কয়েক দিনের স্থিতাবস্থার পর ফের গাজ়া লক্ষ্য করে আক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি করেছে ইজ়রায়েল। গাজ়ার স্থানীয় প্রশাসনকে উদ্ধৃত করে আল জাজ়িরা জানিয়েছে, শনিবার ইজ়রায়েলি আক্রমণে অন্তত ৪২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
কিছু স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, ইজ়রায়েলের এই হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন হামাসের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডার রাদ সাদ।
প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, এই রাদ গাজ়ায় হামাসের রণকৌশলগত দিকটি পরিচালনা করতেন। তাই তাঁর মৃত্যু প্যালেস্টিনীয় সশস্ত্র সংগঠনটির কাছে বড় ধাক্কা বলেই মনে করা হচ্ছে।
হামাসের অন্যতম শীর্ষনেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ রাদ। এই সিনওয়ারকে বহু বার হত্যা করার চেষ্টা করলেও এখনও পর্যন্ত সফল হয়নি বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সেনা।
এই পরিস্থিতিতে সিনওয়ারের ঘনিষ্ঠকেই হত্যা করল ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ)। যদিও ইজ়রায়েল কিংবা হামাস— কোনও পক্ষের তরফেই এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু জানানো হয়নি।
ইজ়রায়েলি সেনার তরফে জানানো হয়েছে, শনিবার তারা গাজ়া শহরে হামাসের দুই ডেরা শাতি এবং তুফায় আকাশপথে হামলা চালায়।
এই হামলায় ইতিমধ্যেই নিহতের সংখ্যা ৪২ ছুঁয়েছে। হামাস বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি বেশ কয়েক জন প্যালেস্টাইনিও ইজ়রায়েলি হামলায় মারা গিয়েছেন বলে দাবি করা হয়েছে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে।
ইজ়রায়েলি সেনার একাংশের দাবি, দীর্ঘ দিন গাজ়ার আল-শিফা হাসপাতালে গা ঢাকা দিয়েছিলেন রাদ। গত মার্চ মাসে ইজ়রায়েল এই হাসপাতাল লক্ষ্য করে হামলা চালালেও কোনও রকমে পালিয়ে যান হামাসের ওই সামরিক পদাধিকারী। তবে এ বারে শেষরক্ষা হল না।
সামরিক দিক থেকে হামাসকে ধাক্কা দিলেও খুব একটা স্বস্তিতে নেই ইজ়রায়েলও। সে দেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় ভাঙন ধরেছে। সব যুদ্ধবন্দিকে এখনও পর্যন্ত ফেরানো যায়নি। নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবি করে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে ইজ়রায়েলে।
গত ৭ অক্টোবর হঠাৎই ইজ়রায়েলে হামলা চালিয়েছিল হামাস। তার পর থেকে ইহুদিপ্রধান এই দেশটিতে ৪২ হাজারেরও বেশি মহিলা ব্যক্তিগত বন্দুক রাখতে চেয়ে আবেদন জানিয়েছেন প্রশাসনের কাছে।
তার মধ্যে ১৮ হাজার আবেদনপত্র ইতিমধ্যেই সরকারি সিলমোহর পেয়েছে বলে জানিয়েছে সে দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। পরিসংখ্যান বলছে অক্টোবরের পর বন্দুক রাখার লাইসেন্স চেয়ে আবেদনের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্য দিকে, হামাসের পাশে দাঁড়িয়ে সরাসরি ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে লেবাননের ইরানপন্থী সশস্ত্র শিয়া সংগঠন হিজ়বুল্লা। প্রতিরক্ষা বিশারদদের একাংশের বক্তব্য, আয়রন ডোম-সহ ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলিতে যত ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, তার চেয়ে হিজ়বুল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের সংখ্যা বেশি। সে কারণে তাদের হামলা পুরোপুরি ঠেকানো ইজ়রায়েলি সেনার এয়ার ডিফেন্স ইউনিটগুলির পক্ষে সম্ভব না–ও হতে পারে।
প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের চেয়ে হিজবুল্লার যোদ্ধার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। অস্ত্রসম্ভারেও অনেক এগিয়ে লেবাননের শিয়া গোষ্ঠীটি।
নানা ক্যালিবার এবং পাল্লার রকেটের পাশাপাশি ইরানের মদতপুষ্ট এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর হাতে রয়েছে ‘গাইডেড’ ক্ষেপণাস্ত্রও! রয়েছে শক্তিশালী ড্রোন। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমের দাবি, ইরানের সামরিক প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি পুরনো রুশ ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকীকরণের কাজও সেরে ফেলেছে হিজবুল্লা।
তা ছাড়া আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছে ইজ়রায়েল। যুদ্ধাপরাধে নেতানিয়াহুকে অভিযুক্ত করতে চেয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার পাশাপাশি সুর চড়িয়েছে কিউবাও। বন্ধু আমেরিকার তরফেও ‘সহজ শর্তে’ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করার জন্য ‘চাপ’ দেওয়া হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে আক্রমণকে প্রতিরক্ষার অস্ত্র করার কৌশল নিচ্ছে ইজ়রায়েল। নেতানিয়াহুর দক্ষিণপন্থী জোটসঙ্গীরা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। তাই আগ্রাসী অবস্থান থেকে তেল আভিভ এখনই সরবে বলে মনে করছেন না প্রায় কেউই।
নেতানিয়াহুর বিরোধীদের অভিযোগ, ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী দেশের অগ্রগতি বন্ধ করছেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজ়ার জন্য পরবর্তী কোনও পরিকল্পনাও দিতে পারেননি নেতানিয়াহু। হামাসের হাতে বন্দি ইজ়রায়েলিদের উদ্ধারেও যথাযথ কোনও ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। সুতরাং, দেশের উন্নতির জন্য দ্রুত নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।
এই পরিস্থিতিতে গাজ়ার মিশর সীমান্তবর্তী শহর রাফায় হামলার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে ইজ়রায়েল। প্যালেস্টাইনিদের বড় অংশ ফের দক্ষিণ ছেড়ে গাজ়ার খান ইউনিসের মতো শহরগুলিতে সরে আসছেন। তার পরেও যে হামলা এড়ানো যাবে, এমনটা আশা করছেন না গাজ়ার বাসিন্দারা।
কয়েক দিন আগেই ইজ়রায়েলি সেনার মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, “হামাস এমন একটা ধারণা, যা কখনও হারতে পারে না।” মনে করা হচ্ছে, ইজ়রায়েলি প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে আড়াআড়ি ফাটল দেখা গিয়েছে। দীর্ঘ কয়েক মাসের যুদ্ধে ইজ়রায়েলিদের মনোবলও তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে মনে করছেন অনেকে।
গাজ়া এবং প্যালেস্টাইনিদের সুরক্ষিত ভবিষ্যতের স্বার্থে দু’পক্ষের মধ্যে কবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তা-ই এখন দেখার। এ-ও দেখার যে, বহুবিধ চাপের মুখে কোনও পক্ষ আগেই রণে ভঙ্গ দেয় কি না।
সব ছবি রয়টার্স, সংগৃহীত এবং ফাইল।