আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন একটি প্রতিরক্ষা চুক্তির পথে হাঁটল ভারত। আকাশে শত্রুপক্ষের যুদ্ধবিমান, ড্রোন এবং স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের হানা ঠেকাতে নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে ‘মউ’ স্বাক্ষরিত হয়েছে দুই দেশের মধ্যে।
ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড ও রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অস্ত্র রফতানিকারক সংস্থা ‘রোজ়োবোরাএক্স’-এর মধ্যে ‘পন্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ কেনার জন্য এই চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
‘মউ’ অনুযায়ী এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতেই তৈরি করা হবে। ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে ভারতের অস্ত্রাগারে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে চলেছে রুশ প্রযুক্তিতে নির্মিত এই অস্ত্রটি।
পন্টসার একটি বহুমুখী এবং উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা বিমান ও ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে বহুস্তরীয় সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এতে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন ও বিমানবিধ্বংসী কামান— এই তিন ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে যা উন্নত রাডার এবং ট্র্যাকিং সিস্টেমের সঙ্গে সংযুক্ত। ৩৬ কিমি দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে শনাক্ত করতে এবং সেগুলিকে ধ্বংস করার ক্ষমতা রয়েছে পন্টসারের।
পন্টসার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একটি ট্রাকের উপর রাডার, ১২টি ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং দু’টি বিমান বিধ্বংসী কামান থাকে। ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সাধারণ ভাবে ১৮ কিলোমিটার পাল্লার। কিন্তু নতুন ‘১-এস’ সংস্করণে ‘বুস্টার’ ব্যবহার করে সেগুলির পাল্লা বাড়ানো হয়েছে ‘পন্টসার এস-১’ সংস্করণে।
ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার একটি ইউনিটে ৩০ মিমি স্বয়ংক্রিয় কামান যুক্ত করা আছে। এই অটোক্যানন প্রতি মিনিটে ৭০০ রাউন্ড গুলি ছুড়তে সক্ষম। ৪ কিলোমিটার পাল্লার মধ্যে থাকা উড়ন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। মাঝারি পাল্লার ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাটি ড্রোন, হেলিকপ্টার এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করতে সক্ষম।
শত্রুপক্ষের অস্ত্র চিহ্নিত করতে এতে রেডিয়ো নির্দেশিকা ব্যবহার করা হয়। এর সর্বোচ্চ গতি প্রতি সেকেন্ডে ১৩০০ মিটার। যার ফলে দ্রুত গতিশীল লক্ষ্যবস্তুগুলিকে প্রতিহত করতে সক্ষম এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে পন্টসারবাহী ট্রাক চলন্ত অবস্থাতেই এই কাজ করতে পারে।
খোদ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের প্রাসাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিয়োজিত রয়েছে পন্টসার এয়ার ডিফেন্স ব্যবস্থা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রুশ প্রেসিডেন্টকে বিশেষ সুরক্ষা দিতে সোচির প্রাসাদে মোতায়েন করা হয়েছে এটিকে। ইউক্রেনীয় ড্রোন হানা আটকাতে এই ব্যবস্থা বলে জানা গিয়েছে।
আলজিরিয়া, ইরান, ইরাক, রাশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহি-সহ বিশ্বের অনেক দেশ পন্টসার বেছে নিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই মস্কোকে ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা করতে রাশিয়া বেশ কয়েকটি জায়গায় এই ব্যবস্থা মোতায়েন করেছিল।
সামরিক ঘাঁটি, বিমানবন্দর এবং শিল্প ক্ষেত্রগুলির সুরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাটির খরচ অন্যগুলির তুলনায় কম। এক ইউনিট পন্টসার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খরচ ১২৬ কোটি টাকার কাছাকাছি।
এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নকশা অভিনব ও বহুমুখী। যে সব দেশ স্বল্প পরিসরে আধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার খোঁজ করে, তাদের কাছে পন্টসার একটি আকর্ষণীয় বিষয়।
প্রায় এক দশক আগে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনার জন্য নয়াদিল্লি-মস্কো সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল। ২০১৪-য় এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে মস্কোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নয়াদিল্লি।
ভারতের রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবহার নিয়ে বরাবরই নারাজ ছিল আমেরিকা। বিশ্ববাজারে রুশ অস্ত্রের জোগান আটকাতে বিশেষ আইনও আনে আমেরিকা। যে সমস্ত দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কিনবে, তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে ‘ব্রাত্য’ করার কথা বলেছিল এই আইন।
ভারত অবশ্য বরাবরই আমেরিকার হুঁশিয়ারি অগ্রাহ্য করে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা কিনতে নিজের অবস্থানে অনড় ছিল। এই সময়েই রাশিয়া থেকে এস-৪০০ কেনার সিদ্ধান্ত নেয় ভারত। ২০১৮ সালের অক্টোবরে পুতিনের দিল্লি সফরের সময় এ বিষয়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার চুক্তি সই হয়েছিল।
২০১৯ সালের গোড়ায় আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া থেকে ভারতের অস্ত্র কেনার চুক্তি বাতিল করার জন্য আমেরিকার অস্ত্র সরবরাহের টোপ দেন। তবে সে টোপ অগ্রাহ্য করে মস্কোর সঙ্গে চুক্তিতেই অটল ছিল নয়াদিল্লি।
ইতিমধ্যেই সব বাধা কাটিয়ে এস-৪০০-র প্রথম দু’টি ইউনিট হাতে পেয়েছে ভারতীয় সেনা। ঘটনাচক্রে, চার বছর পরে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হওয়ার পরেই আবার নতুন করে নয়াদিল্লি-মস্কো প্রতিরক্ষা চুক্তি হল।
সব ছবি: সংগৃহীত।