রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করল ওয়াগনার বাহিনী। একই সঙ্গে রেডিয়োবার্তায় মস্কো অভিযানের কথাও ঘোষণা করেছে কুখ্যাত এই ‘ভাড়াটে খুনিদের দল’। যা আবার পরিচিত ‘পুতিনের নিজস্ব সেনা’ নামেও।
ওয়াগনার প্রধান অলিগার্চ ইয়েভজেনি প্রিগোজিনের দাবি, তাঁর বাহিনীর উপর ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাচ্ছে মস্কোর সামরিক বাহিনী। যে কারণে তাঁর প্রায় দু’হাজার সেনার মৃত্যু হয়েছে।
রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের নেতৃত্বেই তাঁর বাহিনীর উপর হামলা চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ প্রিগোজিনের। আর সেই কারণেই নাকি মস্কোর উপর প্রতিশোধ নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ওয়াগনার গোষ্ঠী।
যদিও রাশিয়া শুক্রবার ওয়াগনার গোষ্ঠীর সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। পুতিন সরকারের তরফে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, প্রিগোজিনের সব অভিযোগ মিথ্যা এবং অবাস্তব।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রিগোজিন নাকি রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ‘শেষ দেখে ছাড়বেন’ বলে ঘোষণা করেছেন। ওয়াগনার গ্রুপের পথে যাঁরা বাধা হয়ে দাঁড়াবেন, তাঁদের সকলকে তাঁর বাহিনী ‘ধ্বংস’ করে দেবে বলেও নাকি হুঙ্কার ছেড়েছেন তিনি।
রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য সাধারণ রুশ নাগরিকদেরও তাঁর বাহিনীর পাশে এসে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন ওয়াগনার প্রধান।
প্রিগোজিনের দাবি, তাঁর বাহিনী ইতিমধ্যেই দক্ষিণ রাশিয়ার রোস্তভ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তবে এখনও তাঁর এই ঘোষণার সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
ওয়াগনার গোষ্ঠীর সম্ভাব্য হামলা নিয়ে আপাতত মুখে কুলুপ এঁটেছে ক্রেমলিন। যদিও রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা টাস জানিয়েছে, শনিবার ভোর থেকেই ব্যস্ততা লক্ষ করা গিয়েছে মস্কো জুড়ে। রাস্তায় সাঁজোয়া গাড়ি নামানো হয়েছে। মস্কোর বিভিন্ন সরকারি ভবনের সামনেও বেড়েছে নিরাপত্তা। যদিও প্রিগোজিনের তরফে ‘সশস্ত্র বিদ্রোহ’-এর ঘোষণার পর তদন্তের ডাক দিয়েছে রুশ সরকার।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পর থেকে কিভ দখলের লড়াইয়ে ওয়াগনার গ্রুপের উপর ভরসা রেখেছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
মস্কোর নির্দেশে প্রিগোজিনের ব্যক্তিগত বাহিনী ইউক্রেনের বিভিন্ন জায়গায় হত্যালীলা চালিয়েছিল বলেও অভিযোগ তুলেছিল ইউক্রেন।
তবে গত কয়েক মাসে ক্রেমলিন এবং ওয়াগনার গোষ্ঠীর সমীকরণে অনেক বদল এসেছে। প্রকাশ্যে এসেছে ওয়াগনার বাহিনী এবং মস্কোর সামরিক নেতৃত্বের মতপার্থক্য। যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর জন্য বার বার রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমভকে দায়ী করেছেন প্রিগোজিন।
এখন আর সেই দ্বন্দ্ব, তর্ক এবং বাগ্বিতণ্ডার জায়গায় সীমাবন্ধ নেই। আরও একধাপ এগিয়ে তা ‘সশস্ত্র বিদ্রোহের’ রূপ নিয়েছে।
ওয়াগনার গ্রুপ একটি স্বনিয়ন্ত্রিত সামরিক বাহিনী। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব জুড়ে ধর্ষণ, ডাকাতি, খুন এবং যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
দীর্ঘ দিন ধরে ক্রেমলিনের সঙ্গে ওয়াগনার বাহিনীর সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেছে রাশিয়া। তবে পশ্চিমি দুনিয়ার দাবি, রাশিয়ার বিভিন্ন গোপন কাজ উদ্ধারের দায়িত্ব দেওয়া ছিল এই বাহিনীর উপর।
বার বার এ-ও দাবি করা হয়েছে, ওয়াগনার গ্রুপ পুতিনের ব্যক্তিগত বাহিনী, যারা কেবলমাত্র রাশিয়ার একনায়কের নির্দেশই অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও ওয়াগনার বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেন, সিরিয়া, লিবিয়া, সুদান এবং মোজাম্বিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।
পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ এবং সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য ওয়াগনার বাহিনীকে কাজে লাগানো হত বলেও অতীতে অভিযোগ উঠেছে।
প্রিগোজিন ওয়াগনার বাহিনীতে নতুন সদস্য নিয়োগের দায়িত্বে। তিনি পুতিনের ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসাবেও পরিচিত। মনে করা হয় ক্রেমলিনের বিশেষ বিশেষ কাজ দেখাশোনার কাজেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর কেটারিংয়ের ব্যবসা আছে। সেই কারণে ‘পুতিনের রাঁধুনি’ বলেও পরিচিত প্রিগোজিন।
মনে করা হয়, এর আগে বিশেষ অভিযান চালানোর জন্য এই বাহিনীকে পূর্ব আফ্রিকায় মোতায়েন করে ক্রেমলিন। যদিও এর দায় বরাবরই এড়িয়ে গিয়েছে রাশিয়া। জল্পনা রয়েছে, সিরিয়ার আন্দোলকারীদের দমন করতেও এই ওয়াগনার বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছিলেন পুতিন।
এই বাহিনীর অস্তিত্ব নিয়ে বহু জল্পনা থাকলেও ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে এই গোষ্ঠীর কার্যকলাপ প্রথম প্রকাশ্যে নজরে আসে।
প্রাথমিক ভাবে, রাশিয়ার কয়েকশো অভিজ্ঞ সেনা নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। শোনা যায়, ডনবাসের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা ক্রেমলিনের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলে তাঁদের হত্যা করার জন্য এই বাহিনীকে পাঠানো হয়। তবে ওয়াগনার নয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় চাপে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর উপরই।
ওয়াগনারের প্রতিষ্ঠাতা এবং নেতা দিমিত্রি উডকিন, রাশিয়ার বিশেষ বাহিনী স্পেটসনাজ-এর লেফটেন্যান্ট কর্নেল ছিলেন।
শোনা যায়, একসময় ওয়াগনার বাহিনী এতটাই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে রুশ সরকারও তাঁদের অর্থ দিতে অস্বীকার করে। এর পরে পুতিন অলিগার্চকে এই গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত করেন।
ছবি: সংগৃহীত।