মহাশূন্য দক্ষযজ্ঞ! জুড়ে যাবে মুখোমুখি দুই কৃত্রিম উপগ্রহ। রাইফেল থেকে ছোড়া বুলেটের ১০ গুণ গতিতে ঘুরতে ঘুরতে ঘটবে মিলন! না, কোনও কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। বছরশেষে চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই পরীক্ষাই করতে চলেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন’ (ইসরো)। ফলে আরও এক বার অন্তরীক্ষে নয়া ইতিহাস তৈরির স্বপ্নে বিভোর ১৪০ কোটি ভারতীয়।
চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর। সারা বিশ্ব যখন নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে তৈরি হবে, তখনই জটিল পরীক্ষায় নামবে ইসরো। পৃথিবীর কক্ষপথে ঘূর্ণায়মাণ দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহকে জুড়ে একটি মহাকাশযান তৈরি করবে ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা। ইসরোর এই পরীক্ষার পোশাকি নাম ‘স্পেস ডকিং এক্সপেরিমেন্ট মিশন’ (স্পাডেক্স)।
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দাবি, পৃথিবীর কক্ষপথে বুলেটের চেয়ে ১০ গুণ গতিতে ঘুরে চলা দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহকে জুড়ে একটি মহাকাশযান তৈরি করা যেমন কঠিন, তেমনই চ্যালেঞ্জিং। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে এই বিষয়ে নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে গিয়েছে বেঙ্গালুরুর সংস্থাটি।
বর্তমানে কেবলমাত্র আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কাছে রয়েছে এই প্রযুক্তি। ৩০ ডিসেম্বরের মিশনে সফল হলে চতুর্থ দেশ হিসাবে এই ক্লাবে যোগ দেবে ভারত। মহাকাশ স্টেশন তৈরির ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি অত্যাবশ্যক। ইসরো যে ইতিমধ্যেই সেই লক্ষ্যে পা বাড়াতে শুরু করেছে, তা বলাই বাহুল্য।
ইসরো সূত্রে খবর, ৩০ ডিসেম্বরে দু’টি বিশেষ ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহকে পৃথিবীর কক্ষপথে নিয়ে যাবে ‘পোলার স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকল’ (পিএসএলভি) নামের রকেট। উপগ্রহগুলির প্রতিটির ওজন ২২০ কেজি। মহাশূন্যে সেগুলিকে ‘ডকিং’ এবং ‘আনডকিং’ করবেন এ দেশের মহাকাশ গবেষকেরা।
মহাশূন্যে তীব্র গতিতে ঘূর্ণায়মান দু’টি বস্তুকে কাছাকাছি এনে জুড়ে দেওয়াকেই বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ডকিং’। সেই কাজটাই করতে চলেছে ইসরো। পরীক্ষা সফল হলে ফের ওই দুই উপগ্রহকে আলাদা করা হবে। যাকে ‘আনডকিং’ বলে চিহ্নিত করেছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা।
ইসরো জানিয়েছে, পৃথিবীর ৪৭০ কিলোমিটার উপরে চলবে এই পরীক্ষা। এর জন্য বিশেষ একটি প্রযুক্তি ব্যবহার করছে ভারতীয় গবেষণা সংস্থা। এর নাম ‘ভারতীয় ডকিং সিস্টেম’। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এই কাজে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তার নাম ‘ইন্টারন্যাশনাল ডকিং সিস্টেম স্ট্যান্ডার্ড’ (আইডিএসএস)। ভারতীয় প্রযুক্তিটি সমমানের বলে দাবি করেছে বেঙ্গালুরুর গবেষণা সংস্থা।
এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথ। তাঁর কথায়, ‘‘ভারত নিজস্ব ডকিং প্রযুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এই ধরনের জটিল এবং সুক্ষ্ম প্রযুক্তি কখনওই কোনও দেশ হস্তান্তর করে না। এটা সত্যিই গর্বের।’’ ইসরো ইতিমধ্যেই এই ডকিং প্রযুক্তির স্বত্ব নিয়েছে।
মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছে, পৃথিবীর কাছের কক্ষপথে ঘণ্টায় ২৮ হাজার ৮০০ কিলোমিটার বেগে ঘুরবে মহাকাশযানগুলি। অর্থাৎ, যাত্রিবাহী বিমানের চেয়ে ৩৬ গুণ বেশি থাকবে তাদের গতিবেগ। ওই অবস্থাতেই তাদের ডকিং এবং আনডকিংয়ের পরীক্ষা চালানো হবে।
এই পরীক্ষার জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ বহনকারী রকেটের নকশা বিশেষ ভাবে করা হয়েছে। উপগ্রহগুলির গায়ে থাকছে একটি বিশেষ চাদর। ডকিংয়ের সময়ে চাদরটিকে সক্রিয় করবেন ইসরোর বিজ্ঞানীরা। আর সঙ্গে সঙ্গেই উপগ্রহের আপেক্ষিক বেগ ০.০৩৬ কিমি/ঘণ্টায় নেমে আসবে।
দু’টি উপগ্রহের মিলনের সময়ে তাদের গতিবেগ দাঁড়াবে সেকেন্ডে ১০ মিলিমিটার। এই দুই নভযানের নাম ‘চেজ়ার’ এবং ‘টার্গেট’ রেখেছে ইসরো। মহাশূন্যে তারা জুড়ে গিয়ে একটি মহাকাশযান তৈরি করবে।
ইসরো চেয়ারম্যান এস সোমনাথ বলেছেন, ‘‘শুনতে এটা বেশ সহজ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু ডকিং হল একটা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। পদার্থবিদ্যার বহু হিসাব-নিকাশ মাথায় রাখতে হয়েছে। ওই সময়ে দু’টি উপগ্রহকে একই কক্ষপথে থাকতে হবে। জুড়ে যাওয়ার পর তারা যেন রাস্তা হারিয়ে না ফেলে সে দিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখব আমরা।’’
মহাকাশ বিজ্ঞানীদের দাবি, অন্তরীক্ষে স্টেশন তৈরির ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি সবচেয়ে জরুরি। কারণ, ওই স্টেশন কখনওই একবারে নির্মাণ করা সম্ভব নয়। পৃথিবী থেকে ধাপে ধাপে মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়া হয় এর এক একটি অংশ। এর পর ভাসমান অবস্থাতেই সেগুলি জুড়ে গিয়ে আত্মপ্রকাশ করে আস্ত একটা মহাকাশ স্টেশন।
সোমনাথ জানিয়েছেন, পরবর্তী ‘চন্দ্রযান-৪’ মিশনেও ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হবে এই ডকিং প্রযুক্তি। আগামী দিনে চাঁদে নভচারী পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে ইসরোর। মহাকাশযান নিয়ে পৃথিবীর উপগ্রহে নামতে প্রয়োজন হবে এই ডকিং প্রযুক্তির।
মহাশূন্যে আধিপত্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে ভারতের। আমেরিকার নাসা, রাশিয়ার রসকসমস এবং চিনের সিএনএসএর মতো গবেষণা সংস্থাগুলির সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিচ্ছে ইসরো। এ বার অতি অল্প খরচে মহাশূন্যে ডকিং প্রযুক্তির সফল পরীক্ষা চালাতে চলেছে তারা।
গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে পাঁচটি দেশ মিলে তৈরি করে প্রথম মহাকাশ স্টেশন। দুনিয়ায় এর পরিচিতি ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’ হিসাবে। সম্প্রতি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে ঠিক একই ধরনের মহাকাশ স্টেশন তৈরি করেছে চিন। মহাশূন্যে তাই ড্রাগনকে টক্কর দিতে একই রাস্তায় হাঁটতে চলেছে ইসরো। এ দেশের মহাকাশ স্টেশনের নাম হবে ‘ভারতীয় অন্তরীক্ষ স্টেশন’।
বছরশেষের স্পাডেক্স মিশনের সাফল্যের উপর ইসরোর এই স্বপ্নপূরণ অনেকাংশে নির্ভর করছে। ডকিংয়ের জন্য ব্যবহৃত দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহের নকশাই তৈরি করেছেন ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা। তবে মহাশূন্যে পাঠানোর আগে সেগুলির চূড়ান্ত পরীক্ষা চালিয়েছে ‘অনন্ত টেকনোলজিস’ নামের বেঙ্গালুরুর একটি সংস্থা।
১৯৯২ সালে পথচলা শুরু করে অনন্ত টেকনোলজিস। এর প্রতিষ্ঠাতা সুব্বা রাও পাভুলুরি একসময়ে ইসরোর কর্মী ছিলেন। পরে মহাকাশ গবেষণাভিত্তিক সংস্থার উদ্যোগপতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
বেঙ্গালুরুর ইউআর রাও স্যাটেলাইট সেন্টারের অধিকর্তা এম শঙ্করন বলেছেন, ‘‘একটি বেসরকারি সংস্থাকে এই ধরনের জটিল মিশনের সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ বলতে হবে। এটাও ঠিক যে, যাবতীয় পরীক্ষায় কলার উঁচিয়ে পাশ করেছে অনন্ত টেকনোলজিস।’’
মহাকাশ গবেষকদের একাংশের দাবি, নাসার আইডিএসএস প্রযুক্তির তুলনায় ভারতীয় ডকিং সিস্টেম আরও উন্নত। কারণ মহাশূন্যে এই ধরনের কাজের জন্য মোট ২৪টি মোটর ব্যবহার করে থাকে আমেরিকার সংস্থা। সেখানে মাত্র দু’টি মোটরেই কাজ সেরে ফেলবে ইসরো।
স্পাডেক্স মিশনে এই প্রযুক্তির পরীক্ষার জন্য যে মোটর ব্যবহার হচ্ছে, তার ব্যাস ৪৫০ মিলিমিটার। তবে আগামী দিনে ৮০০ মিলিমিটারের ডকিং সরঞ্জাম তৈরির লক্ষ্য রয়েছে ইসরোর। গগনযান মিশনের মহাকাশচারীরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন বলে জানা গিয়েছে।
৩০ ডিসেম্বর পৃথিবীর কক্ষপথে দু’টি কৃত্রিম উপগ্রহকে স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গেই ‘ডকিং’ করা যাবে এমনটা নয়। তবে নতুন বছরের গোড়াতেই এই সংক্রান্ত সুখবর শোনানো হবে বলে জানিয়েছে ইসরো। আপাতত তার অপেক্ষায় দিন গুনছে আপামর ভারতবাসী।
সব ছবি: সংগৃহীত।