হাতিয়ার আমদানিতে ‘রুশ প্রেম’ বাড়িয়েছে বিপদ। বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) থেকে শুরু করে রণতরী বা ডুবোজাহাজ। চুক্তি মেনে এ হেন ‘গেম চেঞ্জিং’ সমরাস্ত্র সময় মতো সরবরাহ করতে পারছে না মস্কো। যা নয়াদিল্লির কপালে ফেলেছে চিন্তার ভাঁজ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, রাশিয়া থেকে যে হাতিয়ারগুলি আসার কথা রয়েছে, তার জন্য ‘অনন্ত অপেক্ষা’ ছাড়া গতি নেই। স্থল-বায়ু-নৌবাহিনীর হাতে সেগুলি তুলে দিতে আরও দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মস্কোর সঙ্গে হওয়া প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
ভারতকে হাতিয়ার সরবরাহে এ হেন ‘গড়িমসি’ রাশিয়া ইচ্ছাকৃত ভাবে করছে, তা কিন্তু একেবারেই নয়। গত আড়াই বছর ধরে (পড়ুন ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে) ইউক্রেনের সঙ্গে পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ লড়ছে মস্কো। ফলে চুক্তি মোতাবেক অস্ত্র নির্মাণ এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা নয়াদিল্লিকে সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে পূর্ব ইউরোপের এই দেশ।
নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরবরাহ করতে না পারা রুশ হাতিয়ারের তালিকায় রয়েছে ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’, মাল্টিরোল ফ্রিগেট ও ডুবোজাহাজ রয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে মস্কোর থেকে দু’টি ফ্রিগেট ভারতীয় নৌসেনা পেতে চলেছে বলে খবর মিলেছে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দু’বছর পর যা সরবরাহ করতে চলেছে ‘বাদামি ভালুকের দেশ’।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, এ বছরের ডিসেম্বরে দু’টি ফ্রিগেট হাতে পাওয়ার পর লম্বা সময়ের জন্য থেমে যাবে রুশ অস্ত্রের আগমন। ২০২৬-’২৭ সালের আগে আর কোনও হাতিয়ার পাঠাতে পারবে না মস্কো। যা আরও বিলম্বিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
২০১৮ সালে দু’টি রণতরী নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে ভারত। যা ২০২২-’২৩ সাল নাগাদ সরবরাহ করার কথা ছিল। এখনও পর্যন্ত দু’টি যুদ্ধজাহাজের একটিও হাতে পায়নি নৌসেনা। ফলে ভারতীয় জল-যোদ্ধাদের আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা থমকে গিয়েছে।
বিলম্বিত হাতিয়ারের তালিকায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নাম হল রুশ বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ। ২০১৮ সালের অক্টোবরে যার পাঁচটি ইউনিট কিনতে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি করে নয়াদিল্লি। রুশ সফরে গিয়ে যার চূড়ান্ত রূপ দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চুক্তিতে সইয়ের সময়ে হাজির ছিলেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও।
এস-৪০০ বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনতে ৩৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে নয়াদিল্লি। ২০২৩ সালের মধ্যেই যার সব ক’টি ইউনিট ভারতীয় বায়ুসেনার অস্ত্রাগারে চলে আসার কথা ছিল। কিন্তু, এখনও পর্যন্ত এর তিনটি ইউনিট সরবরাহ করেছে মস্কো। বাকিগুলি ২০২৬ সালের আগে এ দেশে আসার কোনও সম্ভাবনাই নেই বলে জানা দিয়েছে।
বিশ্বের উন্নততম বায়ু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলির অন্যতম হল এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ। এতে রয়েছে উন্নত রাডার ও বিশেষ ধরনের ইন্টারসেপ্টিং ক্ষেপণাস্ত্র। যা ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত শত্রুর ছোড়া কোনও ক্ষেপণাস্ত্র বা রকেটকে মাঝ আকাশেই ধ্বংস করতে সক্ষম।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিন ও পাকিস্তানের কথা মাথায় রেখে রাশিয়ার এই হাতিয়ার কিনেছে নয়াদিল্লি। প্রতিবেশী জোড়া শত্রু দেশের অস্ত্রাগারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের দূরপাল্লার ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র। সেগুলির থেকে আকাশসীমাকে সুরক্ষিত করতে নয়াদিল্লির ভরসা মস্কোর ওই হাতিয়ার। যা নির্ধারিত সময়ে হাতে না আসায় সমস্যা বেড়েছে।
২০১৯ সালে রুশ পরমাণু ডুবোজাহাজ লিজ়ে নিতে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি করে নয়াদিল্লি। আগামী বছর (পড়ুন ২০২৫ সাল) ১ জানুয়ারি যা ভারতীয় নৌসেনার ঘাঁটিতে চলে আসার কথা। সূত্রের খবর, বাস্তবে তেমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ২০২৮ সালের আগে ওই পরমাণু ডুবোজাহাজ পাওয়ার আশা করছে নয়াদিল্লি। অর্থাৎ, এটি সরবরাহের ক্ষেত্রে তিন বছরের বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সংবাদ সংস্থা ‘ফার্স্ট পোস্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাশিয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বে হাতিয়ার সরবরাহ করার প্রবণতা রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মস্কোর অস্ত্র বিক্রির পরিমাণ ৬০ শতাংশ কমে গিয়েছে।
এ ছাড়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার উপর বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। যার জেরে হাতিয়ারের অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। রুশ ও ভারতীয় মুদ্রায় (রুপি-রুবল) সরাসরি প্রতিরক্ষা বাণিজ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। যা হাতিয়ার সরবরাহে বিলম্বের অন্যতম প্রধান কারণ।
ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ শুরু করার পর থেকেই নিজের সেনাবাহিনীর প্রয়োজনীয়তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে মস্কো। কিন্তু তার পরেও যুদ্ধের সময়ে উত্তর কোরিয়া ও ইরান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র, গোলা-বারুদ এবং ড্রোন আমদানি করতে হয়েছে রাশিয়াকে। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে নিতে হয়েছে চিনের সাহায্যও।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, বিলম্বে হাতিয়ার সরবরাহ চলতে থাকলে বিকল্প রাস্তায় হাঁটতে পারে ভারত। প্রথমত, এর জন্য আগামী দিনে ধীরে ধীরে অস্ত্র কেনার ব্যাপার রাশিয়ার থেকে মুখ ফেরাতে পারে নয়াদিল্লি। সেই জায়গা নিতে পারে আমেরিকা, ইজ়রায়েল, ফ্রান্স-সহ পশ্চিম ইউরোপের নেটোভুক্ত একাধিক দেশ।
উদাহরণ হিসাবে ভারতের ডুবোজাহাজ ফ্লিটের কথা বলা যেতে পারে। আগামী দিনে স্পেন বা জার্মানির সঙ্গে এ ব্যাপারে চুক্তির বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে নয়াদিল্লি। যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। বার্লিন ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনাবেচার ক্ষেত্রে ভারতকে ‘বিশেষ মর্যাদা’ দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আগামী দিনে উন্নতি হাতিয়ার কেনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হস্তান্তরে আরও জোর দেবে কেন্দ্র। যাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারবে নয়াদিল্লি। অস্ত্র প্রযুক্তি পুরোপুরি হাতে পেয়ে গেলে সেই মতো প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ঘরের মাটিতেই তৈরি করতে পারবে ভারত। এর জন্য অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি হস্তান্তর হলে দেশে প্রতিরক্ষা শিল্পের প্রসার ঘটবে। তৈরি হবে কর্মসংস্থান। পাশাপাশি, দেশের মাটিতে নির্মিত হাতিয়ার বিদেশের বাজারে চড়া দামে বিক্রিও করতে পারবে ভারত। যা আর্থিক উন্নতিতে সাহায্য করবে।
বর্তমানে যুদ্ধবিমানের অভাবে ভুগছে ভারতীয় বায়ুসেনা। আর তাই ১১৪টি ফাইটার জেট কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি। বায়ুসেনার পছন্দের তালিকায় বিভিন্ন যুদ্ধবিমানগুলির মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার তৈরি ‘এসইউ-৭৫ চেকমেট’ এবং ‘এসইউ-৫৭ ফেলন’। বিলম্বিত হাতিয়ার সরবরাহের কারণে যা কেনার সিদ্ধান্ত শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে পারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
সব ছবি: সংগৃহীত।