বিজ্ঞাপনের ক্যাচ লাইনে এক কথা। আর সব শেষে গিয়ে দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ উল্টো সতর্কবাণী। এ-হেন ‘বিভ্রান্তিকর এবং প্রতারণামূলক’ প্রচার বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন এক ব্যক্তি। দায়ের হয়েছে জনস্বার্থ সংক্রান্ত মামলা। আর তাতে নাম জড়িয়েছে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ‘সিকিউরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া’ (সেবি) এবং মিউচুয়াল ফান্ডের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অফ মিউচুয়াল ফান্ডস ইন ইন্ডিয়া’র (অ্যামফি) নাম।
সম্প্রতি বম্বে হাই কোর্টে মিউচুয়াল ফান্ডের বিজ্ঞাপনকে নিয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছেন এক ব্যক্তি। আবেদনকারী জানিয়েছেন, মিউচুয়াল ফান্ডের বিজ্ঞাপনে একে ‘সঠিক বিনিয়োগ’ বলে প্রচার করা হচ্ছে। এর ক্যাচ লাইনটি হল ‘মিউচুয়াল ফান্ড সহি হ্যায়’। অথচ একে ‘বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ’ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।
আর এখানেই আবেদনকারীর প্রশ্ন, মিউচুয়াল ফান্ড সঠিক বিনিয়োগ হলে তা বাজারগত ঝুঁকিসাপেক্ষ হয় কী ভাবে? একে বিভ্রান্তিকর এবং প্রতারণামূলক প্রচার বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। বিষয়টির শুনানিতে রাজি হয়েছে বম্বে হাই কোর্ট। শুধু তা-ই নয়, অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ করেছে আদালত। সেবি ও অ্যামফিকে নোটিস জারিরও নির্দেশ দিয়েছে বম্বে হাই কোর্ট।
চলতি বছরের ১৮ ডিসেম্বর এই জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়। মামলাকারী পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্ট (সিএ) বলে জানা গিয়েছে। তাঁর অভিযোগ, বেপরোয়া ভাবে প্রচার করছে অ্যামফি। বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা এবং সুরক্ষার কথা ভাবা হচ্ছে না। ফলে লগ্নিকারীদের আর্থিক দিক থেকে লোকসানের আশঙ্কা বাড়ছে।
পাশাপাশি, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া এবং সেবির বিজ্ঞাপনের তুলনা টেনেছেন মামলাকারী। তাঁর যুক্তি, সরকারি সংস্থা বা সরকারি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত কোনও সংগঠন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন করে না। আমজনতাকে সতর্ক বা শিক্ষিত করে তোলাই সরকারি সংস্থার কাজ। কিন্তু অ্যামফির বিজ্ঞাপনে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
মামলাকারীর দায়ের করা পিটিশনে বলা হয়েছে, ‘‘অ্যামফির বিজ্ঞাপনে বিনিয়োগকারীদের শিক্ষা বা সচেতনতার কোনও উপাদান নেই। সেখানে মিউচুয়াল ফান্ডের বৈশিষ্ট্য বা সীমাবদ্ধতার কথা বলা হচ্ছে না। কোনও ভিত্তি ছাড়াই মিউচুয়াল ফান্ডকে ‘সহি হ্যায়’ বলে ট্যাগলাইন জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। নৈতিক দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ অনুচিত।’’
পিটিশনে আরও বলা হয়েছে, অ্যামফি হল মিউচুয়াল ফান্ডের একটি সংগঠন। ফলে শুধুমাত্র তার সদস্যদের কথা মাথায় রেখে বিজ্ঞাপন করছে এই সংস্থা। তাঁদের লাভের জন্যেই মিউচুয়াল ফান্ডকে ‘সহি হ্যায়’ বলা হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের নিয়ে অ্যামফির কোনও মাথাব্যথা নেই।
সরকারি তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ। ২০১৯ সালে এই তহবিলে বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ২৬ লক্ষ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মে মাসে লগ্নির পরিমাণ বেড়ে ৬৭ লক্ষ ২৬ হাজার কোটিতে পৌঁছে গিয়েছে।
সম্প্রতি স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) প্রকাশিত রিপোর্টেও একই কথা বলা হয়েছে। এসবিআই জানিয়েছে, মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে লড়াইয়ে ঝুঁকি আছে জেনেও মিউচুয়াল ফান্ড এবং স্টকে লগ্নির দিকে ঝুঁকছেন বিনিয়োগকারীরা। কমছে ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের প্রথাগত সঞ্চয়ের প্রকল্পগুলিতে লগ্নির অঙ্ক।
মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের দু’টি উপায় রয়েছে। একটি হল ‘লাম্পসাম’ বিনিয়োগ। এতে এককালীন বড় অঙ্কের টাকা লগ্নি করতে হয়। দ্বিতীয়টির নাম ‘সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি’। এতে আবার নির্দিষ্ট ব্যবধানে সংশ্লিষ্ট তহবিলে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিনিয়োগ করতে পারেন লগ্নিকারী।
‘লাম্পসাম’ বিনিয়োগে লগ্নিকারী এক বারে তাঁদের ইচ্ছা মতো ইউনিট কিনতে পারেন। এই বিনিয়োগ অতিরিক্ত সম্পদ তৈরিতে সাহায্য করে। তবে ‘লাম্পসাম’ বিনিয়োগে লাভ নির্ভর করে কোন সময়ে লগ্নি করা হচ্ছে তার উপর। এতে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি।
‘সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানে’ লগ্নিকারী নির্দিষ্ট বিরতিতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন। এই পরিমাণ সাধারণত বিনিয়োগকারীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে কাটা হয়। এসআইপিকে মাঝারি বা কম ঝুঁকির বিনিয়োগ বলে জানিয়েছেন বাজার বিশ্লেষকেরা।
‘লাম্পসাম’ বিনিয়োগ পুরোপুরি বাজারের উত্থান-পতনের উপরে নির্ভরশীল। অন্য দিকে এসআইপি পুরোপুরি বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তবে এসআইপিতে লগ্নি করলে বাজারের কর্মদক্ষতার উপর নজর রাখার জন্য এক জন পর্যবেক্ষক প্রয়োজন। এতে বিনিয়োগের খরচ অনেকটাই কম।
শেয়ার বাজার বুলিশ হলে ‘লাম্পসাম’ লগ্নিতে বেশি লাভ হয়। অন্য দিকে বাজারের অস্থিরতা এসআইপির পক্ষে ভাল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞেরা। ‘লাম্পসামে’ কস্ট অ্যাভারেজিংয়ের সুবিধা থাকলেও এসআইপিতে তা নেই। নমনীয়তার দিক থেকেও দু’টি তহবিল একে অপরের বিপরীত।
মিউচুয়াল ফান্ড পোর্টফোলিয়ো হল বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ডের সংমিশ্রণ, যা এক জন বিনিয়োগকারী তাঁর বৈচিত্রময় বিনিয়োগের জন্য সাবধানে নির্বাচন করেন। এর মাধ্যমে ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতা এবং বিনিয়োগের লক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সম্পদ শ্রেণির (স্টক, বন্ড, নগদ) মধ্যে বিনিয়োগ বিতরণ করা হয়।
১৯৯৫ সালের ২২ অগস্ট আত্মপ্রকাশ করে মিউচুয়াল ফান্ডের সংগঠন অ্যামফি। বর্তমানে এর সদস্যসংখ্যা ৪৪। অ্যামফির প্রতিটি সদস্যের সেবির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। সংগঠনটির সিইও হলেন এন এস ভেঙ্কটেশ। ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ওই পদে রয়েছেন তিনি।
করোনাকালে হঠাৎ করেই ‘ফ্র্যাঙ্কলিন টেম্পলটন’ নামের সংস্থা তাদের তহবিল বন্ধ করে দিয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের হয়। শীর্ষ আদালত সংশ্লিষ্ট সংস্থাটিকে ২০ দিনের মধ্যে লগ্নিকারীদের বিনিয়োগ ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ফলে ফ্র্যাঙ্কলিনকে ফেরাতে হয় ৯,১২২ কোটি টাকা।
কিছু দিন আগে আবার লগ্নিকারীদের সতর্ক করে বিজ্ঞপ্তি দেয় কোয়ান্ট মিউচুয়াল ফান্ড। বিভিন্ন সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে মিউচুয়াল ফান্ডে প্রতারণা হচ্ছে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়। এর থেকে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
মিউচুয়াল ফান্ডের একাধিক বিজ্ঞাপনে ভারতীয় ক্রিকেটারদের দেখা গিয়েছে। তালিকায় রয়েছে সচিন তেন্ডুলকার বা রোহিত শর্মার নামও। জনস্বার্থ মামলার পিটিশনে অবশ্য তাঁদের নামে আলাদা করে কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি ওই চার্টার্ড অ্যাকাউট্যান্ট।
সব ছবি: সংগৃহীত।