ধর্মের নামে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করা নতুন নয়। যুগ যুগ ধরে তা চলে আসছে। কখনও এর সুযোগ নিয়ে অর্থলাভ করা হয়েছে, কখনও বা ধর্মের নাম নিয়ে চলেছে নৃশংস অপরাধ। কানাডাতে ধর্মের নামে রোশ থেরল্ট ‘অ্যান্ট হিল কিড্স’ নামের এক বিশেষ গোষ্ঠী তৈরি করেছিলেন, যা মানুষের মনে এখনও ভয় ধরিয়ে দেয়।
১৯৪৭ সালের মে মাসে ফরাসি-কানাডীয় পরিবারে জন্ম রোশের। কুইবেকে তাঁর জন্ম হলেও রোশের বেড়ে ওঠা থেটফোর্ড মাইন্স শহরে। ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভাল ছিলেন তিনি। ছাত্র হিসাবে ফলাফল ভাল করা সত্ত্বেও ১৯৬০ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি স্কুল ছেড়ে দেন।
বাইবেলের প্রতি তাঁর আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে। ধর্মগ্রন্থ পড়ে তাঁর বোধ হয়, পৃথিবী খুব শীঘ্রই ধ্বংস হবে। ধর্মের প্রতি বিশ্বাসও বদলাতে থাকে। ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও পরে তিনি ‘সেভেন্থ-ডে অ্যাডভেন্টিস্ট’ চার্চে যোগ দেন।
এই চার্চের নিয়মানুযায়ী তিনি ‘পবিত্র’ জীবনযাপন করতেন। ফলাহার করে, শাকসব্জি খেয়ে দিন কাটাতেন রোশ। সুরাপান এবং তামাক সেবন করা নিয়মবিরুদ্ধ ছিল। ওই ধরনের জীবন কাটানোর ফলে তিনি ধীরে ধীরে লোকজনদের প্রভাবিত করতে শুরু করেন।
ধর্ম এবং দর্শন প্রসঙ্গে রোশ এমন বক্তব্য পেশ করতেন, যা শোনার পর সকলে তাঁর সান্নিধ্যে থাকতে চাইতেন। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি তাঁর অনুরাগীদের নির্দেশ দেন, চাকরি ছেড়ে তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করতে। কিন্তু শর্ত রেখেছিলেন, চার্চ এমনকি, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কেউ যোগাযোগ রাখতে পারবেন না। তবুও সেই শর্তে রাজি হয়ে অনেকে তাঁর সঙ্গে যোগ দেন।
১৯৭৭ সালে সেন্ট মেরি এলাকায় রোশ আনুষ্ঠানিক ভাবে নিজস্ব গোষ্ঠী গঠন করেন। যার প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল, ওই গোষ্ঠীতে যাঁরা যুক্ত হবেন, তাঁরা ‘পাপমুক্ত’ জীবন কাটাতে পারবেন। সকলেই সমানাধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন।
গোষ্ঠীর সকলে রোশের অন্ধভক্ত ছিলেন। ‘গুরু’ হিসাবে দেখতেন রোশকে। এক সময় রোশ তাঁর অনুগামীদের জানান, ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পৃথিবী ধ্বংস হতে চলেছে বলে সতর্কবার্তা দিয়ে নাকি ভগবান তাঁকে আগে থেকে সাবধান করেছেন।
রোশ দাবি করেন, পৃথিবীতে এমন একটি জায়গা রয়েছে, যেখানে গিয়ে বসবাস করলে ওই বিপদের হাত থেকে তাঁর গোষ্ঠীর লোকেরা রক্ষা পাবেন। রোশের কথা মেনে সকলে তাঁর সঙ্গে সেন্ট জগুয়েসের পার্বত্য এলাকায় চলে যান।
রোশ গোষ্ঠীর সকলকে নির্দেশ দেন সেই এলাকাতেই তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত করার। অনুগামীরা গুরুর নির্দেশ পালন করেই সেখানে একটি ছোট শহর গড়ে তোলেন। পিঁপড়ের সঙ্গে তুলনা করে রোশ তাঁর গোষ্ঠীর নামকরণ করেছিলেন ‘অ্যান্ট হিল কিড্স’।
কিন্তু রোশের কথা মতো কোনও রকম বিপদ না আসায় তাঁর উপর থেকে বিশ্বাস চলে যায় ‘অ্যান্ট হিল কিড্স’ গোষ্ঠীর সদস্যদের। রোশ ভয় পেয়ে যান। একা হয়ে পড়ার ভয়ে তিনি সকলকে ভুল বোঝাতে শুরু করেন। রোশ জানান, ভগবান যেখানে বাস করেন, তার সঙ্গে পৃথিবীর সময়ের চাকার কোনও মিল নেই। তাই সময় গণনার ক্ষেত্রে কোনও ভুল হয়ে থাকতে পারে।
এই ঘটনার পর রোশের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসে। যিনি মদ, তামাক ছুঁয়েও দেখতেন না, তিনি ধীরে ধীরে পানীয়ে আসক্ত হয়ে পড়েন। তার পর শুরু হয় সকলের উপর শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার। আরও কড়া নিয়মকানুম মেনে চলতে বাধ্য করা হতে থাকে গোষ্ঠীর সদস্যদের।
কেমন ছিল সে সব নিয়ম? যেমন, রোশের অনুমতি ছাড়া দলের প্রাপ্তবয়স্কেরা যৌনমিলন করতে পারবেন না। গুরুর উপস্থিতিতে কেউ অন্য কারও সঙ্গে কথাও বলতে পারবেন না। রোশ নির্দেশ দিয়েছিলেন, ওই গোষ্ঠীর সকলে শুকনো খাবার বিক্রি করে উপার্জন করবেন। কিন্তু কেউ কম উপার্জন করলে তাঁকে কঠোর শাস্তিও দিতেন রোশ।
দলের সদস্যরা এখনও তাঁকে মেনে চলেন কি না, তা পরীক্ষা করতে রোশ শাস্তি দিতেন। এক সদস্যকে আদেশ দিতেন, তিনি যেন অন্য সদস্যের পায়ের আঙুল কেটে ফেলেন। রোশের প্রতি নিজের আনুগত্য প্রমাণ করতে অনেকে জ্বলন্ত স্টোভের উপর বসে পড়তেন। হাতুড়ি দিয়ে মেরে নিজেদের পা ভেঙে ফেলতেন।
কখনও কখনও গুরু রোশের নির্দেশে একে অপরের মলও খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করতেন। কাঁচা ইঁদুরও খেতে হত মাঝেমধ্যে। রোশের নির্দেশ অমান্য করলে তিনি বেল্ট বা হাতুড়ি দিয়ে মারধর করতেন, মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতেন। সদস্যদের গায়ের উপর মলত্যাগও করতেন।
দলে যত জন মহিলা সদস্য ছিলেন, তাঁদের সকলের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক ছিল রোশের। সেই মহিলাদের বিয়েও করতেন তিনি। জানা যায়, ন’জন মহিলাকে বিয়ে করার পর ২০টি সন্তানকে পিতৃপরিচয় দিয়েছিলেন রোশ।
পরে তিনি মহিলাদের শাস্তি দিতে যৌন নির্যাতন করাও শুরু করেন। নির্যাতন করে তাঁদের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখতেন তিনি। পরে দলের বাকি সদস্যদের তাঁর দিকে পাথর ছুড়ে মারার নির্দেশ দিতেন। শাস্তির হাত থেকে বাদ পড়ত না তাঁর সন্তানেরাও। এক সন্তানকে শাস্তি দিতে তাকে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছিলেন রোশ। ঠান্ডায় জমে গিয়ে শেষ পর্যন্ত রোশের সেই সন্তান মারা যায়।
গোষ্ঠীর সদস্যরা রোশের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে যেতেন। বাইরের লোকেদের তাঁদের কঠিন জীবনের অভিজ্ঞতাও জানাতেন পলাতকরা। কিন্তু শেষে আবার রোশের হাতেই ধরা পড়তে হত তাঁদের। ধরা পড়ার পর ধৃতদের উপর শারীরিক অত্যাচার করতেন তিনি।
রোশ বিশ্বাস করতেন, সমস্ত রকম রোগ সারিয়ে দেওয়ার দৈব ক্ষমতা রয়েছে তাঁর। তাই তিনি মাঝেমধ্যেই দলের সদস্যদের উপর অস্ত্রোপচার করতেন। পেট কেটে তার ভিতরে সিরিঞ্জের মাধ্যমে ইথানলের মিশ্রণ ঢেলে দিতেন। দলে উপস্থিত পুরুষদের যৌনাঙ্গের উপরিভাগের চামড়াও কেটে ফেলতেন তিনি।
১৯৮৯ সালে সোলাঞ্জে বয়লার্ড নামের এক মহিলা পেটব্যথার কারণে রোশের শরণাপন্ন হন। রোশ সেই মহিলার পেটে জোরে জোরে ঘুষি মারতে থাকেন। তার পর সোলাঞ্জেকে ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে নগ্ন অবস্থায় টেবিলে শুইয়ে দেন। অজ্ঞান না করেই ছুরি দিয়ে সেই মহিলার পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বার করে আনেন রোশ।
সোলাঞ্জের মলদ্বারে টিউব ঢুকিয়ে তার মধ্য দিয়ে অলিভ অয়েল ঢালতে শুরু করেন তিনি। রোশের সঙ্গে বাধ্য হয়ে যোগ দেন দলের সদস্যরাও। গ্যাব্রিয়েল ল্যাভেলে নামের এক মহিলা সদস্যকে রোশ নির্দেশ দেন, তিনি যেন আবার ছুঁচ-সুতো দিয়ে সোলাঞ্জের পেট সেলাই করে দেন। সোলাঞ্জ পরের দিন মারা যান।
সোলাঞ্জের মৃতদেহে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনবেন বলে দলের পুরুষদের নিয়ে একত্রিত হন রোশ। প্রথমে সোলাঞ্জের মৃতদেহের খুলিতে গর্ত করেন তিনি। তার পরে তিনি নিজে সেই গর্তের ভিতর স্বমেহন করেন। বাকি পুরুষদেরও একই নির্দেশ দেন। প্রাণ না ফিরলে সোলাঞ্জের মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলেন তিনি।
এই ঘটনা সহ্য করতে না পেরে গ্যাব্রিয়েল পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রোশের হাতে ধরা পড়ে যান। গ্যাব্রিয়েলের যৌনাঙ্গ আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন রোশ, আটটি দাঁত ভেঙে উপড়ে ফেলেন, স্তনের কিছু অংশ কেটে ফেলেন। তাতেও থেমে থাকেননি রোশ। এক একটি আঙুল কাটার পর পুরো হাতটাই কেটে ফেলেন গ্যাব্রিয়েলের।
পরে গ্যাব্রিয়েল আবার পালানোর চেষ্টা করেন। এ বার তিনি সফল হন। রোশের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেন তিনি। ১২ বছর কারাদণ্ডের শাস্তি পান রোশ। ১৯৯৩ সালে সোলাঞ্জের হত্যার ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর রোশের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।
কানাডার ডরচেস্টার সংশোধনাগারে বন্দি ছিলেন তিনি। প্যারোলের আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে কয়েক ঘণ্টার জন্য দলের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ছাড়া হত। সেই সময় একাধিক মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন তিনি। রোশ সংশোধনাগারে থাকার সময় সেই মহিলারা অন্তঃসত্ত্বা হন বলেও জানা যায়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংশোধনাগার থেকে রোশের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর। সংশোধনাগারের ভিতর হাতে তৈরি কোনও অস্ত্র দিয়ে গলা কুপিয়ে খুন করা হয় রোশকে।
কে আসল খুনি, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই দোষ স্বীকার করে নেন এক আসামি। ৬০ বছর বয়সি ম্যাথিউ জেরার্ড ম্যাকডোনাল্ড নামের এক অপরাধী খুন করেন রোশকে। যে ছুরি দিয়ে তিনি রোশকে খুন করেন, তা-ও পুলিশকে দেন তিনি।
ওই মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে ২০০২ সালে কানাডায় একটি ছবি বানানো হয়। শুধু তা-ই নয়, গ্যাব্রিয়েল তাঁর জীবনের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার উপর বইও লিখেছেন।