জম্মু-কাশ্মীর থেকে আন্তর্জাতিক নজর কি এ বার ভারতের পশ্চিম প্রান্তে আনতে চাইছে পাকিস্তান? হঠাৎই সাংবাদিক বৈঠক করে গুজরাতের জুনাগড়কে নিজেদের অংশ বলে বহু পুরনো দাবি আবার খুঁচিয়ে তুলল ইসলামাবাদ। ওই অঞ্চলে ভারতের ‘অবৈধ দখলদারি’র নিন্দা করে পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র মুমতাজ জাহরা বালোচ দাবি করেন, ১৯৪৮ সাল থেকে জুনাগড় কব্জা করে রেখেছে ভারত।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের অবস্থান সব সময়ই স্পষ্ট বলেও দাবি করেছেন মুমতাজ। তিনি বলেন, “দেশভাগের সময়ে জুনাগড় পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। পরে অবৈধ ভাবে তা দখল করে ভারত। গোটা বিষয়টিকে ঐতিহাসিক এবং আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে পাক জনগণ। জুনাগড় পাকিস্তানের একটি অংশ এবং এই অংশ অবৈধ ভাবে দখল করে রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে ভারত।”
মুমতাজ দাবি করেছেন, পাকিস্তানের তরফে সর্বদাই জুনাগড়ের বিষয়টি রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক মঞ্চে উত্থাপিত হয়েছে। পাকিস্তান এ বার এ নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় বলেও তিনি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘জুনাগড়কে ভারতের অবৈধ ভাবে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরের মতো একটি অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডা হিসাবে বিবেচনা করে পাকিস্তান।’’
তবে জুনাগড় নিয়ে পাকিস্তানের দাবি নতুন নয়। ২০২০ সালে নেপালের পর ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলকে তাদের রাজনৈতিক মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করেছিল পাকিস্তান। সে দেশের মন্ত্রিসভাও তাতে অনুমোদন দিয়েছিল।
পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখের কিছু অংশ ওই মানচিত্রে রাখা হয়েছিল। একই সঙ্গে গুজরাতের জুনাগড় ও মানবগড় শহর এবং স্যর ক্রিক অঞ্চলও পাকিস্তানের অংশ বলে দাবি করা হয়েছিল।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদালোপের বর্ষপূর্তির ঠিক এক দিন আগে, এই নয়া মানচিত্র উন্মোচন করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছিলেন, ‘‘এই মানচিত্র প্রত্যেক পাক নাগরিক এবং কাশ্মীরের মানুষের আশার প্রতীক।’’
তার পর সিন্ধু নদ দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। ক্ষমতা হারিয়েছেন ইমরান। গ্রেফতারও হয়েছেন। ক্ষমতায় এসেছে শাহবাজ শরিফের সরকার।
প্রায় চার বছর আগে পাকিস্তান ওই রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করার পর ভারত সেটিকে অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছিল। জুনাগড়কে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করাকেও পাকিস্তানের ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ পোষণ বলে দাবি করেছিল নয়াদিল্লি।
অন্য দিকে, ইসলামাবাদের দাবি ছিল, জুনাগড়ের শেষ নবাব মহম্মদ জাহাঙ্গির খান নাকি চাইতেন, যেন পাকিস্তানেরই অংশ হয় জুনাগড়। করাচিতে ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুর সময় জাহাঙ্গির নাকি বলেছিলেন, ‘‘পাকিস্তানের অংশ জুনাগড়।’’
জাহাঙ্গির পূর্বপুরুষদের শাসন করা জমিতে কখনও ফিরে যেতে পারেননি। তবে তিনি মাটির টান ভুলতেও পারেননি। তিনি সেই সময়ে বলেছিলেন, “১৯৪৭ সালে আমার দাদু পাকিস্তানে যোগদানের জন্য স্বাক্ষর করেছিলেন। তবে এর জন্য তাঁকে তাঁর রাজত্ব হারাতে হয়েছিল। আমরা এখনও আমাদের রাজ্যের (জুনাগড়) জন্য লড়াই করছি। বিষয়টি রাষ্ট্রপুঞ্জে বিচারাধীন।”
জুনাগড় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। শোনা যায়, জাহাঙ্গিরের দাদু নবাব মহম্মদ মহাবত খান (তৃতীয়) চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি তাঁর প্রজারা। অশান্তি ঠেকাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর নির্দেশে জুনাগড়ের কাছে পৌঁছয় সেনা।
এর পরে পরিবার, কুকুর, মূল্যবান জিনিসপত্র এবং কোষাগার ফাঁকা করে করাচি চলে যান মহাবত। ১৯৪৮ সালে ভোট করে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয় জুনাগড়কে।
জাহাঙ্গির খানের এস্টেট এবং সম্পত্তির তালিকা অনুযায়ী, যে পরিমাণ সম্পত্তি তাঁর দাদু ভারতে রেখে গিয়েছিলেন, তার অঙ্ক কোটি কোটি টাকা।
যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, জুনাগড় থেকে করাচি যাওয়ার পরেই মহাবত ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে জুনাগড়ে ফিরে আসার এবং তাঁর রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে একত্রিত করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তবে কোনও ভাবে তা সম্ভব হয়নি।
করাচিতে পরিবার নিয়ে যাওয়ার পর ফাতেমা জিন্না রোডে ‘জুনাগড় হাউস’ নামে অট্টালিকা তৈরি করেন মহাবত। সেই ভবনে মহাবতের তিন প্রজন্মেরও বেশি বসবাস করছেন।
সিন্ধ প্রদেশের গভর্নরও হন মহাবতের পুত্র তথা জাহাঙ্গিরের পিতা নবাব মহম্মদ দিলওয়ার খানজি।
২০০৪ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাহাঙ্গির তাঁর শিকড়ের টানের কথা জানিয়েছিলেন এবং তা খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “আমার ইচ্ছা জুনাগড় যাওয়া এবং সেই রাজ্যের মানুষের সঙ্গে দেখা করা। কামনা করি, দেশভাগের আগে সেখানে মুসলিম এবং হিন্দুদের ভ্রাতৃত্ববোধ যেমন ছিল, তেমনই যেন থাকে।
সেই জুনাগড়কে পাকিস্তানের অংশ দেখিয়ে বছর চারেক আগে মানচিত্র প্রকাশ করেছিলেন ইমরান। সরকার বদলের পর আবার বিষয়টি চাঙ্গা হয়েছে। শাহবাজ সরকারও দাবি করেছে, জুনাগড় অবৈধ ভাবে দখল করে রেখেছে ভারত।
সব ছবি: সংগৃহীত।