বিরাট অঙ্কের ঋণ নিতে চলেছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই)। কোষাগারে ১২৫ কোটি ডলার আনার পরিকল্পনা রয়েছে দেশের এই সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের। ভারতীয় মুদ্রার নিরিখে যা ১০ লক্ষ কোটি টাকার বেশি। এটি দেশের আর্থিক খাতে সবচেয়ে বড় ডলার নির্ধারিত ঋণ হতে চলেছে বলে জানা গিয়েছে।
এ দেশের ব্যাঙ্কগুলিকে ব্যবসার প্রয়োজনে সব সময়েই ঋণ দিয়ে থাকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা আরবিআই। কিন্তু, ১২৫ কোটি ডলারের ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের থেকে নিচ্ছে না এসবিআই। এর জন্য তিনটি বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেছে নিয়েছে তারা।
সূত্রের খবর, পাঁচ বছরের মেয়াদে ওই ঋণ নিতে চায় স্টেট ব্যাঙ্ক। এর জন্য সিটিবিসি ব্যাঙ্ক, এইচএসবিসি হোল্ডিংস এবং তাইপেই ফুবন ব্যাঙ্কের দ্বারস্থ হয়েছে এসবিআই। সংবাদমাধ্যম ‘ব্লুমবার্গ’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ৯২.৫ বেসিস পয়েন্ট সুদের মার্জিনে ঋণ পেতে চলেছে এসবিআই। এই সুদের হার ঝুঁকিমুক্ত সুরক্ষিত এবং রাতারাতি অর্থায়নের হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে জানা গিয়েছে।
১২৫ কোটি ডলারের ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে অবশ্য সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি এসবিআই। তবে সূত্রের খবর, তিনটি বিদেশি ব্যাঙ্কের থেকে ওই অর্থ হাতে পেলে তা ‘গুজরাট ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল টেক সিটি’-এর (গিফ্ট সিটি) শাখায় ব্যবহার করবে স্টেট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ। অহমেদাবাদের কাছে ৮৮৬ একর জমির উপরে অত্যাধুনিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে যা ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করছে।
কেন হঠাৎ আরবিআইকে বাদ দিয়ে বিদেশি ব্যাঙ্ক থেকে ডলারে ঋণ নিচ্ছে এসবিআই? আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এর নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রথমত, গত কয়েক দিন ধরেই ডলারের তুলনায় ভারতীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হচ্ছে। বর্তমানে ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে প্রায় ৮৫ টাকায় পৌঁছে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্টেট ব্যাঙ্ক ডলারে ঋণ নিলে সেই পরিস্থিতি কিছুটা সামলানো যাবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
দ্বিতীয়ত, তথ্য বলছে, চলতি বছরে দেশে ডলারে ঋণের পরিমাণ প্রায় ২৭ শতাংশ কমে গিয়েছে। ওই ঋণ কমে ১ হাজার ৪২০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বড় সংস্থাগুলি ডলারে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনীহা দেখানোয় এটা তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। ভারতীয় অর্থনীতির জন্য ডলারে ঋণ কমে যাওয়াকে একেবারেই ভাল ভাবে দেখছেন না আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
সূত্রের খবর, তিনটি বিদেশি ব্যাঙ্ক থেকে ১২৫ কোটি ডলারের ঋণ পেলে তা গিফ্ট সিটিতে লগ্নি করবে এসবিআই। ওই শহরে বসে বিদেশে লেনদেন করা ব্যবসায়ী বা সংস্থার সংখ্যা খুব একটা কম নয়। তাদের ডলারে ঋণের চাহিদা মেটাতে চাইছে স্টেট ব্যাঙ্ক, রিপোর্টে এমনটাই দাবি করেছে ব্লুমবার্গ।
এসবিআই ছা়ড়াও বেশ কয়েকটি নন-ব্যাঙ্কিং ফিন্যান্সশিয়াল কোম্পানি (এনবিএফসি) বিদেশি মুদ্রা ধার করা শুরু করেছে। তালিকায় নাম রয়েছে ‘চোলামণ্ডলাম ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি’-র। ৩০ কোটি ডলারের সিন্ডিকেট মেয়াদি সুবিধা বৃদ্ধি করেছে এই এনবিএফসি। ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া তিন বছরের মেয়াদে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার ঋণ চাইছে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সিডনি শাখা। অন্য দিকে, ৭৫ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে ব্যাঙ্ক অফ বরোদা। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, এ বছরের জুলাইতে তিন বছরের জন্য ৭৫ কোটি ডলার ঋণ নিয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক।
চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর দেশের বড় ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে এসবিআই, এইচডিএফসি এবং আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ককে ‘ঘরোয়া পদ্ধতিগত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাঙ্ক’-এর (ডোমেস্টিক সিস্টেমেটিক্যালি ইম্পর্টেন্ট ব্যাঙ্ক বা ডি-এসআইবি) তকমা দিয়েছে আরবিআই। আগামী বছরের (পড়ুন ২০২৫) ১ এপ্রিল থেকে স্টেট ব্যাঙ্ক এবং এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক উচ্চ বাফার প্রয়োজনীয়তাগুলি রিপোর্ট করবে বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক।
আরবিআই সূত্রে খবর, স্টেট ব্যাঙ্ককে তার ঝুঁকি ভারযুক্ত সম্পদের ০.৮০ শতাংশের একটি অতিরিক্ত মূলধন বাফার বজায় রাখতে হবে। বর্তমানে সেই অঙ্ক ০.৬০ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্য দিকে, আগামী বছর এপ্রিলের আগে এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক তাদের মূলধন বাফারকে ০.২০ শতাংশ থেকে ০.৪০ শতাংশে বৃদ্ধি করবে।
২০১৫ সালে প্রথম বার ডি-এসআইবির তকমা পায় স্টেট ব্যাঙ্ক। ঠিক তার পরের বছরই এই পালক ওঠে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের মুকুটে। ২০১৭ সালে ডি-এসআইবি তালিকায় চলে আসে এইচডিএফসি ব্যাঙ্ক। তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানই সেই অবস্থান এখনও ধরে রেখেছে।
প্রায় ৬৯ বছর আগে ১৯৫৫ সালের ১ জুলাই আত্মপ্রকাশ করে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। বর্তমানে এর গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি। অর্থাৎ, প্রতি তিন জন ভারতীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের মধ্যে এক জনের এসবিআইয়ের সঙ্গে সংযোগ রয়েছে।
স্টেট ব্যাঙ্কের ৫৭.৫৯ শতাংশ অংশীদারি রয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। দেশ জুড়ে এর শাখার সংখ্যা সাড়ে ২২ হাজারের বেশি। ভারতের বাইরে ২৯টি দেশে ছড়িয়ে রয়েছে এসবিআইয়ের ব্যবসা। দেশ ও বিদেশ মিলিয়ে এর এটিএমের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৮০০।
আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ভারতের বাইরে ইউরোপের আরও কয়েকটি দেশে ব্যবসা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এসবিআইয়ের। ডলার ঋণ নিলে সেই রাস্তা অনেকটাই সুগম হবে। আগামী দিনে আফ্রিকার দেশগুলিতে স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উল্লেখ্য, যে তিনটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে এসবিআই ডলারে ঋণ নিতে যাচ্ছে, তার মধ্যে দু’টি তাইওয়ানের সংস্থা। সেগুলি হল, সিটিবিসি ব্যাঙ্ক এবং তাইপেই ফুবন ব্যাঙ্ক। বহুজাতিক এইচএসবিসি হোল্ডিংসের মূল কার্যালয় রয়েছে ব্রিটেনে।