পশ্চিম এশিয়ায় বন্ধ অস্ত্রের ঝনঝনানি! টানা ১৫ মাসের লড়াই শেষে গাজ়া স্ট্রিপে ফিরছে শান্তি। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত হয়েছে বিবদমান ইজ়রায়েল এবং ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। কিন্তু এই সমঝোতা কত দিনের? দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা আদৌ কি আসবে আরব দুনিয়ায়? আপাতত গোলাগুলি বন্ধ হলেও এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান বিশ্বের তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
আর তাই, আরব দুনিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ‘ধ্বংস এবং পুনর্গঠন’ নীতিতে জোর দিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। এ ব্যাপারে ইহুদি দেশ ইজ়রায়েলকে বাড়তি দায়িত্ব নেওয়ার কথা বলেছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, অনেকে আবার এই ইস্যুতে দিয়েছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর মহাশক্তিগুলির একাধিক পদক্ষেপের উদাহরণ।
ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন বিশ্বের অন্যতম ধনকুবের তথা আমেরিকার জনপ্রিয় শিল্পপতি ইলন মাস্ক। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমে হামাস নেতৃত্বকে পুরোপুরি নিকেশ করুক ইহুদি ফৌজ। এর পর দ্বিতীয় ধাপে তেল আভিভকে গাজ়া পুনর্গঠনের দায়িত্ব নিতে হবে।’’ এ ব্যাপারে ১৯৪৫ সালের পর বিশ্বযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত জার্মানি এবং জাপানকে নতুন করে গড়ে তোলার পিছনে আমেরিকার ভূমিকার কথা বলেছেন তিনি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে পরাজিত জার্মানিকে ভার্সাই চুক্তিতে সই করতে বাধ্য করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স-সহ মিত্র শক্তি। এর মাধ্যমে বার্লিনের ঘাড়ে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দেয় তারা। ফলে সেখানকার অর্থনীতি একরকম শেষ হয়ে গিয়েছিল। লড়াইয়ের ঘা শুকনোর আগেই জার্মানিতে চরম আকার নেয় বেকারত্ব। আকাশছোঁয়া হয়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম।
ভার্সাই চুক্তির জেরে জার্মান সরকারের উপর সেখানকার আমজনতার ক্ষোভ বাড়ছিল। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে জাতীয়তাবাদের প্রচারে ঝড় তোলেন অ্যাডলফ্ হিটলার। ফলে দ্রুত রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে চলে আসে তাঁর। হিটলারের কুর্সি লাভে একরকম নিশ্চিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। লড়াইয়ে জাপানকে সঙ্গী হিসাবে পেয়েছিলেন তিনি। অন্য দিকে মিত্র পক্ষের হয়ে যুদ্ধে নেমেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনা।
প্রায় ছ’বছর ধরে চলা ওই লড়াই শেষে পরাজিত জার্মানি এবং জাপানের সঙ্গে ভার্সাই চুক্তির মতো কোনও সমঝোতায় যায়নি ওয়াশিংটন। বরং যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দুই দেশে পুনর্গঠনের কাজে কয়েক কোটি ডলার খরচ করে আমেরিকা। ফলস্বরূপ পরবর্তী দশকগুলিতে ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি জোট ‘নেটো’য় যোগ দেয় বার্লিন। টোকিয়োর সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’-এর। এই নীতিই গাজ়ায় নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে।
এ ব্যাপারে তিনটি পদক্ষেপের কথা বলেছেন তাঁরা। এর প্রথমটি হল, হামাসের অস্তিত্ব বিলোপ। দ্বিতীয় পর্যায়ে গাজ়ায় শিক্ষা বিস্তারের কথা বলেছেন তাঁরা। এতে ইহুদিদের প্রতি সেখানকার বাসিন্দাদের বিদ্বেষ কমবে বলে মনে করেন মাস্কও। পাশাপাশি, ভূমধ্যসাগরের তীরের প্যালেস্টাইনের ওই ছোট্ট ভূখণ্ডটিকে সমৃদ্ধশালী করার পরামর্শও দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এই ধনকুবের শিল্পপতি।
মাস্কের যুক্তি, গাজ়া সমৃদ্ধশালী হলে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রায় আসবে বড় পরিবর্তন। তখন হামাসের জন্য ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চাইবেন না তাঁরা। এতে ওই এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠীটির জনপ্রিয়তার সূচকও নামবে বলে দাবি করেছেন তিনি।
মাস্কের এ হেন পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের দাবি, জরুরি ভিত্তিতে গাজ়ায় কর্মসংস্থান তৈরি করুক ইজ়রায়েল। এর জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহ দিতে বলছেন তাঁরা। গত দেড় বছর ধরে যুদ্ধে সেখানকার বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়েছে বলে একাধিক সমীক্ষা রিপোর্টে ইঙ্গিত মিলেছে।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইজ়রায়েল ও হামাস যুদ্ধবিরতি এবং গাজ়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন তিনি। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী এলাকাটিকে ‘সুবিশাল ধ্বংসস্থল’ বলে উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেছেন, ‘‘গাজ়া পুনর্গঠনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এর উপকূলরেখাটি ভারী চমৎকার। সেখানকার আবহাওয়াও দুর্দান্ত। ফলে গাজ়ায় অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী দেখানোর যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।’’
অন্য দিকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি হতেই গাজ়ার ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে প্রিয় জনের মৃতদেহ উদ্ধারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সেখানকার বাসিন্দারা। ইজ়রায়েলি বিমানহানায় একরকম মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে প্যালেস্তাইন। এক রকম ধূলোয় মিশে গিয়েছে সেখানকার বাড়ি-ঘর ও ফ্ল্যাট। সেই ধ্বংসস্তূপ সরাতে আগামী তিন-চার মাসের বেশি লাগবে বলে মনে করেন অধিকাংশ বিশ্লেষকেরা।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর তিন দিক থেকে ইহুদিভূমিতে ঢুকে মারাত্মক আক্রমণ চালান হামাসের যোদ্ধারা। তাতে প্রাণ হারান প্রায় ১,২০০ নাগরিক। এর পরই প্যালেস্তাইনের স্বশস্ত্র গোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বিমানহানার পাশাপাশি গাজ়ায় স্থল অভিযানও চালিয়েছে ইহুদি ফৌজ।
গত দেড় বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে হামাসের একাধিক শীর্ষনেতাকে নিকেশ করেছে ইজ়রায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। অবশেষে আমেরিকা এবং মিশরের মধ্যস্থতায় কাতারের রাজধানী দোহায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন নেতানিয়াহু।
অক্টোবরে ইজ়রায়লে ঢুকে আক্রমণের সময়ে ২৫১ জনকে অপহরণ করেছিল হামাস। বর্তমানে তাঁদের মধ্যে ৯৪ জন জীবিত রয়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তাঁদের ইজ়রায়েলের হাতে প্রত্যর্পণে সম্মত হয়েছে প্যালেস্টাইনের এই সশস্ত্র গোষ্ঠী। বিনিময়ে ইহুদি জেলে বন্দি থাকা হামাস নেতা এবং যোদ্ধাদের মুক্তি দেবে নেতানিয়াহু সরকার।
চলতি বছরের (পড়ুন ২০২৫) জানুয়ারির মাঝামাঝি এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুদ্ধরত দুই পক্ষ। পরবর্তী পর্যায়ে গাজ়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবে আইডিএফ। পাশাপাশি ইজ়রায়েলি হামলায় বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে বলে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে।
গাজ়ায় ‘ধ্বংস এবং পুনর্গঠন’-এর নীতি কার্যকর করা নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে উল্টো মতও রয়েছে। তাঁদের যুক্তি, দোহার চুক্তিকে যুদ্ধে জয় হিসাবে দেখছেন হামাস নেতৃত্ব এবং গাজ়াবাসী। এই নিয়ে সেখানে রীতিমতো উৎসবও করতে দেখা গিয়েছে তাঁদের।
আমেরিকার ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর গবেষক খলিল শিকাকি জানিয়েছেন, ২০১৪ সালে গাজ়ায় হামাসের সমর্থন অর্ধেকের বেশি কমে গিয়েছিল। কিন্তু, ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধের পর তাতে ৬২ শতাংশের বেশি ঊর্ধ্বগতি দেখা গিয়েছে। এতেই স্পষ্ট যে সেখানকার বাসিন্দাদের মনের গভীরে ইজ়রায়েল বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে পেরেছে হামাস।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই অবস্থায় প্যালেস্তাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠীটির কয়েক জন শীর্ষনেতাকে নিকেশ করে এর অস্তিত্ব ইহুদিরা পুরোপুরি শেষ করতে পারবে, এমনটা নয়। আর তাই গাজ়া থেকে ফের ইজ়রায়েলের উপর আক্রমণের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। দোহার যুদ্ধবিরতি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভাতেও। সেখান থেকে ইতিমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন বেশ কয়েক জন শীর্ষ নেতা।
গাজ়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি নয় আইডিএফও। দোহার চুক্তিকে ‘অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি’ বলেছেন সদ্য কুর্সিতে বসা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তবে ইহুদি-প্যালেস্তাইন চলমান সংঘাতে ওয়াশিংটন নাক গলাবে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘এটা আমাদের যুদ্ধ নয়। ওটা ওদের লড়াই। ফলে এর শেষটা ওদেরই করতে হবে।’’
সব ছবি: সংগৃহীত।