধ্যপ্রদেশকে সিংহ দিতে নারাজ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী মোদী যে কোনও অবস্থাতেই ইরানকে সিংহ দিতে রাজি হবেন না, তা বুঝতে পেরে তখন আর কথা এগোয়নি ইউপিএ সরকার। আফ্রিকা থেকে চিতা আনার একটি প্রস্তাব এলেও তা নিয়ে কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি।
জিনগত বিবর্তন বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে আফ্রিকার চিতার (বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘অ্যাসিনোনিক্স জুবেটাস জুবেটাস’) থেকে জন্ম হয়েছিল তার জাতভাই এশীয় চিতার (বিজ্ঞানসম্মত নাম ‘অ্যাসিনোনিক্স জুবেটাস ভ্যানাটিকাস’)। সেই থেকে তারা ভিন্ন উপপ্রজাতি। অর্থাৎ ভারতের মাটি কখনওই মোদী সরকারের আনা চিতাদের বাসভূমি ছিল না। প্রসঙ্গত, আফ্রিকা এবং ভারতে চিতাবাঘ বা লেপার্ডের দেখা মেলে। চেহারায় চিতা এবং চিতাবাঘের কিছুটা মিল রয়েছে। তবে চিতার শরীরে কালো ছোপগুলি ভরাট। চিতাবাঘের ক্ষেত্রে তা নয়। তা ছাড়া, দু’চোখের পাশ দিয়ে মুখ পর্যন্ত গড়িয়ে আসা কালো দাগ বা ‘টিয়ার মার্ক’ দেখে সহজেই চিনে নেওয়া যায় চিতাকে।
চিতার ‘বহিরাগত’ উপপ্রজাতিটিকে ভারতীয় বনাঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে ঠাঁই দেওয়া সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়োজনীয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল কয়েক বছর আগে। বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলাও হয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে শীর্ষ আদালত বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে পরীক্ষামূলক ভাবে আফ্রিকা থেকে চিতা আনার ছাড়পত্র দেয়। যদিও ভারতীয় আবহাওয়ায় মুক্ত পরিবেশে শেষ পর্যন্ত আফ্রিকার সাভানা তৃণভূমি থেকে তুলে থেকে আনা প্রাণীগুলি টিকে থেকে বংশবৃদ্ধি করতে পারবে কি না, তা নিয়ে বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের একাংশ সন্দিহান।
রয়েছে অন্য বিপদও। বর্তমানে রাজস্থান সীমানা লাগোয়া কুনো-পালপুরের স্থায়ী বাসিন্দা গোটা তিরিশেক চিতাবাঘ (লেপার্ড)। অদূরের রণথম্বৌর ব্যাঘ্র প্রকল্প আর কৈলাদেবী অভয়ারণ্য থেকে বাঘের আনাগোনাও ঘটে প্রায়শই। ‘বহিরাগত’ চিতাদের সঙ্গে তাদের সঙ্ঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে। চিতা গবেষক ডেরেক জোবার্ট জানিয়েছেন, আফ্রিকায় প্রতি ১০টি চিতার মধ্যে একটি মারা পড়ে সিংহ বা লেপার্ডের সঙ্গে সঙ্ঘাতে। ভারতেও এমনটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নামিবিয়ার চিতা সংরক্ষণ প্রকল্পের আধিকারিক লরি মার্কারের কথায়, ‘‘রোগ বা শিকারি প্রাণীর হানায় চিতার ৯০ শতাংশ শাবকেরই মৃত্যু হয়।’’ অচেনা পরিবেশে সেই হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আফ্রিকা থেকে ৫০টি চিতা এনে ভারতে তাদের বসত গড়ার প্রকল্প সফল হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। এই পরিস্থিতিতে তাই অনেকেই মনে করছেন, বৈজ্ঞানিক বা সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ নয়, মোদী সরকারের ‘চিতা ফেরানোর’ উদ্যোগে একেবারেই রাজনৈতিক।
তবে ভারতের বনাঞ্চলে ‘বহিরাগত’ বন্যপ্রাণী আনা নিয়ে বিতর্ক এই প্রথম নয়। ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় ব্রিটেনের একটি চিড়িয়াখানা থেকে বাঘিনি তারাকে এনে ছাড়া হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের দুধওয়া ব্যাঘ্রপ্রকল্পে। সাইবেরীয় বাঘ এবং ভারতীয় বাঘের বর্ণশঙ্কর তারাকে মুক্ত পরিবেশে ছাড়ার বিরোধিতা করেছিলেন তৎকালীন বন্যপ্রাণ বিশারদদের অনেকেই। তাঁদের আশঙ্কা ছিল, এর ফলে দুধওয়ার বাঘ জিনদূষণের শিকার হবে। যদিও চার দশক আগেও এমন আশঙ্কায় কর্ণপাত করেননি তৎকালীন শাসকেরা।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।