মহাকাশ মানেই রহস্যের আকর। গভীর অন্ধকার সেই রহস্যের আড়ালে কত কিছুই না ঘটে চলেছে। এর সিংহভাগ পৃথিবীর মানুষের নাগালের বাইরে। মহাকাশের কোনও না কোনও প্রান্তে পৃথিবীর মতো গ্রহ খুঁজে চলেছেন মহাকাশ গবেষকেরা। ভিন্গ্রহে প্রাণের খোঁজ পেতে বেতার সঙ্কেত পাঠিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে পৃথিবীর বুকে বসে।
সেই রকমই একটি পরীক্ষা চালাতে গিয়ে ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার মহাকাশ গবেষকেরা লক্ষ করেন, মহাশূন্য থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত এক সঙ্কেত। ২২ মিনিট পর পর সেই সঙ্কেত ধরা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে মহাকাশে। সেই সঙ্কেতের উৎস জানার চেষ্টা করতে প্রকাশ্যে আসে অদ্ভুত তথ্য।
সেই সময় ‘মারচিসন ওয়াইডফিল্ড অ্যারে’ পদ্ধতিতে গবেষণা চালাচ্ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। সেই সময় টানা ৪৮ ঘণ্টা ধরে মহাকাশে ভেসে আসা বিভিন্ন সঙ্কেত নথিবদ্ধ করার চেষ্টা করছিলেন অষ্ট্রেলিয়ার গবেষকদল। তাঁদের লক্ষ্য ছিল পালসার বা নিউট্রন তারকা এবং শ্বেত বামন গ্রহ।
গবেষকেরা দেখেন, মহাকাশ থেকে ভেসে আসা এই সঙ্কেত নতুন নয়। এক বা দুই বছর নয়, টানা ৩৫ বছর ধরে পৃথিবীতে ভেসে আসছে এই বেতার সঙ্কেত। এর রহস্যভেদ আজও করতে পারেননি মহাকাশবিজ্ঞানীরা। কোথা থেকে আসছে, কারা পাঠাচ্ছে এই সঙ্কেত? বিশেষ কোনও বার্তা বহন করে আনছে কি? সঠিক ভাবে জানা যায়নি কিছুই।
১৯৮৮ সালে প্রথম বার এই ধরনের বেতার সঙ্কেতের অস্তিত্ব নজরে পড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দাবি, কয়েক বছর আগে ২১ মিনিটের একটি বেতার সঙ্কেত রেকর্ড করা হয়। ওই সময় কয়েক মিলিসেকেন্ডের জন্য রেডিয়ো সিগন্যাল পেয়েছিলেন তাঁরা। পরবর্তী কালে কয়েক মিনিট ধরে বেতার সঙ্কেত রেকর্ড করা হয়।
গবেষকেরা এর নাম দেন ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’। ৩৫ বছর ধরে এই মহাকাশবার্তার অস্তিত্ব টের পেলেও এখনও এর কোনও ব্যাখ্যা নেই গবেষকদের কাছে। পুরনো তথ্য হাতড়ে ও অঙ্ক কষে মহাকাশবিজ্ঞানীরা জানতে পারেন, ১৫ হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে ভেসে আসছে এই রহস্যবার্তা। প্রতি ১৮ মিনিট অন্তর সঙ্কেত আসার ঘটনা লক্ষ করেন বি়জ্ঞানীরা।
কারা পাঠাচ্ছে এই বার্তা? তবে কি অন্য কোনও গ্রহের বাসিন্দারা বার বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে? টানা তিন দশক ধরে কেনই বা ভেসে আসছে এই সঙ্কেত? রহস্যময় এই বার্তা নিয়েই ‘আ লং পিরিয়ড রেডিয়ো ট্রানজ়িয়েন্ট অ্যাকটিভ ফর থ্রি ডেকেডস’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধ বিজ্ঞান বিষয়ক পত্রিকা ‘নেচার’-এ প্রকাশ করেন একদল গবেষক।
সেই গবেষণায় বলা হয়েছিল, এই তরঙ্গ বা সঙ্কেতগুলি কোনও পালসার থেকে আসছে। পালসার হল এমন একটি মহাজাগতিক বস্তু, যা নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণে পড়ে থাকা কোরের অংশ। যখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয় তখন বিধ্বস্ত নক্ষত্রের কোরের পদার্থসমূহ সঙ্কুচিত হতে থাকে।
অতিরিক্ত সঙ্কোচনের ফলে তৈরি হয় নিউট্রন তারকা। এই নিউট্রন তারকা একটি নির্দিষ্ট স্পন্দনের মাপে তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ নির্দিষ্ট দিকে বিকিরণ করে। এই তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ স্পন্দনে বা ‘পালসের’ আকারে প্রবাহিত হয় বলে এদের নাম ‘পালসার’।
প্রবল বেগে ঘুরতে থাকা এই পালসার থেকে নির্গত শক্তির মাধ্যমেই ১৫ হাজার আলোকবর্ষ দূর থেকে বেতার সঙ্কেত আসছে পৃথিবীতে। প্রাথমিক ভাবে এমনটাই মত ছিল গবেষকদের। এই পালসারের চৌম্বকীয় শক্তি বেড়ে গেলে ঘূর্ণনের গতিবেগ আরও বেড়ে যায়। গতিবেগ যত বাড়ে ততই বেতার তরঙ্গ নির্গত হতে থাকে এর আশপাশে।
যখনই এই তরঙ্গ পৃথিবীর ধারেকাছে আসে তখনই অ্যান্টেনায় ধরা পড়ে সেই সঙ্কেতগুলি। পৃথিবীতে আসা অন্যান্য পালসার তরঙ্গের সঙ্গে ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’-এর তরঙ্গ তুলনা করে দেখা শুরু করেন। সেই তথ্য যাচাই করে দেখতে গিয়েই ভুল ভাঙে জোতির্বিজ্ঞানীদের। তাঁরা বুঝতে পারেন গোড়ায় এই বেতার তরঙ্গ পালসার থেকে আসছে মনে হলেও আদতে এর উৎস ‘পালসার’ নয়।
সাধারণত পালসার থেকে নির্গত তরঙ্গের সময় দৈর্ঘ্য পরিমাপ করে এই মহাজাগতিক বস্তুগুলির আয়ুষ্কাল নির্ণয় করা সম্ভব। এমনিতে পালসারগুলির তরঙ্গ প্রেরণের স্থায়িত্ব ০.২৫ সেকেন্ড থেকে ২ সেকেন্ড। ক্রমাগত শক্তি প্রেরণ করতে করতে একসময় পালসারগুলি সেই ক্ষমতা হারিয়ে তরঙ্গ পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
পালসারগুলি শক্তিক্ষয় হওয়ার পর এমন একটি অবস্থায় চলে আসে যা মৃত্যুর ঠিক আগের দশা বলা যেতে পারে। মহাকাশবিজ্ঞানের ভাষায় ‘ডেথ ভ্যালির’ দিকে এগোতে থাকে এই নিউট্রন তারকাগুলি। এই অঞ্চলে প্রবেশ করলে পালসারগুলির রেডিয়ো সঙ্কেত পাঠানোর সময়ে অনেকটাই পরিবর্তন ঘটে। কারণ তাদের ঘূর্ণন অনেকটাই সঙ্কুচিত হয়ে যায়।
একটা সময় পর পালসারগুলি থেকে বেতার তরঙ্গ আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। অন্য পালসারের বার্তার সঙ্গে ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’ এর স্পন্দনের রেখচিত্র মেপে দেখার পর চমকে ওঠেন মহাকাশ গবেষকেরা। রহস্যময় বেতারবার্তাটি আসছে তারকাদের মৃত্যু উপত্যকার ওপার থেকে। তা দেখে গবেষকেরা নিশ্চিত হন, এই সঙ্কেত কোনও ভাবেই পালসার থেকে আসছে না।
তবে কোথা থেকে আসছে এই সঙ্কেত? জোর্তিবিজ্ঞানীদের একাংশের ধারণা, এই সঙ্কেতের উৎস হতে পারে ম্যাগনেটার। এরাও এক ধরনের নিউট্রন তারকা, যাদের প্রচণ্ড শক্তিশালী চৌম্বকীয় বলয় থাকে। এদের চৌম্বকীয় ক্ষেত্র থেকে পালসারের থেকেও বেশি বেতার তরঙ্গ, চৌম্বক তরঙ্গ এমনকি এক্স রে-ও নির্গত হতে থাকে। এদের সঙ্কেত পাঠানোর সময়ও পালসারের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি।
‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’এর সেই তরঙ্গ অন্য ম্যাগনেটারের পাঠানো তরঙ্গের সঙ্গে তুলনা করে দেখেও হতাশ হন বি়জ্ঞানীরা। কারণ ম্যাগনেটার থেকে বেতার তরঙ্গ বেরোনোর পাশাপাশি এক্স-রে তরঙ্গ পাঠাতে থাকে যা ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’এ অনুপস্থিত। সে কারণে ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’-এর উৎস ম্যাগনেটার এই সম্ভাবনাও বাতিল করে দেন তাঁরা।
সেই মুহূর্তে মহাকাশ গবেষকদের মনে আরও একটি সম্ভাবনার কথা উঁকি দেয়। পালসারের মতোই আচরণ করা আরও এক মৃত তারকা হল শ্বেত বামন পালসার। সূর্যের থেকে বেশি ভরের নক্ষত্রগুলি জ্বলতে জ্বলতে ফুরিয়ে যাওয়ার পর শ্বেত বামন পালসারে পরিণত হয়। ভর বেশি হওয়ার কারণে এদের মধ্যে শক্তিশালী চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। এর ফলে সাধারণ পালসারগুলির মতো আচরণ করতে থাকে।
এই শ্বেত বামন পালসারগুলির কণা চুম্বক শক্তির সংস্পর্শে আসার পরই পালসারের মতো নির্দিষ্ট সময় অন্তর আলো ও সঙ্কেত প্রেরণ করতে থাকে। তবে, শ্বেত বামন পালসারগুলির সঙ্কেত পাঠানোর দৈর্ঘ্য ১০০ সেকেন্ড থেকে ১০০০ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
মহাকাশ গবেষকেরা ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’ থেকে আসা বেতার তরঙ্গের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেন। অন্যান্য পালসার বা ম্যাগনেটারের তুলনায় একমাত্র শ্বেত বামন পালসারের বেতার তরঙ্গের সঙ্গে ‘জিপিএম জে ১৮৩৯-১০’ তরঙ্গের মিল রয়েছে বলে জানান তাঁরা।
এত গুলি সম্ভাবনার কথা জানালেও কোনও সঠিক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছননি বিজ্ঞানীরা। এই সঙ্কেতের অর্থও উদ্ধার করে উঠতে পারেননি মহাকাশ গবেষকেরা।
সব ছবি :সংগৃহীত।