Samaresh Basu

এক কলমে সমরেশ, আর একটিতে কালকূট

স্বনামে লেখা কঠিন, কর্কশ, বাস্তবতাধর্মী রচনার একেবারে বিপ্রতীপে তিনি নিয়ে এসেছিলেন কালকূটের কুয়াশাচ্ছন্নতা, তন্ময় বৈরাগ্য ও নিয়তিবাদ। সার্থক সাহিত্যিকের তৃতীয় নয়ন বা ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে অপরের জ্বালা-যন্ত্রণা ও দহন নিজের করে নিয়েছিলেন সমরেশ বসু। আগামী ১১ ডিসেম্বর পূর্ণ হবে তাঁর শতবর্ষ। তিলোত্তমা মজুমদার

Advertisement
তিলোত্তমা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:০৯
ছবি কুনাল বর্মণ।

ছবি কুনাল বর্মণ।

নিয়তিবাদীদের বিশ্বাস, জন্মলগ্নেই মানবের সারা জীবনের ইতিবৃত্ত রচিত হয়ে যায়। বাস্তববাদীরা বলে, কর্মই জীবনের পথ রচনা করে। দুই মতবাদের মধ্যে বিরোধ আছে, সেই সঙ্গে, প্রত্যেকটি দৃষ্টিকোণই বিতর্কসাপেক্ষ। কিন্তু সমরেশ বসুর জীবনের গতিপ্রকৃতি দেখলে উভয় পথই এই সিদ্ধান্তের দিকে ইঙ্গিত করে, সাহিত্যই তাঁর কর্ম এবং নিয়তি।

Advertisement

কমিউনিস্ট অথবা অদৃষ্টবাদী

অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলা, মুন্সিগঞ্জ মহকুমা, রাজনগর গ্রামে, ১৯২৪ সাল ১১ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায়, সমরেশ বসুর জন্ম হয়েছিল। তিনি বহুপ্রসূ কলমের অধিকারী। সমরেশ বসু নামে ক্রমাগত লিখেছেন ছোটগল্প ও উপন্যাস। অতঃপর আবির্ভূত হলেন কালকূট। সমরেশ বসুর লিখনশৈলী ও বিষয়বস্তুর থেকে অনেকখানি ব্যবধান রচনা করেও বাঙালি পাঠকের হৃদয়ে অনায়াসে স্থান নিলেন।

তাঁর উপন্যাসগুলি এবং অধিকাংশ ছোটগল্প বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বার বার টান পড়েছে তাঁর জীবনকথার সুতোয়। তাঁর এক-একটি উপন্যাসের অনিবার্য প্রেক্ষাপট হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনের এক-একটি টুকরো। সেই সব প্রেক্ষাপট থেকে আলোকসম্পাত হয়েছে তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার বিভিন্ন দিকে। প্রশ্ন উঠেছে, তিনি আজীবন কমিউনিস্ট কি না। জিজ্ঞাসা উত্থাপিত হয়েছে, তিনি নিয়তিবাদী কি না।

এ কথা ঠিক যে, জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সাহিত্যিকের রচনাসম্পদ ঋদ্ধ করে। কিন্তু শুদ্ধ অভিজ্ঞতাই সাহিত্যরচনার অবলম্বন হতে পারে না। সার্থক সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন হয় তৃতীয় নয়ন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়, কল্পনাশক্তি, যা দিয়ে দগ্ধ হতে থাকা অপর জনের জ্বালাযন্ত্রণা নিজের হয়ে ওঠে। এই দেহাতিরিক্ত গুণগুলি সমরেশ বসুর যাবতীয় রচনায় ছড়িয়ে আছে। নিজের মধ্যেই থাকে যে দ্বন্দ্ব ও অচেনা ব্যক্তিত্বের সমাহার, তা সর্বসময় বর্তমানের অনুভূতির পরোয়া না করে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত অনুভবের সৃষ্টি করে তুলতে পারে। প্রবল বিচ্ছেদকাতরতার মধ্যেও লিখিত হতে পারে মিলনের বৈভব, অথবা হাস্যরস। যুদ্ধ ও ধ্বংসের অসহনীয় বীভৎসতার মধ্য থেকে লিখিত হতে পারে কামার্ত রচনাবলি।

কখনও কখনও নৈর্ব্যক্তিকতার নিরাসক্তি সাহিত্যিকের কলমে আসামান্য রচনার জন্ম দেয়। যেমন, ‘ধর্ষিতা’ গল্পটি। এ গল্পে লেখক স্বয়ং এক জন চরিত্র। স্থান ও কাল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ, যার জলে, মাটিতে, হাওয়ায়, সূর্যালোকে, মানবহৃদয়ে দগদগ করছে স্বজনের রক্তগন্ধ, বিয়োগব্যথা, অত্যাচারিতের আর্তনাদ ও কান্না, যার সমস্ত দেওয়ালে অদৃশ্য লিপিতে লেখা আছে ঘরছাড়া, সর্বস্ব হারানো, নিপীড়িতের আত্মকথা। সেখানে লেখকের হাতে পৌঁছয় এক ধর্ষিতার নামহীন ডায়েরি। পাঠকের কাছে, লেখকের রচনা হয়ে গড়ে উঠতে থাকা সেই ডায়েরি থেকে লেখক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে ওঠেন। ডায়েরির নিজস্বতা দিয়ে তিনি রচনা করেন এক অভাগিনীর আত্মকথন।

শিক্ষিত, সম্পন্ন বাঙালি পরিবারের বধূ সে। খানসেনাদের অপকর্মের কাহিনি তাকে সারাক্ষণ ত্রস্ত রাখে। তার ভয় হয়, তার তরুণ সন্তান বুঝি বা আক্রান্ত হয় যে কোনও দিন। কিন্তু তার স্বামী বিশ্বাস করে, কখনও তা হবে না, কারণ উচ্চপদস্থ সেনা অফিসারদের অনেকেই তার বন্ধু। এক দিন সে রকম এক পঞ্জাবি বন্ধুকে সে ঘরে নিয়ে আসে, পান-ভোজন করে, স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। অফিসারের কামজর্জর দৃষ্টি সেই বধূকে অন্তরে সঙ্কুচিত করে তোলে। এরই মধ্যে তার তরুণ সন্তান ঘর ছেড়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে বলে। খানসেনারা সেই ছেলের হদিস জানতে আসে, বধূর সামনেই তার স্বামীকে গুলি করে মেরে ফেলে, এবং বধূ যখন স্বামীর মৃতদেহের উপর কান্নায় ভেঙে পড়েছে, এক দল সেনা তাকে ধর্ষণ করতে শুরু করে।

এর পর সেখানে উপস্থিত হয় সেই পঞ্জাবি অফিসার, যে, এই সমস্ত কীর্তির জন্য সকলকে তিরস্কার করে, বধূটিকে নতুন সিল্ক শাড়ি পরতে দেয়। সকলকে সেখান থেকে তাড়িয়ে সে বধূর বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করে এবং স্বামীটির মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ করে। অবশেষে সে বধূর তরুণ পুত্রের সন্ধান করে। বলে, “আপনার ছেলেই আপনাদের এই অবস্থার জন্য দায়ী।” ক্রমে সেই অফিসারের রূপ বদলাতে শুরু করে। সে গর্জন করে, তার পর বধূর রূপ ও ব্যক্তিত্বের প্রশস্তি গায়, অতঃপর তারও মুখোশ খসে যায়। সেই বধূর শক্তিকে সম্পূর্ণ পরাভূত করে সেই অফিসার চরিতার্থ করে আদিমতম রিপু। এই অমানুষিকতার বিবরণ ডায়েরিতে শেষ হল, “আঃ খোদা, আমি অজ্ঞান হলাম না, জীবন্ত দোজখের যন্ত্রণা ভোগ করলাম, আর মনে হল, আমার মাথাটা একেবারে শূন্য।”

ডায়েরির সঙ্গেই এই গল্পের শেষ নয়। এর পর লেখক আবার নিজ চরিত্র ফিরিয়ে এনেছেন এবং সন্ত্রাসপীড়িত, জঘন্য ভাবে অত্যাচারিত নরনারীর সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু ডায়েরি হয়ে থেকেছে তাঁর অনন্য সৃষ্টি। সেখানে তিনি নারীর আত্মার মধ্যে প্রবিষ্ট ছিলেন।

শক্তি ও সত্তা

সমরেশ বসু যখন ‘কালকূট’ ছদ্মনাম গ্রহণ করলেন, নিজের দুই নামের সত্তাকে বিষয়ে, শৈলীতে পৃথক করতে প্রয়াসী হলেন। কালকূটের রচনায় রঙ্গরহস্যপ্রিয়তা, তন্ময় বৈরাগ্য, নিয়তিবাদ এবং অনেকটা বাউলিয়া মনের রসস্ফূর্তি, সমরেশ বসুর কঠিন কর্কশ বাস্তবতাধর্মী রচনার থেকে একেবারেই পৃথক। কালকূটের চরিত্রগুলি কুয়াশাচ্ছন্ন, তারা শূন্যে ভ্রাম্যমাণ, কিংবা মহাকাব্যিক। সমরেশ বসুর চরিত্ররা রক্তমাংসের গন্ধ ছড়িয়ে বেঁচে থাকা বা বাঁচতে চাওয়া মানুষ। অথচ তিনি লিখছেন একই কালে। একই উপলক্ষে, দুই ভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে দুই নামে লিখিত ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস।

এই সব গল্প ও উপন্যাসের চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে তাঁর প্রথম জীবনের কমিউনিস্টিক বীক্ষণ কখনওই জেদি ও জগদ্দল হয়ে ওঠেনি। মানুষ প্রয়োজনের নিরিখে মতবাদ গ্রহণ করে এবং ক্রমে পরিবর্তিত হতে হতে সেই মতবাদের বিপরীতে পৌঁছে যেতে পারে, এই নিরপেক্ষ দর্শনের অধিকারী ছিলেন সমরেশ বসু। ধরা যাক, ‘ফটিচার’ গল্পটি। এর মধ্যে দিয়ে সমরেশ বসুকে দেখলে তাঁর মনোজগতের বিবর্তন ও জীবনসূত্র এক মাত্রায় নিয়ে আসার প্রয়াস পণ্ডশ্রম হয়ে উঠবে। এ গল্পের রতনলাল একদা মজদুর ছিল। তখন বিপ্লব শিখেছিল। সে কারণে তার জেল হয়। এখন সে ব্যবসায়ী। বৌয়ের গয়না বেচে চারটে রিকশা কিনেছে, অর্থাৎ, সামান্য হলেও তার পুঁজি আছে, তার মালিকানায় চার জন দারিদ্রদীর্ণ চালক আছে, যাদের শ্রমিক ও সর্বহারা বলা যায়। যদিও রতনলাল নিজেকে এখনও এক জন বিপ্লবী মজদুর বলেই মনে করে, এবং তার রিকশাচালকদের কাছে গল্প করে, “আমি বামুনের ছেলে। আমার বাপ কেরানি ছিল। আমি মজদুর হয়েছি। মানুষ এই রকম ধাপে ধাপে আজ নেমে যাচ্ছে।”

কী অনায়াসে লেখক বলে দিচ্ছেন, কমিউনিস্ট বিপ্লবীর মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বুর্জোয়া সংস্কারের কথা। বামুনের ছেলে, কেরানির ছেলে মজদুর হয়ে মানুষ হিসেবে ধাপে ধাপে নেমে যাচ্ছে। অথচ সে তার নিজের রিকশাচালকদের কাছে এক জন বিপ্লবী নায়ক হয়ে ওঠার প্রয়াসী। সে মনে করে এক দিন সে বিপ্লবের জন্য, মজদুরের অধিকারের জন্য প্রাণ দেবে, এই রিকশাচালকেরা সেই বিপ্লবে অংশ নেবে। এবং প্রতিদিন প্রত্যেক রিকশার পাওনাগন্ডা সে বুঝে নেয়, উপার্জন কম হলে তিরস্কার করে এবং চালকদের সততার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে। এক চালকের মায়ের মৃত্যুর কারণে এক সপ্তাহ রিকশা না চালানোর ক্ষতি সে বরদাস্ত করে না। সে চালককে প্রহার করে, এক সপ্তাহের ক্ষতিপূরণ দাবি করে।

এর পর? গল্প কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছেন লেখক?

প্রতিবাদ হিসেবে বাকি তিন জন, লেখক যাদের এঁকেছেন ছায়ার মতো, শীতে কাঁপতে থাকা, মালিকের গর্জনে কাঁপতে থাকা মানুষ, তারা রিকশা না চালিয়ে চুপ করে বসে থাকে। রতন তাদের ধিক্কার দেয়। প্রবল রাগে বলে, “তোরা লড়িয়ে মজুরের নকল করছিস। তোরা বেইমান, চোট্টা, আমাকে ভয় দেখাচ্ছিস। আমি রতনলাল পাঠক, মজদুর আমাকে চেনে। আমার বিরুদ্ধে স্ট্রাইক?”

সে রিকশার চাকায় তালা দিয়ে দেয় এই বলে, “মর শালারা না খেয়ে।” এ যেন পুঁজিপতির কারখানায় লক আউট ঘোষণা। শেষ পর্যন্ত রতন রিকশাচালকদের শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয় এই জন্য যে, রিকশা বসে থাকার ফলে তার নিজের সংসারে অনটন দেখা দিচ্ছে, বৌ রতনকে তিরস্কার করে ‘লক্ষ্মী’ চিনিয়ে দিচ্ছে। ‘লক্ষ্মী’ অর্থাৎ রিকশা, যারা ঘরে টাকা আনে।

এই গল্পের রিকশাচালকেরা রতনের বিপ্লবের গল্পে উদ্বুদ্ধ হয়নি, দারিদ্র এবং কঠিন বাস্তবের প্রহার তাদের প্রতিবাদী করেছে। তারা রতনের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদে বিচার চাইছে। এই বিচার এক জন মানুষ চায় আর এক মানুষের জন্য। এখানে ধনতন্ত্র, কমিউনিজ়ম, সাম্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদ নেই। আছে শুদ্ধ মানবিকতার দাবি। উল্টো দিকে, রতন, যে মজদুরের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, যে এক সার্বিক বিপ্লব ও মুক্তির স্বপ্ন দেখে, স্বার্থে আঘাত লাগামাত্র সে হয়ে ওঠে শোষকের সত্তা।

লেখক নিরুচ্চারে যা বলছেন তা হল, বিপ্লবের মূল উৎস স্বাধীন চিন্তার ক্ষমতা। জাগ্রত চেতনা। মানবিকতাবোধ। ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে এই চেতনার ধারক হতে পারে।

সমরেশ বসু।

সমরেশ বসু।

শরীর বিষয়ে বৈপ্লবিক অকপটতা

নিজের ভিতর এই স্বাধীন চেতনা ছিল বলেই সমরেশ বসু আজ থেকে পাঁচ বা ছয় দশক আগে লিখতে পেরেছেন ‘প্রজাপতি’ ও ‘বিবর’। সামাজিক সত্য শুধু রাজনীতি, অর্থনীতি নয়। যৌনতা অপর এক বৃহৎ সত্য, যা সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত, নানা ভাবে, নানা রূপে সমাজের নিয়ন্ত্রক— এই অকপটতা আধুনিক সাহিত্যে তিনি নিয়ে এসেছেন বৈপ্লবিক ভাবেই। তাঁর রচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, যৌনতা কখনও সাহিত্যরস অতিক্রম করেনি। কানায় কানায় ভরা ছিল তাঁর ভারসাম্য বোধ। ‘প্রজাপতি’র সুখেন্দু, অপরিসীম তার কামুকতা, তার চরিত্রচিত্রণ বিরল শৈলীতে, সামান্যতম ভানের পরোয়া না করে যে ভাবে রচিত হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত এক উচ্চমার্গের, অতুলনীয় উপন্যাস। সুখেন্দু নারীশরীরকে যে ভাবে দেখছে, কামার্ত চোখ তেমনই বিশ্বাসযোগ্য ভাবে সঞ্চরমাণ। এই সুখেন্দুর গভীর বিপন্নতা আছে নিজের মনের ভিতর। একাকিত্ব ও নিরাপত্তাহীনতার আমূল আক্রমণ থেকে জন্ম নেওয়া বিপন্নতা। ‘প্রজাপতি’ উপন্যাস প্রকৃত প্রস্তাবে এক তরুণের মানসিক যাত্রাপথ, যা কখনও তার যৌনতাবোধ ও প্রবণতা ব্যতীত পূর্ণতা পায় না। একান্তে সুখেন্দু জানে, “সেই একরকমের ভয় পাওয়া, আর বুক গুরগুরিয়ে ওঠা, বুকের মধ্যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া এক ধরণের যন্ত্রণা, চোখে জল এসে পড়ার ব্যাপারটা যে আমার খুব ছেলেমানুষি বয়সের, তা না।”

‘প্রজাপতি’ তারুণ্যের উন্মাদনা বহন করে দীর্ঘ পথের শেষে যে পরিণতিতে পৌঁছয়, সেখানে কালোপযোগী অন্তিম তিনি বেছে নিয়েছেন ঠিকই, সেই সঙ্গে যৌনতা অতিক্রমকারী প্রেমের জয়ধ্বনিও শুনিয়েছেন।

সাহিত্যগুণ

পর্যবেক্ষণ, বর্ণনা, চরিত্রচিত্রণ ইত্যাদি সাহিত্যগুণে সমরেশ বসু প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ঋদ্ধ। তাঁর চিন্তাজগৎ থেকে যা কিছু উৎপন্ন হয়েছে, সেগুলির গভীর উপলব্ধি ও নিপুণ বর্ণনা, সংলাপের যথার্থতা অধিকাংশকেই দিয়েছে সর্বকালীনতা। ধ্রুপদী মর্যাদা। যেমন, ‘ছায়া ঢাকা মন’ উপন্যাসে আগাগোড়া যে ছায়ানিবিড়তা, যা বিষাদের, অভিমানের, যা উচ্চমধ্যবিত্তের তন্ময় চিত্রণ, তার মূল চরিত্র কলেজপড়ুয়া শমীকের বর্ণনায় তিনি লিখছেন, “ফরসা কাঁচা মুখ, এখনও ব্লেডের ছোঁয়া লাগেনি। অথচ পাতলা নরম গোঁফদাড়ি উঠেছে। সেখানে এখনও রেজারের টান পড়েনি বলেই, ওর মুখ যেন আরও কচি মনে হয়। যেমন কচি লাউডগার গায়ে নরম শুঁয়ো, তার কচি ত্বককে আরও কোমল করে তোলে, সেইরকম।”

শমীকের বাবা শরৎ একজন উচ্চপদস্থ আমলা। তাঁকে লেখক চেনাচ্ছেন এইভাবে, “প্রভুত্ব এবং ক্ষমতার প্রতি তাঁর একটু আসক্তি আছে। যখনই তাঁর মনে হয় কেউ অবাধ্যতা করছে, তখনই তিনি রুদ্র হয়ে ওঠেন। নিজের ছেলেমেয়ের ক্ষেত্রেও তাই। তাঁর চাকরির ক্ষেত্রে তিনি যতটা যোগ্য, সমাজ সংসারের ক্ষেত্রে তাঁকে তেমন সচেতন বা বিজ্ঞ বলা যায় না। আর দশটা বড় আমলার মতোই, তিনি গভীর চিন্তার দিক থেকে দরিদ্র এবং সাধারণ। ব্যক্তি হিসেবে রক্ষণশীল।”

তিন-চার দশক আগেও বাঙালি পরিবারে পিতৃতান্ত্রিকতা প্রবল ছিল এবং পিতা বা পিতৃস্থানীয় ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণকামিতা ছিল স্বাভাবিক ধর্ম। সেই দিক থেকে শরৎ গত শতকের এক জন প্রতিনিধিস্থানীয় অভিভাবক।

এই উপন্যাসের সময়কাল সত্তরের দশক, যে সময় কলকাতা শহর উত্তাল, বিশৃঙ্খল, তরুণ ছাত্রসমাজ বিপথগামী। তারা বই খুলে পরীক্ষায় বসে। পরিদর্শককে প্রাণের ভয় দেখায়। গণটোকাটুকিকে অধিকার বলে মনে করে। এই অরাজক পরিস্থিতিতে শিক্ষা দফতর পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয় এবং অমার্জিত অসৎ ছাত্রদের পাশাপাশি যারা পঠনপাঠনকে গুরুত্ব দিয়ে সততার সঙ্গে পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত, তারাও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধতা করে। শরৎ পরীক্ষা বাতিলের পক্ষপাতী। পরিবারে শরৎ ও শমীক, এই মতদ্বৈধ কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে। শমীকের স্পষ্ট প্রতিবাদ তার পিতা শরতের ক্রোধের কারণ হয়। শরতের রোষ, কাঠিন্য এবং রুক্ষভাষ শমীকের গৃহত্যাগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এর পরের লক্ষণীয় বিষয়, উপন্যাসের চলপথ নির্মাণের মুনশিয়ানা। ঘরছাড়া তরুণ শমীকের জীবনে নানা চরিত্রের সমাবেশ ঘটে চলে, নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতা লাভ করে সে। ভালবাসে। কিন্তু ভালবাসার সেই নারীর দগ্ধ জীবন শমীককে ফেলে চলে যায় মৃত্যুতে। একটি চিঠি সে লিখে যায় শমীকের জন্য। বহু চরিত্র ও বহু সংলাপের মধ্যে সেই চিঠি হয়ে ওঠে উপন্যাসের মধ্যে আরও এক উপন্যাসিকা। এক পড়ুয়া, অভিমানী, ঘরছাড়া তরুণের নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার ভিতর সেই চিঠি অধরা নক্ষত্রের মতো জ্বলন্ত অথচ শীতল হয়ে দেখা দেয়। সেই চিঠি বলে, “আমি যাই। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোমার কাছে আমার একমাত্র পরিচয়, এক নারী, নাম তার ডালিয়া। বিশ্বের যে দরজায় তোমার প্রথম স্বপ্নভঙ্গের অপার কৌতূহলে, তীব্র জিজ্ঞাসায় রক্তের দাহে, অবোধ অবাধ্য প্রথম করাঘাত, সেই দরজা আমি খুলে দিয়ে গেলাম। হয়তো আমার জীবনে নিয়তির এ এক অজানা নির্দেশ ছিল, যা আমি পালন করে গেলাম। রূপ ফুরায়, তখন মানুষের রূপের সন্ধান। আজ রাত্রে যা ঘটে গেল, তা একটি ঝলক, তারপরেই জীবন যে অনন্ত দুঃখের, সেই সত্যের আলোয় তুমি যেন সারা জীবন পথ চিনে চলতে পারো টুপু,— তোমার ডালিয়া।”

এই চিঠির মধ্যে সর্বস্ব হারানো নারীর আর্তনাদের সঙ্গে মিশে আছে প্রাপ্তির হাহাকার। সে এমনই নিঃস্ব, এমনই যাতনাদীর্ণ যে, মৃত্যু হয়ে দাঁড়ায় সচেতন অবলম্বন। সে যখন অল্পক্ষণের সুখ ও আনন্দের স্বাদ গ্রহণের অধিকার পায়, সেই পাওয়ার সঙ্গে তার সারা জীবনের না-পাওয়া একাকার হয়ে যেতে থাকে। এই উপন্যাসে চরিত্রগুলি শমীকের জীবনের মূল স্রোতে উপনদীর মতো প্রবেশ করে। শমীকের সূত্র ধরে লেখক নির্মাণ করে চলেন তাঁর উপন্যাস। কখনও কখনও উপন্যাস রচনার এ এক পন্থা বটে, যখন রচয়িতার মনের মধ্যে সূচনা ও সমাপ্তির যাত্রাপথের কোনও কাঠামো নেই। একটি বা দু’টি চরিত্র নিয়ে পথ গড়তে গড়তে এগিয়ে চলা। পাঠকের দুয়ারে যখন তা নিবেদিত হয়, লেখনীর মহাশক্তি তাকে করে তুলতে পারে সুখপাঠ্য। সেখানেই তার সার্থকতা। কারণ যাঁরা বহু লেখেন, তাঁদের এই সত্য গ্রহণ না করে উপায় নেই যে, সমস্ত রচনাই ক্লাসিক হয়ে ওঠে না। কিন্তু পাঠককে কিছু ক্ষণের জন্য কল্পজীবনের আস্বাদনে প্রবেশ করিয়ে দেওয়াও কম সাফল্য নয়। সমরেশ বসু এবং কালকূট, উভয়েই সেই দিক থেকে সিদ্ধ।

বিস্ময়কর ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র

বিষয়বৈচিত্রের নিরিখে সমরেশ বসু যে কোনও ঔপন্যাসিকের পক্ষে ঈর্ষণীয়। তাঁর এই বিষয়সম্ভারের বিস্ময়কর ব্যাপ্তি তাঁর পাঠক এবং আলোচক-গবেষকদের প্ররোচিত করে, তাঁর জীবনের সঙ্গে, এমনকি ব্যক্তি সমরেশ বসুর সঙ্গে, উপন্যাসের প্রেক্ষাপট এবং চরিত্র মিলিয়ে দেখতে। তাঁর নিজের জীবনে বিস্ময়কর বাঁকগুলির কথা মানুষের অজানা নয়। এমনকি সমাজ ও মধ্যবিত্ততার শাসন থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার সাহস তাঁর ব্যক্তিসত্তা ও লেখকসত্তার বৈশিষ্ট্য হওয়ায়, তাঁকে নিয়ে নানাবিধ সত্য অথবা অলীক গল্প পাঠকের কাছে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায়। যৌনতা বিষয়ে তাঁর লেখনীর সততা ও সাহসিকতা তাঁকে প্রায় কিংবদন্তি করে তোলে, যা সব সময় তাঁর ব্যক্তিসত্তার পক্ষে অনুকূল নয়। নিজের রচনাগুলি বিশিষ্ট করে তোলার দুর্নিবার আগ্রহ এ ভাবেই তাঁর কাছ থেকে মূল্য বুঝে নিয়েছে। তিনি যে বেপরোয়া, আপসহীন, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজ তাঁর রচনার শালীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে একাধিক বার। তাঁকে আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু তিনি তাঁর কলমের সঙ্গে দুর্দমনীয় ক্ষমতায় কাজ করে গিয়েছেন জীবনের শেষ বিন্দু পর্যন্ত। এক জন অগ্রজ সাহিত্যিকের কাছে পরবর্তী প্রজন্মের এই ঋণ অপরিশোধ্য।

তাঁর সাহিত্যকীর্তির মধ্যে যেগুলি এক ডাকে উচ্চারিত হয়, যেমন ‘বি টি রোডের ধারে’, ‘মহাকালের রথের ঘোড়া’, ‘গঙ্গা’, ‘বিবর’, ‘প্রজাপতি’, ‘দেখি নাই ফিরে’, ‘কোথায় পাবো তারে’, ‘শাম্ব’ এবং ‘আদাব’ ইত্যাদি গল্প, তার বাইরেও তাঁর সাহিত্যকীর্তি যে আরও বিশদ ও বৃহৎ, তা বিস্ময়কর এবং কৌতূহল উদ্রেককারী। তাঁর অনেকগুলি উপন্যাস ও ছোটগল্প চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে, সেগুলি দর্শক ও পাঠকের সমাদর পেয়েছে। আবার কোনওটি অন্যগুলির খ্যাতির উজ্জ্বলতায় খানিক সঙ্কোচে সামান্য আড়ালে থেকে গিয়েছে। এমনই এক নাম ‘অপরিচিত’, যা উপন্যাস অবয়বে সার্থক। সলিল দত্তের পরিচালনায় চলচ্চিত্র আকারেও অসামান্য।

এই উপন্যাসের এক আশ্চর্য চরিত্র সুজিত। কমলকোরকের মতো তার হৃদয়। সরল, অথচ অনুভূতিগাঢ়। মানসিক রোগ থেকে নিরাময় হয়ে সে এসে পড়ে শহরের জটিলতায়। আকস্মিক সাক্ষাৎ হয় সুনীতার সঙ্গে। সে এমন এক বরাঙ্গনা, যাকে ঘিরে আছে এক গুচ্ছ ব্যাধ, তাদের এক-এক জনের হাতে এক-এক অস্ত্র, কেউ লোভাতুর, কেউ কামনাতুর, কেউ অধিকারকামী, যেন সে এক বহুমূল্য সম্পদ। প্রত্যেকটি চরিত্র নির্মিত হয়েছে বিশ্বাসযোগ্য বাস্তবতায়। চলচ্চিত্রায়নেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অব্যর্থ সাফল্যে সুজিতের ভূমিকা পালন করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, দ্বিতীয় সুকঠিন চরিত্র রঞ্জনের ভার নিয়েছিলেন উত্তমকুমার, সুনীতার ভূমিকায় ছিলেন অপর্ণা সেন।

উপন্যাসের চরিত্রদের চলচ্চিত্রে এতখানি সার্থক হয়ে উঠতে যে প্রতিভা প্রয়োজন, প্রত্যেকেরই তা ছিল উজাড় করা। আর সমরেশ বসু প্রেমের ও প্রেমিকের দুই বিপরীত চূড়ান্ত অবস্থান রচনা করেছেন অভিভূত করে দেওয়া দক্ষতায়। দুই বিপরীত বিন্দুর এক জন রঞ্জন, যে সুনীতাকে অধিকার করতে চায়, অপর জন সুজিত, যে ভালবাসে, শুদ্ধতম, সরলতম হৃদয়ের প্রেমপ্রগাঢ়তায় ভালবাসে। দুই চরিত্রের দ্বান্দ্বিক অবস্থান লেখক রচনা করছেন এইভাবে, “রঞ্জন যেন চোখ ফেরাতে পারল না সুজিতের ওপর থেকে। সেই ভ্রুকুটি-তীক্ষ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে সুজিতের মনটা যেন সহসা একটা শীতল সর্পদেহের স্পর্শে, ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল। তার শিরদাঁড়ায় একটা কাঁপন অনুভূত হল। সেই ছেলেবেলায়, বর্ধমানের গ্রামে, সে যখন ভয়ার্ত পশুর মতো জীবনযাপন করত, তখন তার এরকম মনে হত প্রায়ই। বহুদিন বাদে, তার সেই অনুভূতি যেন জেগে উঠতে চাইছে।”

রঞ্জন সুজিতকে আবিষ্কার করেছিল সুনীতার চোখ দিয়ে। সুনীতা সুজিতকে নিজের অন্তরে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেও সেই নিষ্কলুষ প্রেমের কাছে আত্মসমর্পণ করতে এসেছিল কিছু ক্ষণের জন্য। কারণ সে জানে, রঞ্জনের হাত থেকে তার মুক্তি নেই। এবং এখানেও, নারীহৃদয়ের সেই হাহাকার ধ্বনিত হয়ে ওঠে, যা ছিল ডালিয়ার মধ্যে। সুনীতা সুজিতকে বলে, “আমি যে তোমার চোখেই প্রথম দেখলাম, এই অভাগিনীকে তুমি ভালবেসেছ, নিজের পাথর হয়ে যাওয়া প্রাণের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তোমার প্রাণের রসে সেখানটাও ভরে উঠেছে। তাই তো বলেছিলাম, আমার নিয়তিই সেদিন রেলের সেই কামরায় আমাকে তুলে দিয়েছিল।”

ডালিয়া ও সুনীতা দু’জনেই সার্থক প্রেমের অনুভূতি পেয়ে নিয়তিকে স্মরণ করছে। সমরেশ বসুর বহু চরিত্র নিয়তির কথা বলে। কিন্তু এর থেকে লেখককে নিয়তিবাদী বলে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ নিয়তির উপর নির্ভরতা সাধারণ বিপন্ন মানুষের প্রবণতা। সেই মানুষের কথা বলতে গেলে লেখককে নিয়তির প্রসঙ্গ আনতে হবে। শ্রমিক, কৃষক, বিপ্লবী, নির্যাতিতা, বারাঙ্গনা, এমন প্রত্যেকেই কথাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই নিশ্চয়তায়, যা ওই চরিত্রের পক্ষে মানানসই। ঠিক এ ভাবেই সুনীতাকে সুজিত বলে, “তোমাকে রঞ্জন ভালবাসে। ওর ভালবাসায় কোনও খাদ নেই কিন্তু।” সুনীতা রঞ্জনের ভালবাসাকে ‘পশুর ভালবাসা’ বলে। এর পর আসে প্রাপ্তির হাহাকার। সুনীতা বলতে থাকে, “কেন তোমাকে দেখতে পেলাম। তোমাকে না-দেখেও এ জীবনটা তো অনায়াসে কেটে যেতে পারত।”

এই উপন্যাসের সমাপ্তি মর্মঘাতী। কিন্তু মনস্তত্ত্বের নিগূঢ় ভয়ঙ্কর জটিলতায় অতি বাস্তব। এখানে রঞ্জন সুনীতাকে হত্যা করে। খুব সহজ ভাবে সে সুজিতের কাছে এই সত্য নিবেদন করে। আরও সহজ ভাবে সুজিত বলে, “ও! মেরে ফেলেছ?” যেন এর মধ্যে বিস্ময় নেই, এই অব্যর্থ সত্য, সুনীতার এই পরিণতিই হওয়ার কথা। রঞ্জন বলে, “হ্যাঁ। আমার প্রেম, আমার ঘৃণা, আমার ঈর্ষা, আমার সুখ, আমার যাতনা, যা বলো, আমার সব কিছুর অস্তিত্বই আমি বিনাশ করেছি। এখন আমি শান্তি বোধ করছি।”

কিন্তু সমরেশ বসু এমন এক জন সাহিত্যিক, যিনি পাঠকের শান্তির জন্য ব্যাকুল নন, বরং তিনি চেয়েছেন সুখ- দুঃখ, প্রেম-ঘৃণা ইত্যাদি বৈপরীত্যময় বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে পাঠককে নিয়ে যেতে। চেয়েছেন জীবনের সত্য প্রতিষ্ঠা করতে। সেখানেই তাঁর জয়, সেখানেই বাংলা সাহিত্যের সম্পদে তাঁর চির-অধিষ্ঠান।

আরও পড়ুন
Advertisement