
আসন্ন আর্থিক বছরের (পড়ুন ২০২৫-’২৬) প্রথমার্ধে আট লক্ষ কোটি টাকা ঋণ নেবে কেন্দ্র। ২৭ মার্চ তা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। বিষয়টি জানাজানি হতেই নরেন্দ্র মোদী সরকারের আর্থিক নীতির সমালোচনায় করেছেন দেশের তাবড় বিশ্লেষকেরা। এতে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি পাকিস্তানের মতো হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তাঁরা।

চলতি বছরের ২৭ মার্চ বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক। আসন্ন অর্থবর্ষে (২০২৫-’২৬) দেশের বাজার থেকে মোট ১৪.৮২ লক্ষ কোটি টাকা ধার করবে মোদী সরকার। এর ৫৪ শতাংশ আর্থিক বছরের প্রথমার্ধে সংগ্রহ করবে কেন্দ্র।

ঘরোয়া বাজার থেকে কী ভাবে এই ঋণের অর্থ সংগ্রহ করা হবে, তার রূপরেখা প্রকাশ করেছে মোদী সরকার। সেখানে বলা হয়েছে, ধার নেওয়া টাকার বড় অংশ আসবে সোভারেন গ্রিন বন্ডের মাধ্যমে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি বা পরিবেশ বান্ধব প্রকল্পের নামে এর থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক।

সরকার জানিয়েছে, সোভারেন গ্রিন বন্ড ২৬টি সাপ্তাহিক নিলামের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। এর নিরাপত্তার গ্যারান্টি থাকছে সরকারের হাতে। বন্ডগুলির মেয়াদপূর্তির সময়সীমা কেন্দ্র তিন থেকে ৫০ বছর রাখবে বলে জানা গিয়েছে।

গোটা বিষয়টি নিয়ে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্র বলেছে ৩,৫,৭,১০,১৫,৩০,৪০ এবং ৫০ বছরের নিরাপত্তা চুক্তির ভিত্তিতে সোভারেন গ্রিন বন্ডের বিনিময়ে বাজার থেকে টাকা তোলা হবে। তিন বছরের ক্ষেত্রে ৫.৩ শতাংশ, পাঁচ বছরের ১১.৩ শতাংশ, সাত বছরে ৮.২ শতাংশ, ১০ বছরে ২৬.২ শতাংশ, ১৫ বছরে ১৪ শতাংশ, ৩০ বছরে ১০.৫ শতাংশ, ৪০ বছরে ১৪ শতাংশ এবং ৫০ বছরে ১০.৫ শতাংশ হারে সুদ দেবে সরকার।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধের ব্যাপারটি দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করার জন্য রিডেম্পশান প্রোফাইল মসৃণ করতে বন্ড বা সিকিউরিটিজ়গুলি ফের কিনে নেবে বা পরিবর্তন করবে। আবার চাহিদা বেশি হলে বন্ড বা সিকিউরিটিজ় প্রতি অতিরিক্ত দু’হাজার টাকা ধরে রাখার অধিকারও থাকছে কেন্দ্রের হাতে।

এ ছাড়া ২০২৫-’২৫ আর্থিক বছরের প্রথম প্রান্তিকে সাপ্তাহিক ভাবে ১৯ হাজার কোটি টাকার ট্রেজ়ারি বিল জারি করবে মোদী সরকার। এর আবার তিনটি রকমভেদ থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রক।

মোদী সরকারের জারি করা ট্রেজ়ারি বিলের একটির মেয়াদ ৯১ দিন হবে বলে জানা গিয়েছে। এর মাধ্যমে বাজার থেকে ন’হাজার কোটি টাকা তুলবে সরকার। বাকি দু’টি হল, ১৮২ দিনের পাঁচ হাজার কোটি টাকার ট্রেজ়ারি বিল এবং ৩৬৪ দিনের পাঁচ হাজার কোটি টাকার ট্রেজ়ারি বিল।

অন্য দিকে সরকারি হিসাবের অস্থায়ী অসঙ্গতি দূর করতে এগিয়ে এসেছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (আরবিআই)। ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরের প্রথমার্ধের জন্য ওয়েস অ্যান্ড মিনস অ্যাডভান্সেসের (ডব্লুএমএ) সীমা দেড় লক্ষ কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।

গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে বাজেট পেশ করার সময়ে রাজস্ব ঘাটতি পূরণের কথা বলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ। এর জন্য তারিখ যুক্ত সিকিউরিটিজ়ের প্রস্তাব করেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রাক্তনী। ফলে মোদী সরকার যে এ ভাবে ঘরোয়া বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে, তা তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আসন্ন আর্থিক বছরে (পড়ুন ২০২৫-’২৫) রাজস্ব ঘাটতির সম্ভাব্য পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) ৪.৪ শতাংশ থাকবে বলে ধার্য করেছে সরকার। বর্তমান অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) এটি ৪.৮ শতাংশে গিয়ে থামার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ আসন্ন অর্থবর্ষে রাজস্ব ঘাটতি কমবে বলে দাবি করেছে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক।

সরকারের দেওয়া নিখুঁত পরিসংখ্যানে ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে রাজস্ব ঘাটতির অঙ্ক ১৫ লক্ষ ৬৮ হাজার ৯৩৬ কোটি ধরা হয়েছে। এই ঘাটতি মেটাতে পুরনো সিকিউরিটিজ়ের মাধ্যমে বাজার থেকে ১১.৫৪ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ সংগ্রহ করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদী কেন্দ্র। অর্থ মন্ত্রক জানিয়েছে, বাকি টাকা স্বল্প সঞ্চয় এবং অন্যান্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হবে।

ফেব্রুয়ারিতে সংসদে দেওয়া বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ বলেন, ‘‘২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরের ক্ষেত্রে ঋণ বাদ দিয়ে সরকারের মোট আয়ের পরিমাণ ৩৪.৯৬ লক্ষ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে বলে অনুমান করা হয়েছে। অন্য দিকে মোট খরচ হবে ৫০.৬৫ লক্ষ কোটি টাকা।’’

বাজেট বক্তৃতায় ১৫.৬৯ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতির উল্লেখ করেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির প্রাক্তনী নির্মলা। তবে, ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে কর বাবদ সরকারি কোষাগারে ২৮.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা আসবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, আগামী এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজার থেকে ঋণ বাবদ আট লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করবে কেন্দ্র। ইতিমধ্যেই এই সময়সীমার ঋণ-ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে মোদী সরকার। এর মাধ্যমে কোন কোন তারিখে অর্থ মন্ত্রক বন্ড ইস্যু করতে চলেছে, তা জানতে পারবে আমজনতা।

মোদী সরকারের দাবি, রাজস্ব ঘাটতি মেটাতে ঘরোয়া বাজার থেকে জিডিপির মাত্র ৪.৪ শতাংশ ঋণ বাবদ সংগ্রহ করবে অর্থ মন্ত্রক। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে মিথ্যা তথ্য দিচ্ছে সরকার। আসলে ফেব্রুয়ারিতে পেশ করা বাজেটে খরচ বাবদ যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তার ৩০ শতাংশই ধার করতে চলেছে কেন্দ্র।

দ্বিতীয়ত, ২০০৩ সালে ‘আর্থিক দায়িত্ব ও বাজেট ব্যবস্থাপনা’ (ফিসক্যাল রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট বা এফআরবিএম অ্যাক্ট) নামের একটি আইন পাশ করেছে কেন্দ্র। সেখানে সরকার কখনই জিডিপির তিন শতাংশের বেশি ঋণ নিতে পারবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। সেই আইনের তোয়াক্কা না করেই অর্থ মন্ত্রক ধার করতে চলেছে বলে সুর চড়িয়েছে বিরোধীরা।

তবে এই সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে কেন্দ্র। সরকারের তরফে এর একটি সহজ হিসাব দেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রকের দাবি, এক টাকা রোজগার হলে তার মাত্র ২৪ শতাংশ ঋণ করা হবে। কিন্তু সমস্যার বিষয় হল, ২৪ শতাংশের ২০ শতাংশ টাকা ঋণের সুদ বাবদ খরচ করবে মোদী সরকার, বলছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।

বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার ঘোষণায় সুদের হার জানিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। আর্থিক বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর ফলে আমজনতার ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান কখনই বেসরকারি সংস্থা বা সাধারণ নাগরিকদের সরকারের ঠিক করে দেওয়া বেঞ্চমার্কের নীচে ঋণ দিতে চাইবে না। এক কথায় এতে বাড়তে পারে গাড়ি-বাড়ি বা শিক্ষা ঋণের মাসিক কিস্তির অঙ্ক।

কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তে মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর ঋণ তহবিলে লগ্নিতে মোটা লাভের সুযোগ বাড়ল বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা। ফলে আগামীদিনে মিউচুয়াল ফান্ডের ঋণ তহবিলে বিনিয়োগের মাত্রা বৃদ্ধি সম্ভাবনার আশ্বাস দিয়েছে তারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।