কথায় আছে, ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’। কোরীয় উপদ্বীপে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে সেই প্রবাদ। ‘শব্দ বোমা’র তাণ্ডবে প্রাণ যায় যায় দশা বিবদমান দুই দেশের সীমান্তের বাসিন্দাদের।
চলতি বছরের অক্টোবর থেকেই দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্তে একের পর এক উস্কানিমূলক পদক্ষেপ করে চলেছে উত্তর কোরিয়া। এর নবতম সংযোজন হল সীমান্তে ‘শব্দ দানব’-এর অত্যাচার!
প্রশান্ত মহাসাগরের দুই প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রের সীমান্তে লম্বা জায়গা জুড়ে রয়েছে অসামরিক এলাকা বা ‘ডিমিলিটারাইজ়ড জ়োন’। ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই কোরীয় যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যার জন্ম হয়েছিল।
সিওলের অভিযোগ, হঠাৎ করেই ওই এলাকায় পিয়ংইয়ংয়ের দিক থেকে বিকট শব্দ ভেসে আসছে। এর তীব্রতা এতটাই যে, তাতে কানে তালা লাগার জোগাড় হচ্ছে।
এ হেন ‘শব্দ বোমা’র যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি সইতে হচ্ছে অসামরিক এলাকার একেবারে কাছের গ্রাম ডাংসানের বাসিন্দাদের। তাঁরা জানিয়েছেন, কখনও হুড়মুড়িয়ে কিছু ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে। কখনও আবার একটানা চলছে ভূতুড়ে চিৎকার।
বিষয়টি নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে ঘটনাস্থলে যান আমেরিকার সংবাদ সংস্থা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিনিধিরা। তাঁদের কাছে দুর্ভোগের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন ডাংসানবাসীরা।
দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তের বাসিন্দারা বলেছেন, ‘‘আমরা রাতে ঘুমোতে পারছি না। কোনও গোলাবারুদ ছাড়াই আমাদের উপর বোমাবর্ষণ চলছে। এটা যে কতটা ভয়াবহ, তা বলে বোঝাতে পারব না।’’
সূত্রের খবর, চলতি বছরের জুলাই মাস থেকেই সীমান্তে লাউডস্পিকারগুলিকে সক্রিয় করার নির্দেশ দেন উত্তর কোরিয়ার ‘সুপ্রিম লিডার’ কিম জং উন। তার পর থেকেই সেগুলি অষ্টপ্রহর গগনভেদী শব্দ করে চলেছে।
এত দিন সীমান্তের ওই লাউডস্পিকারগুলি মিথ্যা খবর প্রচারের জন্য ব্যবহার করত কিমের ফৌজ। বর্তমানে সেগুলি যে শব্দব্রহ্মের জন্ম দিচ্ছে, তার সঙ্গে ধাতব গ্রাইন্ডিং আর কামান গর্জনের তুলনা টানা যেতে পারে।
পিয়ংইয়ংয়ের এই পদক্ষেপের জেরে ডিমিলিটারাইজ়ড জ়োন সংলগ্ন গ্রামবাসীদের মধ্যে তৈরি হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। তাঁদের অধিকাংশই নিদ্রাহীনতায় ভুগছেন। দেখা দিয়েছে মাথা যন্ত্রণা ও মানসিক চাপজনিত রোগ।
ডাংসানের এক গ্রামবাসী বলেছেন, ‘‘লাউডস্পিকারগুলিতে আগে সব কিছুই মনুষ্য কণ্ঠে সম্প্রচারিত হত। তাতে থাকত হুমকি আর যুদ্ধের কথা। কিন্তু সেটা মানুষের কণ্ঠস্বর হওয়ায় আমরা সহ্য করতে পারতাম।’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের দাবি, সীমান্তে এই ধরনের উত্তেজনা দুই কোরিয়াকে ফের এক বার যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। সেটা বুঝতে পেরেই নিজেদের ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে পিয়ংইয়ং ও সিওল।
সিওল ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে কথাটুকু পর্যন্ত বলা বন্ধ করে দিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার সর্বাধিনায়ক কিম। রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলেছেন তিনি। ইউক্রেন যুদ্ধে সৈনিক দিয়ে মস্কোকে সাহায্যও করছেন তিনি। দুই দেশের মধ্যে সামরিক চুক্তিও রয়েছে।
অন্য দিকে, দেশরক্ষায় পিছিয়ে থাকতে নারাজ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। আমেরিকা-সহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সামরিক মহড়া বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, পিয়ংইয়ংয়ের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারে নেমেছে সিওল।
চলতি বছরের মে মাসে আবর্জনা ভর্তি বেলুন পাঠিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার উপর ‘চরম প্রতিশোধ’ নেয় কিমের দেশ। এর কিছু দিন আগেই উত্তর কোরিয়ায় সুপ্রিম লিডারের বিরুদ্ধে লিফলেট বিলি করেছিল সিওল।
আবর্জনা ভর্তি বেলুন উড়ে আসার পর চুপ করে বসে থাকেননি প্রেসিডেন্ট সুক ইওল। সীমান্তে লাউডস্পিকার লাগিয়ে কোরীয় পপ গান ও পিয়ংইয়ং-বিরোধী খবর সম্প্রচার শুরু করেন তিনি। ‘ভূতুড়ে শব্দে’ তারই পাল্টা জবাব আসছে বলে মনে করা হচ্ছে।
দুই দেশের এই রণং দেহি ভাবের ব্যাখ্যা দিয়েছেন কোরীয় গবেষক কাং ডং-ওয়ান। তাঁর কথায়, ‘‘পিয়ংইয়ং জানে, তাদের লাউডস্পিকারের প্রচার আর সে ভাবে কাজ করছে না। সিওলের লিফলেট বিলি থামাতে মরিয়া তারা। আর তাই পরিকল্পনা বদলে কান ফাটানো শব্দ দিয়ে জব্দ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।’’
কিম ফৌজের শব্দ দানবের থেকে রক্ষা পেতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন ডাংসানের বাসিন্দারা। শব্দ আটকাতে জানলায় স্টাইরোফোম লাগিয়েছেন তাঁরা। দিনের বেলাতেও ঘরের বাইরে খুব বেশি বার হচ্ছেন না তাঁরা।
যদিও এ ব্যাপারে সুক ইওল সরকারে সমালোচনা করতে ছাড়েননি ডাংসনের গ্রামবাসীরা। ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধ বলেছেন, ‘‘সরকার আমাদের পরিত্যাগ করেছে। কারণ এখানকার সকলেই বৃদ্ধ।’’
‘কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশন’-এর প্রাক্তন প্রধান কোহ ইউ-হওয়ান সীমান্তের পরিস্থিতিকে যথেষ্ট উদ্বেগের বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘দুই দেশকেই তাদের পুরনো চুক্তি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। বন্ধ করতে একে অপরের বিরুদ্ধে অপবাদ। তবেই এ সব বন্ধ হওয়া সম্ভব।’’
সম্প্রতি সীমান্তের ডিমিলিটারাইজ়ড জ়োন সংলগ্ন যাবতীয় সংযোগ উড়িয়ে দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। নষ্ট করেছে সেখানকার জিপিএস। ফলে কোরীয় উপদ্বীপে যে সংঘাতের কালো মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
সব ছবি: সংগৃহীত।