ঝুরঝুরে নয়, গলাভাতও নয়, বাঙালির চাই জুঁইফুলের মতো ঝরঝরে ভাত। ছবি : সংগৃহীত।
মাছ-ভাতেই বাঙালির নাম! মগনলাল মেঘরাজ হলে অবশ্য বলতেন, ‘‘নাম বলছেন কেন, বদনাম বলুন। সচ্চি কথা বলুন।’’ তবে বাঙালির সেই ‘বদনাম’ নিয়ে মাথা ঘামাতে বয়েই গিয়েছে। কে, কী বলল, কেন বলল— এ সব শুনিয়ে বাঙালির ভাত খাওয়া আটকায়, এমন সাধ্যি কার! বাঙালি ঠিকই ডাল-ভাত নাকেমুখে গুঁজে স্কুল-কলেজ-অফিস অভিমুখে রওনা হবে। বাড়ি ফিরে ধীরেসুস্থে আবার সেই ভাতেই সব্যঞ্জনে করবে উদরপূর্তি। শুধু কি তাই? স্বয়ং ঈশ্বরের দেখা পেয়েও বাঙালি তার সন্তানের জন্য ‘দুধেভাতে’ থাকারই আর্জি পেশ করে। বাঙালির ‘ভেতো’ নামকরণ তাই সর্বান্তকরণেই সার্থক।
এখানে শেষ হলেও না হয় হত। কিন্তু ভাত হতে হবে ঝরঝরে। তবে গিয়ে স্বাদ খুলবে ইলিশ কিংবা নিরামিষ চচ্চড়ির। ভাত রান্না মোটেও সহজ নয়। সামান্য ভুলেই ভেস্তে যায়। বাঙালির ভাতে তো কেবল জুঁইফুলের মতো ভুরভুরে গন্ধ হলে চলে না, তা ঝরঝরেও হতে হয়। তবে আবার ঝুরঝুরে হলে হবে না।
ভাত রাঁধা সহজ নয়। অনেকেই কথায় কথায় বলেন, জলভাত। ভাত কিন্তু অত সহজ বিষয় নয়। ভাত রান্না শিখতে হয়। ঠিক-ভুল জানতে হয়। এমনই বলে থাকেন মা-কাকিমারা। কিন্তু মায়েদেরও তো ভুল হয়। কী সেই ভুল, যা একেবারে ভেস্তে দিতে পারে সব?
এ প্রশ্নের জবাব যাঁরা সবচেয়ে ভাল দিতে পারবেন, সেই বাঙালি হেঁশেলের সর্বময় কর্ত্রী মায়েদের দ্বারস্থ হওয়া গেল। প্রশ্ন শুনে তাঁরা যা বললেন, তার সারার্থ— ভাত যতই বঙ্গজীবনের অঙ্গ হোক না কেন, রোজ সুসিদ্ধ অথচ ঝরঝরে ভাত রাঁধতে পারা ‘সিদ্ধিলাভ’-এর চেয়ে কম কিছু নয়। শর্বরী বসু বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরেই। তার পর থেকেই একান্নবর্তী পরিবারের রান্নাঘরের দায়িত্ব এসে পড়ে ঘাড়ে। গত প্রায় ৪০ বছর ধরে ভাত বানাচ্ছেন। বয়স এখন ৫৮। শর্বরী বলছেন, ‘‘ভাত বানানোটা অঙ্কের মতো।’’ আর সেই অঙ্ক মেনে প্রতি দিনই ঝরঝরে ভাত হয় তাঁর। তাঁর টোটকা— ‘‘যে পাত্রে ভাত রাঁধি, তার থেকে আঙুলের দু’গাঁট কম জল নিই। আর পাত্রের মুখে ঢাকা দিই না। ফুটে গেলে আঁচ কমিয়ে দিই। এ ভাবে ঠিক ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যে ভাত ঝরঝরে সিদ্ধ হয়ে যায়।’’
৬৮ বছরের প্রীতি সিংহ যদিও মনে করেন, ভাত রান্নাকে ও রকম অঙ্ক দিয়ে মাপা যায় না। প্রীতিকে হেঁশেল ঠেলতে হয়েছে না হক বছর পঞ্চাশ। ইদানীং ‘রান্নার দিদি’ সে দায়িত্ব সামলে নিলেও মাঝেমধ্যে তাঁকে আসরে নামতে হয় না, তা নয়। প্রীতি তাঁর অভিজ্ঞতার ঝাঁপি হাতড়ে বলছেন, ‘‘ভাত রাঁধার ও রকম বাঁধাধরা নিয়ম থাকতে পারে না। ফলে ভুল হওয়ারও কোনও নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নেই। ভাত দাঁড়িয়ে দেখে করতে হবে। কারণ, গোটাটাই নির্ভর করছে চালের উপর। আর সব চাল তো সমান হতে পারে না। কোনও চাল তাড়াতাড়ি সিদ্ধ হয়। কোনওটা দেরিতে। সেটা আগে থেকে বুঝব কী করে?’’
সুনেত্রা পেশায় সরকারি চাকুরে। আবার এক জন মা-ও। রোজ সকালে কাজে বেরোনোর আগে সন্তান এবং স্বামীর জন্য ভাত নিজের হাতেই রেঁধে আসেন। তিনি বলছেন, ‘‘হাঁড়িতেই ভাত রাঁধি। আন্দাজও আছে একটা। কিন্তু তা-ও কোনও কোনও দিন ভাত গলে যায়। সময় আর জলের আন্দাজ ঠিক রেখেও দুর্ঘটনা যে ঘটে না, তা নয়।’’ সুনেত্রাও ভাত রান্নার সময় ঢাকনা ব্যবহার করেন না। আবার চাকরির জন্য পেয়িং গেস্ট হিসাবে থাকা দেবযানী বন্দ্যোপাধ্যায় ভাত রান্না করেন ঢাকা দেওয়া ‘ডিপ প্যানে’। পেইং গেস্ট হিসাবে এর থেকে বেশি বাসন রাখা সম্ভব নয়। তাই ওই প্যানেই অধিকাংশ খাবার বানিয়ে নেন। দেবযানী বলছেন, ‘‘বাড়িতে গলা ভাত খেতে পারি না। কিন্তু নিজে যখন বানাই, কিছুতেই ঝরঝরে ভাব আনতে পারি না। অগত্যা যা হয়, তা খেয়েই অফিসে যাই।’’ দেবযানীর হাতের বিরিয়ানি-চিকেন চাপ-চিকেন টিক্কা মশালা খাওয়ার ভক্ত অনেকেই। কিন্তু ভাতে তিনি আজও পাশ করতে পারলেন না। দেবযানীর কথায়, ‘‘কোনও কোনও দিন দুর্ঘটনাবশতই ভাত ঝরঝরে হয়ে যায়। সে দিন নিজেই অবাক হয়ে যাই। ভাবি আজ কোনটা ঠিক করেছি, যেটা অন্য দিন করি না!’’
বেসরকারি সংস্থায় চাকরিরতা সঙ্গীতা আবার জানাচ্ছেন, ভাত রান্নার সময়ে তিনি আর যে ভুলই করুন, পাত্রের মুখে চাপা দেন না। সঙ্গীতার কথায়, ‘‘অনেকেই পাত্রের মুখে চাপা নিতে বলেন। আমিও দিই না। মাঝেমধ্যে অন্য কোনও কারণে ভাত গললেও, তাড়াহুড়োর জীবনে ওই সামান্য টোটকায় আমি মোটামুটি নিজের জন্য ঝরঝরে ভাত বানিয়ে ফেলতে পারি।’’ অর্থাৎ, বাঙালি হয়েও ভাত রান্নায় ‘সিদ্ধি’ লাভ না করাটা লজ্জার নয়। এমন হামেশাই ঘটে আসছে। রাঁধুনিরা বলছেন, ভাত বানানোর ব্যাপারে এত রকম পরামর্শ আর টোটকা চালু আছে যে, সে সব শুনে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়াই স্বাভাবিক! চাল কতটা ধোবেন? কত ক্ষণ ভিজিয়ে রাখা হবে? জল কতখানি দিতে হবে? হাঁড়ির ঢাকনা খোলা যাবে কি না! ভাত রান্না নিয়ে যেমন প্রশ্নের শেষ নেই, তেমনই শেষ নেই নানা ধরনের উত্তরের।
কেউ বলেন, ভাত রান্নায় জলই আসল। কেউ বলেন জলের ব্যবহার নির্ভর করে চাল কতটা পুরনো তার উপর। কথায় আছে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। পাকা রাঁধুনিরা যদিও বলছেন, ভাতে বাড়ুক বা না বাড়ুক, পুরনো চালের ক্ষেত্রে জলের মাপে সামান্য হেরফের হলে ভাত হঠাৎ করে গলে যায় না। কিন্তু নতুন চালের ক্ষেত্রে জল নিয়ে অনেকটাই সাবধান হতে হবে। কারণ, নতুন চাল যে হেতু অনেক বেশি নরম, তাতে ‘স্টার্চ’-এর পরিমাণও বেশি। সামান্য বেশি জলেই তাই গলে যেতে পারে ভাত। তবে বাঙালি হেঁশেলের চাবি যাঁদের আঁচলের খুঁটে বাঁধা, তাঁদের পরামর্শ নিলে দেখা যাচ্ছে, ভাত রান্নায় একটি ভুল এড়িয়ে চলেন অনেকেই। তা হল, পাত্রের মুখে চাপা দেওয়া।
চাল কেমন হবে, তা হাতে নেই। কিন্তু পাত্রের উপর ঢাকা দেবেন কি না দেবেন, তা নিজের হাতেই। হাঁড়ি যদি রান্নার সময়ে খোলা থাকে, তবে ভাত গলে যাওয়ার আশঙ্কা কম। এমনই শেখাচ্ছে বাঙালি বাড়ির মা-ঠাকুমাদের অভিজ্ঞতা।
তাই ওই একটি ভুল এড়ালেই ভেতো বাঙালি সুখে থাকবে মাছ আর ঝরঝরে ভাতে।