শুধু মাত্র বিয়ে করতে বা প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে চাপ দেওয়ার জন্যই কি শ্রদ্ধাকে খুন করেন আফতাব? না প্রেমিকাকে খুনের নেপথ্যে অন্য কোনও কারণ ছিল? তদন্তে নেমে এই প্রশ্নেরই উত্তর খুঁজছিল পুলিশ। সূত্রের খবর, সম্প্রতি পুলিশের হাতে এমন তথ্য এসেছে যাতে মনে করা হচ্ছে শ্রদ্ধাকে খুনের নেপথ্যে থাকতে পারে অন্য এক মহিলার সঙ্গে আফতাবের ঘনিষ্ঠতা। আর সেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে বাধা দেওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে শ্রদ্ধা ওয়ালকরকে।
পুলিশ সূত্রের খবর, সংসার খরচ কে চালাবেন তা নিয়েও খুনের দিন রাতে ঝামেলা শুরু হয়েছিল শ্রদ্ধা এবং আফতাবের মধ্যে। আর তার জেরেও এই খুন করা হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিযুক্ত আফতাবকে জিজ্ঞাসাবাদে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তদন্তকারী পুলিশের হাতে। সূত্রের খবর, গৃহস্থালির সামগ্রী কেনা নিয়ে তাঁদের ঝগড়া শুরু হয়। সংসার কী করে চলবে এবং সংসারের খরচ কে টানবেন, সে প্রসঙ্গও উঠে আসে ঝামেলার মধ্যে।
পুলিশ সূত্রে খবর, আফতাব তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করছেন এবং ফোনে অন্য এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছেন বলে সন্দেহ করছিলেন শ্রদ্ধা। আর তা নিয়ে দু’জনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হত।
সূত্রের দাবি, তাঁর প্রতি আফতাবের অনুভূতি হঠাৎ পরিবর্তিত হওয়ায় শ্রদ্ধা মনে মনে বিরক্ত ছিলেন। আর এই নিয়ে তিনি মাঝেমধ্যেই প্রেমিককে দু’-এক কথা শোনাতেন। শ্রদ্ধার প্রতিও ধীরে ধীরে বিতৃষ্ণা জন্মেছিল আফতাবের।
গত ১৮ মে এ রকমই এক কারণে যুগলের মধ্যে ঝগড়া চলছিল। এই সময়ই শ্রদ্ধার বুকের উপর চেপে বসে তাঁর গলা টিপে ধরেন আফতাব। শ্বাসরোধ করে খুন করেন একত্রবাসে থাকা দীর্ঘ দিনের প্রেমিকাকে।
যদিও পুলিশ জানিয়েছে, খুনের অন্তত ১০ দিন আগে অর্থাৎ, ৮ মে শ্রদ্ধাকে খুন করতে চেয়েছিলেন আফতাব। কিন্তু শ্রদ্ধাকে কাঁদতে দেখে আফতাব একটু নরম হয়ে পড়েন এবং পরিকল্পনায় বদল আনেন।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জট ছাড়াতে পুলিশকেও যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। এখনও পুলিশের হাতে আসেনি অনেক প্রমাণ। কিন্তু কোন পথে এগোচ্ছে শ্রদ্ধা খুনের তদন্ত প্রক্রিয়া?
পুলিশ জানিয়েছে, মুম্বইতে একটি ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল শ্রদ্ধা এবং আফতাবের। তাঁরা তিন বছর ধরে একত্রবাস করছিলেন এবং দিল্লিতে চলে গিয়েছিলেন।
আফতাবের সঙ্গে সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় বাবা-মার সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করেন শ্রদ্ধা। দিল্লিতে চলে আসার পর থেকেই, আফতাবকে বিয়ের কথা বলতে থাকেন তিনি। আর এই বিয়ের কথা থেকেই দু’জনের মধ্যে তিক্ততার সূত্রপাত।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ মে দিল্লির মেহরৌলিতে শ্রদ্ধাকে খুন করেন প্রেমিক আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। এর পর আমেরিকার এক ওয়েব সিরিজ় থেকে ‘অনুপ্রেরণা’ নিয়ে শ্রদ্ধার মৃতদেহ ৩৫ টুকরো করে ফেলেন আফতাব। খুনের পর রক্ত পরিষ্কার করার উপায় বার করেন গুগল সার্চ করে।
সেই মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখতে পাশের দোকান থেকে কিনে আনা হয় নতুন ফ্রিজ। শ্রদ্ধার দেহের টুকরোগুলি ফ্রিজে থাকাকালীন অভিযুক্ত আফতাব নাকি বাড়িতে অন্য মহিলাদের ডেকে মেলামেশা করতেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে কেউ এলে জায়গা বদল হত শ্রদ্ধার কাটা মুন্ডুর।
পুলিশের হাতে এই তথ্যও উঠে আসে যে, খুনের পর রোজ রাতে শ্রদ্ধার কাটা মুন্ডুর সঙ্গে কথা বলতেন আফতাব। শুধু তাই-ই নয়, ফ্রিজ থেকে কাটা মুন্ডু বার করে সেটাকে মেক আপ করাতেন বলেও জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন আফতাব। রাগ হলে চড়ও মারতেন কাটা মুন্ডুর গালে।
পুলিশ প্রতিবেশী এবং শ্রদ্ধার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছে যে, আফতাব নাকি শ্রদ্ধাকে প্রায়ই মারধর করতেন। শ্রদ্ধার সেই চিৎকার পৌঁছেছিল প্রতিবেশীদের কানেও। বন্ধুরাও জানিয়েছেন, এত মারধরের পরেও কেবল মাত্র প্রেমের টানে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি শ্রদ্ধা।
খুনের কয়েক দিন আগে আফতাবের সঙ্গে হিমাচল ঘুরতেও গিয়েছিলেন শ্রদ্ধা। কয়েক দিন আগে ঘুরে এসেছিলেন হৃষীকেশ থেকেও। কিন্তু তখনও শ্রদ্ধা জানতেন না যে কী করুণ পরিণতি হতে চলেছে তাঁর জীবনের।
খুনের কয়েক দিন পর ১৮ দিন ধরে ছত্রপুর জঙ্গলের বিভিন্ন জায়গায় শ্রদ্ধার দেহের টুকরোগুলি ছড়িয়ে দিয়ে আসেন অভিযুক্ত আফতাব। সন্দেহ এড়াতে আফতাব রোজ রাত ২টো নাগাদ একটি পলিব্যাগে করে শ্রদ্ধার দেহের টুকরো নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোতেন বলেও পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে।
শ্রদ্ধার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করার পর দিল্লি পুলিশ গত শনিবার আফতাবকে গ্রেফতার করে। তখন থেকেই শুরু হয়েছে বিস্তারিত তদন্ত।
ছত্রপুর জঙ্গল থেকে মানবদেহের ১৩টি টুকরো ইতিমধ্যেই উদ্ধার করা গিয়েছে বলেও পুলিশ সূত্রে খবর। তবে সেই দেহের টুকরোগুলি শ্রদ্ধারই কি না, তা জানতে সেগুলির ফরেন্সিক পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে শ্রদ্ধা ওয়ালকারের দেহ ৩৫ টুকরো করা হয়েছিল, সেই অস্ত্রও এখনও খুঁজে পায়নি দিল্লি পুলিশের তদন্তকারী দল।
দিল্লি পুলিশের এক আধিকারিক জানান, শ্রদ্ধাকে গলা টিপে খুনের পর আফতাব একটি করাত কিনে আনেন। দেহ কাটার পর তিনি ওই করাত দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে আসেন। রক্তমাখা জামাকাপড় ফেলে দিয়ে এসেছিলেন একটি আবর্জনা সংগ্রহের ভ্যানে।
পুলিশ ইতিমধ্যেই শ্রদ্ধা এবং আফতাব যে বাড়িটিতে থাকতেন তার মেঝে থেকে চাপ চাপ রক্তের দাগ খুঁজে পেয়েছেন। সেগুলিও ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
এ ছাড়াও পুলিশের অনেক সিসিটিভি ফুটেজ এখনও খতিয়ে দেখা বাকি। তবে সব সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যাবে না বলেও পুলিশের অনুমান।
শ্রদ্ধার মতো অন্য কোনও মহিলা আফতাবের হাতে খুন হয়েছেন কি না, তা-ও খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে দিল্লি পুলিশ।