
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি চালেই বাজিমাত। দিনে ৪২ হাজার কোটি টাকা করে লাভ করছে আমেরিকা! এই অবস্থা চলতে থাকলে অচিরে যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার যে ভরে উঠবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, বিপুল অর্থের বিনিময়ে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’ দেশটিতে স্থায়ী ভাবে বসবাসের আইনি অধিকার ‘বিক্রি’ করছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।

সম্প্রতি ‘গোল্ড কার্ড’ বা ‘গোল্ডেন ভিসা’ প্রকল্প চালু করার কথা ঘোষণা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এর মাধ্যমে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাস এবং ঐচ্ছিক নাগরিকত্ব দেবে আমেরিকা। তবে ‘গোল্ড কার্ড’ পেতে পকেট থেকে দিতে হবে ৫০ লক্ষ ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় টাকার অঙ্কটা ৪২ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকারও বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের দাবি, ট্রাম্প ‘গোল্ড কার্ড’-এর ঘোষণা করতে না করতেই সেটি কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। দিনে হাজারের বেশি ‘সোনালি ভিসা’ বিক্রি হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কার্ডটি অবশ্য এখনও বাজারে আসেনি। এর সফ্টঅয়্যার তৈরির কাজ করছেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের শিল্পপতি তথা ট্রাম্পের কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য ইলন মাস্ক।

দিন কয়েক আগে ‘অল-ইন পডকাস্ট’ নামের একটি অনুষ্ঠানে ‘গোল্ড কার্ড’ নিয়ে মুখ খোলেন মার্কিন বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক। তিনি জানিয়েছেন, প্রতি দিন এতে আবেদনকারীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ‘সোনালি ভিসা’ পেতে অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছেন। আগামী দিনে এর বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশাবাদী তিনি।

পডকাস্ট অনুষ্ঠানে বাণিজ্য সচিব লুটনিক বলেছেন, ‘‘আর দু’সপ্তাহের মধ্যেই গোল্ড কার্ড বাজারে চলে আসবে। এর সফ্টঅয়্যার তৈরির কাজ শেষের পথে।’’ পাশাপাশি, ‘গোল্ড কার্ড’ কেনার লাভ কতটা, ‘গ্রিন কার্ড’-এর সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ট্রাম্প ক্যাবিনেটের এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

লুটনিকের কথায়, ‘‘মার্কিন নাগরিকদের ‘গ্লোবাল ট্যাক্স’ বা বিশ্বব্যাপী কর দিতে হয়। অন্য দেশ থেকে যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই কর দিতে চাইবেন না। ‘গোল্ড কার্ড’ কিনে নিলে আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া যাবে। অথচ কোনও কর দিতে হবে না। অর্থাৎ, কর না দিয়ে এক রকম আমেরিকার নাগরিক হওয়ার সুবিধা রয়েছে এই কার্ডে।’’

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে যে ‘গ্রিন কার্ড’ ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তাকে একরকম আধা নাগরিকত্ব বলা যায়। তবে এই কার্ডটিতে অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমেরিকায় থাকার অনুমতি নেই। ‘গোল্ড কার্ডে’ সেই সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ট্রাম্প সরকার। আর তাই সংশ্লিষ্ট কার্ডটি কেনার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে।

তবে সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ‘গোল্ড কার্ড’ প্রত্যাহার করতে পারে আমেরিকার সরকার। বাণিজ্য সচিব লুটনিক বলেছেন, ‘‘আমরা শুধুমাত্র ভাল মানুষদেরই গোল্ড কার্ড দেব, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের আইন মেনে চলবেন। কিন্তু যদি কেউ অবৈধ কাজকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েন, তা হলে এই কার্ড প্রত্যাহার করা হবে।’’

পডকাস্ট অনুষ্ঠানে বিষয়টি একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন মার্কিন বাণিজ্য সচিব। তিনি বলেছেন, ‘‘আমি যদি বিশ্বের অন্য কোনও দেশে থাকতাম, তা হলে ছ’টি গোল্ড কার্ড কিনতাম। একটি আমার জন্য, একটি স্ত্রীর জন্য এবং বাকিগুলি চার সন্তানের জন্য। আমেরিকায় নতুন করে জীবন শুরু করার অনেক সুযোগ রয়েছে। সেটা ব্যবসা, চাকরি বা অন্য কিছু হতে পারে।’’

এর পর ‘গোল্ড কার্ড’-এর করছাড়ের সুবিধার দিকটি তুলে ধরেন ট্রাম্প ক্যাবিনেটের সদস্য লুটনিক। ‘‘আমেরিকায় যা উপার্জন করছি, তার একটা বড় অংশ কর বাবদ দিতে হলে, ঘরে অনেক কম টাকা নিয়ে ফিরতে হয়। বিদেশ থেকে আসা যে কোনও ব্যক্তি এই করের দিকটি এড়াতে চাইবেন। ‘গোল্ড কার্ড’ কিনে নিলে তাঁকে কর দিতে হবে না। ফলে আয়ের পুরো টাকাটাই বাড়ি নিয়ে যেতে পারবেন তিনি।’’

‘গোল্ড কার্ড’ চালু করার আগে এ ব্যাপারে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। বাণিজ্য সচিব লুটনিক জানিয়েছেন, রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ৩ কোটি ৭০ লক্ষ বাসিন্দার গোল্ড কার্ড কেনার সামর্থ্য রয়েছে। ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ১০ লক্ষ কার্ড বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন’’— পডকাস্ট অনুষ্ঠানে বলেছেন মার্কিন বাণিজ্য সচিব।

‘গোল্ড কার্ড’ বিক্রির মাধ্যমে প্রাপ্ত টাকা কোথায় ব্যবহার হবে, তার ইঙ্গিতও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। লুটনিকের কথায়, ওই অর্থে রাজস্ব ঘাটতি মেটাবে আমেরিকা। পাশাপাশি, জাতীয় ঋণ পরিশোধের পরিকল্পনাও রয়েছে মার্কিন সরকারের।

‘গোল্ড কার্ড’ প্রকল্প ঘোষণার সময়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘‘সীমাহীন ভাবে এটি ইস্যু করা হবে।’’ মাত্র এক দিন হাজার কার্ড বিক্রি হওয়ায় মার্কিন কোষাগারে ঢুকেছে ৫০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৪২ হাজার কোটি টাকা! একে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সূচনা বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন।

২০২২ সালে ‘গোল্ডেন ভিসা’ প্রকল্প চালু করে রাশিয়া। সেখানে বলা হয়, দেড় কোটি টাকা লগ্নি বা দু’কোটির সম্পত্তি কিনলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য থাকার অধিকার দেবে মস্কো। কিন্তু প্রকল্পটি সে ভাবে সাফল্যের মুখ দেখেনি। তিন বছর পেরিয়ে এতে মাত্র ৩০০ থেকে ৪০০ আবেদনপত্র জমা পড়েছে বলে জানা গিয়েছে।

রুশ প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা। প্রথমত, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে মস্কো। তিন বছর পেরিয়ে সেই যুদ্ধ থামার নামগন্ধ নেই। আর তাই স্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য পূর্ব ইউরোপের দেশটিকে বেছে নিতে চাইছেন না দুনিয়ার তথাকথিত ধনীরা।

দ্বিতীয়ত, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার উপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা-সহ পশ্চিম ইউরোপ। ফলে রুশ মুদ্রা রুবলে বিনিময় করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ভয়ে বিশ্বের অধিকাংশ ব্যাঙ্ক মস্কোর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখছে।

আমেরিকার ‘গোল্ড কার্ড’ বা রাশিয়ার ‘সোনালি ভিসা’কে ভারত এবং চিনের মতো দেশগুলির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে উল্লেখ করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের অনুমান, ভবিষ্যতে কোটিপতিদের টানতে এই ধরনের প্রকল্প চালু করার রাস্তায় হাঁটবে পশ্চিম ইউরোপ। তখন ধনকুবেরদের ধরে রাখা দিল্লি বা বেজিঙের পক্ষে বেশ কঠিন হবে।

কিছু দিন আগে ভারতীয় কোটিপতিদের নিয়ে একটি সমীক্ষা চালায় বেসরকারি সংস্থা কোটাক। সেই রিপোর্টে প্রকাশ্যে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এ দেশের প্রতি পাঁচ ধনকুবেরের মধ্যে এক জন বিদেশে চিরস্থায়ী ভাবে বসবাসের জন্য আগ্রহী।
সব ছবি: সংগৃহীত।