টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছে ভারতকে। হার্দিক এবং কোহলির ভাল ব্যাটিংও শেষ পর্যন্ত হারের হাত থেকে ভারতকে বাঁচাতে পারেনি। প্রথম ব্যাট করতে নেমে ৬ উইকেট হারিয়ে ১৬৮ রান করেছিলেন বিরাট-রোহিতরা। কিন্তু ইংল্যান্ডের জস বাটলার এবং অ্যালেক্স হেলসের ব্যাটিং-ঝড়ে খড়কুটোর মতো উড়ে যায় ভারত।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথম থেকেই ভারতীয় দলের খেলা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়। একাধিক ম্যাচে কেবল মাত্র ব্যাটিংয়ের জোরে ম্যাচ বার করে আনে ভারত। পাকিস্তান, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনও মতে জেতে ভারত। সেমিফাইনালে বিপর্যয় রুখতে পারলেন না বিরাটরা। ইংল্যান্ডের কাছে রীতিমতো ধরাশায়ী হয়েছেন তাঁরা।
কী ছিল না ভারতীয় দলের কাছে? ভাল স্ট্রাইক রেট থাকা ব্যাটার থেকে শুরু করে উন্নত মানের বোলার। তবু সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে রুখতে ব্যর্থ হয়েছে ভারত। ভারতের প্রথম দিকের জয়ে উল্লাস ছিল অনেক বেশি। দলের খেলা নিয়ে দেশবাসীর গর্ব আরও বেশি। অন্য দিকে ইংল্যান্ড কিন্তু এগিয়েছে অনেক সন্তর্পণে। ধীরে ধীরে। এই দলকে নিয়ে প্রচারও ছিল কম।
২০১৫ সালে এক দিনের ক্রিকেটের বিশ্বকাপ থেকে অনেক আগেই ছিটকে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। তার পর থেকে আরও বেশি সচেতন হয়ে যায় তারা। ২০১৬-র টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছেছিল ইংল্যান্ড। এর পর ২০১৯-এর বিশ্বকাপ জয়।
২০১৯ সালের ফাইনাল টাই হয়ে যায়। ইংল্যান্ড এবং নিউজিল্যান্ড দু’দলই করেছিল ২৪১ রান। খেলা গড়ায় সুপার ওভারে। সেখানেও দুই দল একই রান করে। আইসিসি-র নিয়ম অনুযায়ী, বাড়তি একটি ছয় মারার ফলে জিতে যায় ইংল্যান্ড। তাদের জেতা নৈতিক না অনৈতিক, তা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক থাকলেও তাঁদের ফাইনালে ওঠা নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। নিজেদের দমে ২০১৯-এর ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিল ইংল্যান্ড।
তার পর থেকে আইসিসি-র যে কোনও টুর্নামেন্ট ইংল্যান্ডের পারফরম্যান্স ছিল অসামান্য। ২০২১-এর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল ইংল্যান্ড। মোট কথা ২০১৫-এর বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যাওয়ার পর থেকেই চেনা ছক ভেঙে এগিয়েছেন বাটলাররা। খোলনলচে পাল্টে একেবারে নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে ইংল্যান্ড। আর তা দেখে ভারতেরও কি অনেক কিছু শিক্ষণীয় ছিল না!
সাদা বলের খেলায় ইংল্যান্ড যে ভাবে নিজেদের মধ্যে বদল এনেছে তা থেকে কী কী শিক্ষণীয় ভারতের?
বিগত কয়েক বছরে সাদা বলের খেলার পদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছে ইংল্যান্ড। সীমিত ওভারের খেলাগুলিতে প্রথম থেকেই রণমূর্তি ধারণ করছেন বাটলাররা। খেলা শুরুর প্রথম থেকেই ইংল্যান্ড যেন আরও বেশি আক্রমণাত্মক।
অধিনায়ক হিসাবে অইন মর্গানের ভূমিকাও এই ক্ষেত্রে কম নয়। ইংল্যান্ডের খেলায় যে সাহসিকতা দেখা যাচ্ছে তার দিকনির্দেশক মর্গানই।
একাধিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ইংল্যান্ড দলের সিনিয়র তারকা খেলোয়াড়দের বাদ দেওয়ার আগে এক বারের জন্যও ভাবেননি মর্গান। ২০০৭ সালে দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর মহেন্দ্র সিংহ ধোনি যেমন সে সময়ের তারকা খেলোয়াড়দের বসিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন, মর্গানও এগিয়েছেন একই ধাঁচে।
সাম্প্রতিক সময়ে ইংল্যান্ড দলের খেলা দেখে মনে হচ্ছে, ‘করব নয় মরব’ নীতিতে ভর করে মাঠে নামছেন ক্রিকেটাররা। ইংল্যান্ডের ব্যাট, বলের আক্রমণ যেন আরও ধারালো হয়েছে। কোনও দলকেই হালকা ভাবে নেওয়ার ভুল করছে না ইংল্যান্ড।
সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দেরও বিশ্রামে পাঠাতে দেখা গিয়েছে ইংল্যান্ড দলকে। এই কারণেই ২০২১ সালে ভারতের মাটিতে হওয়া ইংল্যান্ড-ভারত টেস্ট সিরিজের মাঝখানেই ইংল্যান্ডে ফিরে যেতে দেখা গিয়েছিল বাটলার, মইন আলির মতো খেলোয়া়ড়দের। ইংল্যান্ড জানত এই সিদ্ধান্ত ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। হয়েও ছিল তাই। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছয় ভারত।
ইংরেজদের যুক্তি ছিল, ক্রিকেটারদের মানসিক সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাতে খেলোয়াড়রা সতেজ থাকেন তা সব সময়ই মাথায় রাখা উচিত। এমনকি এই বিশ্বকাপের ঠিক আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টি সিরিজের সময় বেন স্টোকস এবং বাটলারদের মতো দুঁদে খেলোয়াড়রা একটি ম্যাচও খেলেননি।
ইংল্যান্ড দলে স্পিনারদের গুরুত্ব আগের থেকে অনেকখানি বেড়েছে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে স্পিনারদের ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বেশ মুনশিয়ানারই পরিচয় দিয়েছেন মর্গানরা। আর সেই কারণেই আদিল রশিদ এবং লিয়াম লিভিংস্টোনদের মতো স্পিনারের দক্ষতা আরও বেড়েছে। যার ফলও হাতানাতে পাচ্ছে ইংল্যান্ড।
অন্য দিকে অধিনায়ক হিসাবে ধোনির অবসরের পর থেকে স্পিনারদের ব্যবহার করা নিয়ে যেন একটু সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন ধোনি-পরবর্তী অধিনায়করা। ধোনি-পরবর্তী সময়ে আঙুল দিয়ে বল ঘোরাতে পারেন এমন স্পিনারও খুব একটা বেশি তৈরি হয়নি। একই সঙ্গে এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ম্যাচে চহালের মতো স্পিনারকে না খেলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েও ভারত বোকামো করেছে বলেই অনেকের মত।
বিভিন্ন দেশে হওয়া টি-টোয়েন্টি লিগগুলিতে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের চাহিদা বেড়েছে। কিন্তু টাকার অঙ্ক অনেক বেশি হলেও অনেক লিগেই না খেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ইংল্যান্ড দলের খেলোয়াড়রা। স্টোকসের মতো খেলোয়াড়কে শুধু মাত্র নিজেকে মানসিক ভাবে সতেজ রাখার কারণ দেখিয়ে আইপিএল থেকে বেরিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে।
এই সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ যখন ভারতও চাইলে ইংল্যান্ডের থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের খেলার পদ্ধতিতে বদল এনে আরও সফল হতে পারে।